তিন বন্ধু, একটি স্টোর, এবং সময়ের পরপার

 



তিন বন্ধু – সোতা, কোহেই এবং আতসুয়াএক অপরাধ করার পর খুঁজছে আশ্রয়। লুকিয়ে থাকার একটা জায়গা। সোতা’র মাথায় যে আশ্রয়টি এসেছিল, শহরের একটু বাইরে, কিন্তু শহর থেকে একদম দুরেও নয়, তা হল, একটি পরিত্যক্ত জেনারেল স্টোর – নামিয়া জেনারেল স্টোর। উপায়ান্তর না দেখে তারা সেখানে আশ্রয় নেয়।

মধ্যরাত। মাঝ আকাশে পূর্ণচন্দ্র। তিনজন নামিয়া স্টোরে ঢুকে পড়ে। শাটার নামানো এক অতি সাধারণ স্টোর, যার সামনে একটা আদ্যিকালের মেল স্লট। আগেকার দিনে যারা চিঠি লিখত, ডাকপিওন এসে চিঠির উদ্দিষ্ট প্রেরকের মেইল স্লটে চিঠি ফেলে যেত।

যাই হোক, পেছনের দরজা দিয়ে স্টোরে ঢুকে পড়ে তিনজনে। দরজার সামনে একটা মিল্ক ক্রেট। স্টোরের ভেতরে হাবিজাবি পরিত্যক্ত জিনিসের মধ্যে ছিল মোমবাতি। সেটাই জ্বালানো হল। এবং, ঠিক সেই সময়ে, তিনজনকে চমকে দিয়ে, মধ্যরাত্রে, মেইল স্লটে এসে পড়ল একটা চিঠি! ফোনের যুগে চিঠি! হাড় হিম করা ব্যাপার। কে ফেলল? পুলিশ? না কি কেউ তাদের দেখে ফেলেছে? এখন পুলিশ ডাকার আগে একটু মস্করা করে নিচ্ছে! তিন বন্ধু কাঁপা কাঁপা হাতে চিঠি খুলে দেখল, একটা সমস্যা লেখা আছে চিঠিটার মধ্যে। সমাধান চাইছে একজন মেয়ে – মুন র‍্যাবিট। আতসুয়া এ পর্যায়ে আবিস্কার করে, নামিয়া জেনারেল স্টোর আসলে একটা স্টোর যে জেনারেল স্টোর আপনার আর্তনাদে সাড়া দেয়। অর্থাৎ, কেউ সমস্যার সমাধান চাইলে স্টোর তার উত্তর দেয়। কিন্তু সে তো বহু আগের কথা! তাহলে কি এখনও উত্তরের আশায় চিঠি দিয়ে যায় মানুষ? পরিচয় গোপন রাখবে বলে রাতের অন্ধকারে চিঠি ফেলে যায়, উত্তরের আশায়?

যাই হোক, দয়াপরবশ হয়ে তারা চিঠির উত্তর দেয়। চিঠিটা মিল্ক ক্রেটে রেখে আসার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই উত্তর আসে। তারা স্তব্ধ হয়ে যায়। এত তাড়াতাড়ি উত্তর? তাহলে কি কেউ নজর রাখছে? মিস র‍্যাবিট উত্তরের প্রত্যুত্তরে আরও একটা সমস্যা রেখে গেছেনতিন বন্ধু তারও উত্তর লেখে। কিন্তু পরের চিঠিতে তারা বুঝতে পারে, মিস র‍্যাবিট সেল ফোন, ভিডিও কল ইত্যাদি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। তিন বন্ধু কিছুই বুঝতে পারে না। আজকের যুগে সেল ফোন সম্পর্কে শোনে নি, এমন মানুষ জাপানে আছে? হতেই পারে না। কিন্তু চিঠির ভাষা এবং ঘটনা থেকে তারা বুঝতে পারে, চিঠি আসছে অতীত থেকে। এমন অতীত থেকে, যে অতীতে সেল ফোনের অস্তিত্বই নেই। তারা বেবাক বনে যায়।

সাংঘাতিক ব্যাপার এই যে, বাইরে এসে বুঝতে পারে, পূর্ণিমার চাঁদ যে জায়গায় ছিল, সেই জায়গাতেই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। আকাশের ঠিক সেই জায়গা থেকে একচুলও নড়েনি।

নামিয়া জেনারেল স্টোরে সময় স্তব্ধ। তিন বন্ধু সেই স্থির সময়ে আটকে গেছে। এবং চিঠি আসছে অতীত থেকে। তারা বর্তমান, বলা ভালো, ভবিষ্যত থেকে অতীতে উত্তর পাঠাচ্ছে। যে অতীত আর ভবিষ্যতের মাঝখানের সময় চলে অন্যরকম ছন্দে।

----------------

গল্পের ভাষায় বিষয়টা খোলসা করা যাক ---

.........

মনে হয় বাসাটার ভেতরে আর বাইরে সময় ভিন্ন গতিতে চলে। ভেতরে মনে হয় অনেক সময় কেটে গেছে, কিন্তু বাইরে সেটা এক সেকেন্ডের সমান।

কী বলতে চাচ্ছ তুমি?’

সোতা একবার চিঠিগুলোর দিকে তাকিয়ে আতসুয়ার দিকে ঘুরল, ‘আমরা নিশ্চিত যে বাসার আশেপাশে কেউ আসেনি। কিন্তু তাও কোহেই-এর চিঠি উধাও হয়ে গেল। আর মিস র‍্যাবিটের চিঠিও কোনো রহস্যজনক উপায়ে এখানে চলে এলো। এটা অসম্ভব। কিন্তু এভাবে ভাবো: যদি কেউ আসলেই কোহেইর চিঠি নিয়ে গিয়ে পড়েছে এবং উত্তর এখানে রেখে গেছে-কিন্তু আমরা তাকে দেখতে পাইনি?’

দেখতে পাবো না কেন? সে কি অদৃশ্য নাকি?’

ভূতের মতো?’ কোহেই বলে উঠল, ‘এক মিনিট, এখানে কি ভূত আছে নাকি?’ ভয় পেয়ে গেল সে।

অদৃশ্য না, ভূতও না। সে যেই হোক না কেন, সে আমাদের জগতের না।সোতা চিঠির দিকে তাকালো, ‘সে অতীতের।

অতীতের?’ ঘোঁতঘোঁত করে উঠল আতসুয়া, ‘মানে কী?’

আমার মতে, এই মেইল স্লট আর মিল্ক ক্রেটটা অতীতের সাথে যুক্ত। কেউ যখন অতীত থেকে কোনো চিঠি মেইল স্লটে রাখে, তখন সেটা এই বর্তমানে চলে আসে। একইভাবে আমরা মিল্ক ক্রেটে কোনো চিঠি রাখলে সেটাও অতীতের সেই সময়ে ফিরে যায়। আমাকে এটা জিজ্ঞাসা কোরো না যে এসব কীভাবে হচ্ছে। কিন্তু এই যুক্তিতে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে যায়। মিস র‍্যাবিট সুদূর অতীত থেকে আমাদেরকে চিঠি লিখছে।

-----------------

মজার ব্যাপার, গল্প শুরু হয়েছে ঠিক এই জায়গা থেকে। কিয়েগো হিগাশিনোর এ কোন গোয়েন্দা থ্রিলার নয়। নয় কোন ম্যাজিক রিয়েলিটি। নয় কোন কল্পবিজ্ঞান। অথচ তিনে মিলে এক অদ্ভুত মানসিক টানাপড়েনের গল্প। যে গল্পের মাধ্যম ‘চিঠি’এবং চিঠির প্রেরকেরা এমন এক অতীত থেকে তাদের এমন সব চিরপরিচিত দ্বন্দ্ব, সমস্যা কিম্বা দ্বিধার কথা বলে চলেছে, যা মানুষের চিরকালীন সমস্যার এক-একটা পর্যায়। মজার ব্যাপার প্রেরকেরা কোন না কোনভাবে পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। এবং সেই সম্পর্কের সূত্র আস্তে আস্তে উপরোক্ত তিন বন্ধুর বর্তমানের সাথে এসে যুক্ত হয়।

কি মারাত্মক মাপের টাইম ট্র্যাভেল, না?

 

কিয়েগো হিগাশিনোর এই উপন্যাসের বহুমাত্রিক সমন্বয় আমাকে বিস্মিত করেছে। কি অদ্ভুতভাবে এই উপন্যাসের প্লট ধাপে ধাপে সাজিয়েছেন লেখক। আসলেই জাপানী সাহিত্য আমাকে দিন দিন মুগ্ধ করে দিচ্ছে। আমি আস্তে আস্তে জাপানী লেখার ফ্যান হয়ে যাচ্ছি। আমার কাছে, আস্তে আস্তে, জাপানী সাহিত্য, শুধুমাত্র মুরাকামি নির্ভর সাহিত্য নয়। আস্তে আস্তে অন্যান্য লেখকেরাও তাদের বিস্ময়কর নির্মান নিয়ে আমার যুবতী কল্পনার উড়ানে শক্তি জোগাচ্ছে... অন্যভাবে, অন্য সুরে...

এই উপন্যাসটির অনুবাদক অনুবাদিকা হলেন আমিনা মীম এবং এম এম আই মোহানমোটামুটি ভালো অনুবাদ। পড়তে খারাপ লাগে না। অন্তত কোথাও কোন ফাঁকি কিম্বা অসম্পূর্ণতা আপাতদৃষ্টিতে চোখে পড়ে না।

=====================

দ্য মিরাকলস অব দ্য নামিয়া জেনারেল স্টোর

কেইগো হিগাশিনো

অনুবাদ : আমিনা মীম, এম এম আই মোহান

ভূমিপ্রকাশ

মুদ্রিত মূল্যঃ ৪৯০ টাকা

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে