ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড

 


বইটা যখন হাতে নিলাম, একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়েছিল অজান্তেই। আমি কেন বইটা পড়তে চাইছি? কেন?

ইদানীং কানাঘুষোয় খুব শোনা যাচ্ছে যে, আমাদের দেশ থেকে নাকি আস্তে আস্তে ‘ডেমোক্রেসী’ বিদায় নিচ্ছে। তার স্বপক্ষে এবং বিপক্ষে অনেক বাদ-বিতন্ডা চলছে। মেট্রোপলিটন শহরের এই গরমাগরম বিবাদের ঢেউ আমাদের মফস্বলেও এসে পড়ছে। অনেকে অনেক কিছু বলছে। আমার মনে একটাই প্রশ্ন, ডেমোক্রেসী যদি চলেই যায়, তর্কের খাতিরে, তাহলে রাষ্ট্র আর আমার মধ্যেকার সম্পর্কটি ঠিক কি হতে পারে? ডেমোক্রেসীর জন্যে, জাস্টিসের জন্য আমরা পথে নেমেছি, পথ দখল করেছি। রাষ্ট্রযন্ত্র আমাদের চোখে ‘করাপ্টেড’। আমরা জ্বলন্ত বিবেকের মশাল নিয়ে পথে নেমেছি। আমাদের সম্বল প্রতিবাদ আর প্রতিরোধ।

অ্যালডাস হাক্সলি ১৯৩০ সালে দেখতে পেয়েছিলেন অনেক কিছুই। রাষ্ট্র যখন যন্ত্র, তখন এই রাষ্ট্রযন্তরটি ঠিক কি করতে পারে? এখন হাক্সলি সাহেব তো রিবেলিয়ান মানুষ নন, তিনি তার সাথে সাথে দার্শনিকও। ফলে তিনি মোটামুটি কয়েকটা পয়েন্টকে বেস করলেন এবং রচনা করলেন ‘ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড’। এটি ‘ভেঙে দাও গুড়িয়ে দাও, রাজাকে গদি থেকে টেনে নামাও’ গোত্রের বই নয়। ভাবনা-চিন্তা করার বই। কারণ ভেঙে-গুঁড়িয়ে বিদ্রোহ করা চলে বটে, শান্তি প্রতিষ্ঠাও হয় না, সমাজের উন্নতিও হয় না। প্রতিবেশী দেশ একটা বড়ো উদাহরণ হওয়ার পথে পা বাড়িয়েছে বলে মালুম হচ্ছে।

তবে তার আগে ডিস্টোপিয়া’র মূল পয়েন্টগুলো কি তা বলি। পয়েন্টগুলো ইংরাজীতেই বলি, কারন অধিকাংশ শব্দের প্রকৃত বাংলাটা আমার জানা নেইপয়েন্টগুলো হল -- 1. Totalitarianism, 2. Loss of Individuality, 3. Social Stratification, 4. Technological Control, 5. Environmental Degradation, 6. Loss of Privacy, 7. Restricted Information

হাক্সলি সাহেব বাছলেন এর মধ্যে থেকে কয়েকটি, বলা ভাল, তার কাছে সেই সময়ে দাঁড়িয়ে যে ভয়ানক সমস্যাগুলোর উত্তরোত্তর বৃদ্ধিগুলো চোখে পড়ছিল সেগুলোকে বাছলেন। সেগুলো কি কি? --- 1. Loss of Individual Freedoms, 2. Social Stratification, 3. Technological Control, 4. Environmental Degradation, 5. Psychological Impact

আসলেই এই উপন্যাসটি নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। বইপ্রেমীদের কাছে এই উপন্যাস এত পঠিত এবং এত আলোচিত যে, আমি এখানে কোন দাগই রেখে যেতে পারব না। কেবলমাত্র আমি লিখছি এক তো নিজের জন্য, আর তাদের জন্য, যারা ইংরাজী পড়তে পারেন না বলে প্রচণ্ড কান্নাকাটি করেন। কারন এই বইটির বাংলা অনুবাদ এযাবৎ হয় নি। তবে তাদের কাছে সুখের খবর, কল্পবিশ্ব পাবলিকেশান থেকে সম্প্রতি বইটার সার্থক বাংলা ভাষান্তর হয়েছে সায়ক দত্ত চৌধুরীর হাত ধরে।

তো যা বলছিলাম, আমাকে এই বইয়ের Psychological Impact ভাবিয়েছে সবচেয়ে বেশি। কেন? কারণ, আমার মনে হয়, এই ইমপ্যাক্ট সাধারণ মানুষের ওপর রাখতে পারলে সামাজিক স্থিতাবস্থার নামে বাকি সমস্যাগুলোকে অনায়াসে সমাধান বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। Psychological Impact-কে খেয়াল করছি অনেকগুলো আঙ্গিকে --- 1. Conditioning, 2. Suppression of Emotions, 3. Lack of Individuality, 4. Alienation and Disconnection

আমার মনে হয়, যখন মানুষ এই সমস্ত সমস্যাগুলোকে সমস্যা মনে না করে, স্বাভাবিক হিসাবেই ধরে নিয়ে এগোতে থাকে, তখন, বাকিটা অনেক সহজ হয়ে যায়। উপরোক্ত উপন্যাসের আলফা, বিটা, গামা, ডেল্টা আর এপসাইলনেরা ঠিক সেই পথ ধরেই হেটে চলেছিল যুগের পর যুগতাদের এই সমস্যাটাকেই সাংঘাতিকভাবে বলে ওঠে বন্য জন --- “আপনারা সকলে সকলের হতে গিয়ে আসলে প্রত্যেকে একা হয়ে গেছেন।”

এখন, রাষ্ট্রযন্ত্রেরও একটা উদ্দেশ্য থাকে, কারণ তাকে এই সমাজটিকে সুষ্ঠুভাবে চালাতে তো হবে। তার উদ্দেশ্য কি? বহুযুগ রাজত্ব করা? কিন্তু তা কীসের ভিত্তিতে? অতীতকে নিষিদ্ধ করার ভিত্তিতে, “আমাদের সমাজে প্রাচীন জিনিসের প্রয়োজন নেই। ... মানুষ সৌন্দর্যের দিকে স্বাভাবিকভাবেই আকৃষ্ট হয়। আর আমরা চাই তারা পুরোনো নয়, নতুনদের দিকে নজর দিক। ...” আমরা কি সমাজের স্থিতিশীলতা চাই না? এতএব, “... সমাজ স্থিতিশীল। মানুষেরা খুশি। তারা যা চায়, তাই পায়। আর যা পায় না, তা চায় না। তারা প্রত্যেকে স্বচ্ছল, সুরক্ষিত, তারা অসুস্থ হয় না, এমনকি মৃত্যুকে ভয় পায় না। আবেগের তাড়না কিংবা বৃদ্ধাবস্থা কি, তারা জানে না। তাদের বাবা, মা, স্ত্রী, পুত্র, প্রেমিক-প্রেমিকা কিচ্ছু নেই। ফলে সম্পর্কের জটিলতা তাকে কষ্ট দেয় না। তারা এমনভাবে প্রশিক্ষিত যে তাদের যেমন আচরণ করা উচিৎ, এক্কেবারে তেমনই আচরণ করে।” সত্যিই কি আমরা, সাধারণ নাগরিকেরা এমন একটা স্থিতিশীল সমাজের আশা করি না? আমরা এটা চাই না? এই জায়গাতেই একমাত্র গভীরে গিয়ে আমাদের ভাববার আছে।

আমাকে সবচেয়ে ভাবিয়েছে ষোড়শ এবং সপ্তদশ অধ্যায় জুড়ে মুস্তাফা মঁদ এবং বন্য জনের কথোপকথন। আমাকে বারংবার ভাবিয়েছে। এই পর্যায়ে দুই যুযুধান দুই প্রতিস্পর্ধা নিয়ে এসেছে --- নীতিশিক্ষা বনাম শেক্সপীয়র। কিন্তু, অবাক লাগে হাক্সলির চিন্তাধারা। তিনি লিখছেন, “সত্যি কথা বলতে আমরা সকলেই এক একটা বোতলের মধ্যে বাস করি। কেবল আমাদের ক্ষেত্রে বোতলটা অনেক বড়ো। তবে একজন বড়ো বোতলের বাসিন্দাকে ছোট বোতলে ঢাললেই সমস্যা শুরু।” ... সমাজ যেখান থেকে এগিয়ে যেখানে আসছে, দুটোই অন্য কোন সমাজের কিম্বা সময়ের চোখে মন্দ। --- “একদল মানুষের কাছে যা নৈতিক, অন্যদের কাছে তা চূড়ান্ত অনৈতিক হতেই পারে। বেশির ভাগ রীতি নীতিই মানুষ তার সমাজে বেড়ে ওঠার সময় শেখে ও তাকে ধ্রুব সত্য হিসেবে মেনে নিয়ে সারাজীবন অনুসরণ করার চেষ্টা করে। পরবর্তীতে সেগুলোর সমর্থনে তাদের মস্তিষ্ক বিচিত্র যুক্তিরও জন্ম দেয়।” ফলে সমাজের ভিত্তি আসলে কি হয়ে ওঠে? গোষ্ঠীবদ্ধতা, বিশিষ্টতা, স্থিতিশীলতা।

যে কোন সভ্যতারই বিধিনিষেধ আছে। ফলে বন্য জন যেমন বন্য সমাজে অগ্রহনীয় হয়, তেমন তথাকথিত সভ্য সমাজেও একটা কৌতুহল ছাড়া আর কিছুই হয়ে উঠতে পারে না। জন কোন সমাজেই টিকতে পারে না। ‘স্বাধীনতা’ নামক শব্দটি যে কোন সমাজের পক্ষেই অচল, এমনকি ভগবানের পক্ষেও। স্বাধীনতা চায় বলেই মানুষ একা হয়। স্বাধীনতা পায় বলেই মানুষ নতুন করে পরাধীন সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা ভাবতে পারে। কিন্তু অবশেষে সেই সমাজের মধ্যে থেকেও আরেকজন মানুষ গলা তুলে বলে ওঠে ---

“এই সভ্যতা হজম করতে পারি নি --- I ate civilization. … It poisoned me; I was defiled.

==================

Brave New World

Aldous Huxley

Vintage Classics

Price: 499

---

ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড

ভাষান্তরঃ সায়ক দত্ত চৌধুরী

কল্পবিশ্ব পাবলিকেশান

মুদ্রিত মূল্যঃ ৪০০ টাকা

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা 

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে