মুখোশ ও মৃগয়া - স্তানিসোয়াভ লেম
শ্রদ্ধেয়
মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় স্তানিস্লাভ লেম-কে অনুবাদ করা জন্য বেছে নিইয়েছিলেন
দুটি নভেলা --- পোলোভানিয়ে (মৃগয়া) এবং মাস্কা (মুখোশ)। ‘সোলারিস’ নয়,
‘সাইবেরিয়াড’ নয়, ‘হিস মাস্টার্স ভয়েস’ নয়। যুগল উপন্যাসের শিরোনাম রাখলেন, ‘মুখোশ
ও মৃগয়া’।
কেন?
“... লেম-এর
লেখায় মুখোশ, মুকুর বা প্রতিবিম্বের এত ছড়াছড়ি। অচেনার আড়ালে চেনা, চেনা জিনিসকে
অচেনা ক’রে দেখানো, বের্টোল্ট ব্রেখ্ট যাকে বলেন ‘এলিয়েনেশন’ পদ্ধতি, লেম তাকে দুর্ধর্ষ
নৈপুণ্যের সঙ্গে কাজে খাটান। আয়না হয়তো অনেক সময় মিথ্যে কথা বলে, মুখশ্রীর চাইতে
মুখোশই হয়তো অনেক সময় বেশি সত্য। আর লেম এটা করেন একই বিষয়কে নানা কোণ থেকে দেখিয়ে
: ‘মৃগয়া’য় মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছে রোবটকে, আর ‘মুখোশ’-এ রোবট
খুঁজে বেড়াচ্ছে মানুষকে --- যেহেতু তার মধ্যে এই মর্মেই নিদানক্রমে পুরে দেওয়া
হয়েছে। একটা গল্প আরেকটার প্রতিবিম্ব, আবার তা নয়ও। আর সেই জন্যই স্তানিসোয়াভ
লেম-এর সব লেখাই এমন নতুন, উত্তেজন জাগানো, আবার কেমন যেন চেনা চেনা।”
মানবেন্দ্র
বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সমগ্র জীবনে বিশ্ব সাহিত্য পড়েছিলেন প্রচুর। দুই বাংলা মিলিয়ে
নেক্সট একশো বছরে তাঁর মতো এমন বিদগ্ধ পাঠক আর কজন আসবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কিন্তু
সেই মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় যখন বাংলায় অনুবাদ করতে গিয়ে ভারতীয়করণ করে ফেলেন
তখন কেমন যেন বেখাপ্পা লাগে। যেমন একটা উদাহরণ দেওয়া যাক্ ---
‘আরেকবার
তোমায় জিগেস করছি’, তিনি বললেন, ‘বলো, সত্যি, আরহোডাসকে দেখতে পেলে তুমি কি করবে?’
‘তাত, আমিও
আবার বলতে চাই যে আমি সত্যি জানি না...’
তাত! কি
কুশ্রীরকমের চোখে লাগে শুধু তাই নয়, মনে মনে পড়ছি বলেই মনের একটা কান থাকে। সেই
কানেও ততধিক বিশ্রী ঠেকে।
মানবেন্দ্র
বন্দ্যোপাধ্যায় অনুবাদ করতে গিয়ে এতটাই সরলীকরণ করে ফেলেন, যে পড়তে গিয়ে মাঝে মাঝে
মনে হয়, বিদেশী গল্পের ভারতীয় লঘুমনের একটা ভার্সান পড়ছি।
অথচ, এটাও
সত্যি, তিনি না থাকলে, বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ জগত, কানা, এখনও। বাংলাদেশ এসে সেই
অন্ধত্ব খানিকটা হলেও ঘুচিয়েছে।
লেম-এর
কল্পবিজ্ঞানে কিছু একটা থাকে, যা এ পর্যন্ত আর কোন কল্পবিজ্ঞান লেখকের কলমে পাই
নি। একটা দর্শন, যা অনেক গভীরের। মানুষের সাথে রোবটের মধ্যে একটা যোগসূত্র করার
চেষ্টা এবং সেই চেষ্টায় রোবটের মধ্যে মনুষ্যত্ব আর মানুষের মধ্যেকার রোবটত্বকে বের
করে আনার চেষ্টা দেখতে পাই।
প্রথম উপন্যাস (একে বড়োগল্প বলাই ভাল) মৃগয়া। রোবোট, যে কি না
মানুষের জন্যে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে, তাকে হত্যা করা। আমি গল্পে যাব না। কিন্তু গল্পের
মধ্যে কি পাচ্ছি? “পরে অনেক বছর পর্যন্ত তাঁর স্মৃতির মধ্যে আঁকা র’য়ে গেল ছোট্ট
সেই দৃশ্যটা যেখানে মৃত্যুর সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি ক’রেও সে ফিরে এসেছিল, অক্ষত,
অনাহত, অটুট; অথচ কোনোদিনও জানতে পারবে না সম্পূর্ণ সত্য কি ছিল ---- আর তিক্ত
বিতিক্ত র’য়ে গেল এই জ্ঞান যে নিকৃষ্টের মতো, নরাধমের মতো, নৃশংসের মতো পেছন থেকে
ছুরি বসিয়ে দিয়েই সে কিনা হত্যা করেছে তাঁর প্রাণদাতাকে।”
উপন্যাসের একদম শেষ লাইন। দুটো ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে যায় ---
যুদ্ধক্ষেত্রে নীতি ও ন্যায্যতা এবং যুদ্ধের মনস্তাত্বিক প্রভাব। লেম-এর গল্পের
রোবট মানুষকে বাঁচিয়েও বাঁচতে পারে না। মনুষ্যত্ব যুদ্ধের প্রাঙ্গনে বিসর্জিত
হচ্ছে বন্দুকের নির্ঘোষে। কিন্তু বন্দুকবাজ যদি যুদ্ধের পরেও বেঁচে থাকে, তাহলে,
যুদ্ধান্তে, তাঁর মনে কি অবস্থা হচ্ছে? সে কি স্বাভাবিক থাকতে পারছে? সে হিরো।
কিন্তু নিজের কাছে সে কি? তাকে কি তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়? আজীবন? রেসিস্ট্যান্স এবং
সারভাইভ্যালের প্রশ্নের ঠিক বিপরীতে দাঁড়িয়ে এই প্রশ্ন আমাকে তাড়া করে বেড়ায় গোটা
উপন্যাসজুড়ে।
অন্যদিকে ‘মুখোশ’ উপন্যাসের প্রথম অধ্যায়ে রোবটের এক্সিটেনশিয়াল
প্রশ্ন। সে কে? সে কি? সে কেন? রোবটকে বানানো হয়েছে অপূর্ব সুন্দরী নারী করে।
রাজপুত্রের মনোহরণ করে তাকে হত্যা করার জন্য। কিন্তু সেইখানেই লেম থামেন না। রোবট
প্রশ্ন করতে শুরু করে নিজেকে। যেন সে আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগছে। অথচ সে মনে মনে
জানে, তাঁর লক্ষ্যকে যদি সে প্রশ্ন করে, তাহলে তাঁর নিজেরই কোন অস্তিত্ব থাকবে না।
“আমি কে? পর-পর এগিয়ে এল চিন্তারা, সাবলীলভাবে, দক্ষ আর সুপটু। আমার বিমূঢ় অবস্থা
আর এই বিশিষ্ট সমাবেশ --- এই দুয়ের মধ্যে যে বিশেষ-এক বেসুরো অমিল, তা আমি
মুহূর্তে ধ’রে ফেলেছিলুম।” লক্ষ্যবিহীন জীবন কি আমরা নিজেরাই পছন্দ করি? না সেভাবে
বেঁচে থাকতে পারি। লক্ষবিহীন জীবন এক পাগলের জীবন।
কিন্তু জীবনের লক্ষ্য থাকারই বা কি আদৌ কোন উদ্দেশ্য আছে? আলব্যের
কাম্যু কি এই প্রশ্ন দিয়েই শুরু করেন নি তার ‘মিথ অফ সিসিফাস’?
আমার এই লক্ষ্য আর আমার
স্বাধীন ইচ্ছা --- এই দুয়ের দ্বন্দ্বে আমি কি জর্জরিত হই না? হই তো। রোবটটিরও একই
অবস্থা। সেই অবস্থায় সে নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করছে, নিজের ভেতরের অবস্থাটাকে পরিমাপ
করতে চাইছে। কিন্তু হাজার হলেও সে যে রোবট। কলকব্জাগুলোই বেরিয়ে আসছে। এবং সেই
অবস্থাতেই শুরু হচ্ছে রাজপুত্রের প্রতি তাঁর যাত্রা। তাকে হত্যার জন্য, অথবা তাকে
বাঁচানোর জন্য?
তাঁর অবচেতন মন তাকে স্থির হয়ে থাকতে দেয় না। পথের মধ্যে যা বিপদ
সবকিছুকে সে তুচ্ছ করে, ধ্বংস করে, সমাজের আতঙ্কের কারণ হয়, কিন্তু রাজপ্রদত্ত
হত্যাকারীকে রোধ করবে কে? রাষ্ট্রযন্ত্রের তৈরী রোবট রাষ্ট্রযন্ত্রের দ্বারাই
চালিত। লেম এখানেই মাস্টারমাইন্ড। সে প্রশ্ন করে, লেমের গল্পে রোবটেরও কনসাশ থাকে।
সেও জীবন আর মৃত্যুর দ্বন্দ্বে ভোগে। ভালবাসা সেই দ্বন্দ্ব আনে। ভালোবাসায় সেই
দ্বন্দ্বের শেষ।
স্তানিয়েস্লাভ লেম আর চারজন গড়পড়তা সায়েন্স ফিকশান লেখকের মতো নয়,
যে ড্রামার পাশাপাশি একটু বিজ্ঞান আর একটু ভালো ভাল চিন্তাপ্রসূত কথার মধ্যে দিয়ে
পাঠককে আনন্দ দেবে। তিনি পাঠককে তাঁর চেতনার দ্বন্দ্বের মধ্যে ফেলতে ভালোবাসেন। তা
সাইকোঅ্যানালেসিস ঠিক নয়, তা দর্শনের বোধ জাগানিয়া কল্পবিজ্ঞান।
=============================
মুখোশ ও মৃগয়া
স্তানিয়োসাভ লেম
অনুবাদকঃ মানবেন্দ্র
বন্দ্যোপাধ্যায়
কৃতি পাবলিকেশান
মুদ্রিত মূল্যঃ ১৫০ টাকা
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা
Comments
Post a Comment