মামলা লিগাল হ্যায়


 

এই সিরিজটা দেখা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও একটাই দৃশ্য বারংবার চোখের সামনে ভেসে আসছে। একটি দৃশ্যে তনভী আজমী আর রবি কিষেণ বসে আছেন আদালতে। আদালতে তখন বিচার চলছে। এই সিরিজে তনভী আজমী বিচারক। তনভী আজমী রবি কিষেণকে নিয়ে এসেছেন একটাই মর্ম বোঝাতে, কেন রবি কিষেণের জাজের পদ গ্রহণ করা প্রয়োজন, কারণ, রবি কিষেণ বিচারক হওয়ার থেকে অ্যাডভোকেট থেকে যাওয়াটা বেশি প্রয়োজনীয় মনে করেছিল।

তনভী আজমী বলছেন, একবার অ্যাডভোকেটদের দেখো, পুরো কেসটায় তারা জাজের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারা চায় জিততে। কিন্তু একবার আসামীর দিকে তাকিয়ে দেখো। তার একটাই মিনতি, সে যেন তার প্রার্থিত সঠিক বিচার পায়। সেই বিচারের জন্য সে বিচারকের কাছেই নীরব মিনতি করে। বিচারক তার রায় জানানোর পরে একবার তার চোখে চোখ রাখে। প্রার্থিত বিচার সত্যে অটুট থাকলে তাদের দৃষ্টি বিনিময়ে যে মহান মুহূর্ত তৈরী হয়, সেই মুহূর্তই সভ্যতার, মানবিকতার চরম মুহূর্ত।

আমরা, ভারতীয়রা, সেই চরম মুহূর্তকে বড্ডো বিশ্বাস করি। আমরা বিশ্বাস করি গণতন্ত্রে। আমরা, প্রত্যেকটা মানুষ বিশ্বাস করি ন্যায় বিচারের। নচেৎ, রাজতন্ত্র কিম্বা একনায়কতন্ত্রে কোন একটা দেশে যে কি হাল হতে পারে, তার অনেক উদাহরণ এই মুহূর্তেই বিশ্বের অনেক প্রান্তে আছে।

আমরা বিশ্বাস করি সংবিধানকে আর তাই, আমরা ‘জাস্টিস’ চাই।

আমাদের, সাধারণ মানুষের, সবচেয়ে বড়ো সমস্যা ‘আবেগ’। জাস্টিস আবেগের বাইরে। সে তথ্যপ্রমাণ হাতে না এলে কিছু করতে পারে না। মামলা লিগাল হ্যায় সিনেমার ক্ষেত্রে এমন উদাহরণ এসেছে। অ্যাডভোকেটের অদ্ভুত সব কথার মারপ্যাঁচে দোষী ছাড়া পেয়ে গেছে। বিচারক সব জেনে-বুঝেও কিছু করতে পারে নি।

এ কি অন্যায়?

বলা ভারি শক্ত।

কারণ, আমরা কখনও ওই বিচারকের আসনে বসি নি। আমরা নিজেরা কল্পিত বিচারক সেজে কল্পিত কোর্টরুম বানিয়ে কল্পিত আসামীকে চরম শাস্তি দিয়েছি। সেখানে কতটা জাস্টিস আছে, আর কতটা নিজেদের অতীতে ঘটে যাওয়া অসন্মানীয় ঘটনার সুপ্ত রাগের বহিঃপ্রকাশ আছে আমরা তা খুঁজেও দেখি না।

সেই সময়ে আমরা আমাদের গলা তুলতে পারি নি। আজ, যখন, হয়তো, অনুরূপ কোন ঘটনায়, তা হয়তো সেই অতীত ঘটনার থেকেও অনেক মারাত্মক, জঘন্য, তখন আমরা মুখ খুলি। কারণ আমরা জানি, এটাই সেই সময়। মোক্ষম সময়। এখন আমাদের দল ভারী। এখনই হল গর্জে ওঠার সময়। সমবেত প্রতিবাদে প্রাপ্ত জাস্টিস, আমারও জাস্টিস। যখন আমি জানি আমি একা নই, তখন সত্যের সঙ্গ দেওয়া আমার পক্ষে সহজ হয়ে পড়ে। তখন আমি নিজের সাথে সাথে সমাজ পরিবর্তনের জন্য পথে নামি।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজ আমার গলা টিপে ধরতে পারে, কিন্তু আমার বিবেকবোধের গলা টিপে বেশিদিন ধরে রাখতে পারে কোন সমাজ?

লক্ষ গর্জনের মধ্যে আমার গর্জনও সত্যের দাবী জানায়। সে কার জাস্টিস চাইছে? বর্তমান ঘটনার জাস্টিস, না কি তার সাথে ঘটে যাওয়া অতীত ঘটনার জাস্টিস? না কি দুটোই?

জাস্টিস যদি তৎক্ষণাৎ আশা করি আমরা, তাহলে বুঝতে হবে সেখানে আমরা জাস্টিস চাইছিই না। আমরা চাইছি একটা কল্পিত আসামীর অমোঘ শাস্তি। গাড়ীতে পকেটমার বা চোর ধরা পড়লে যারা পেটায় তাদের বেশিরভাগই হয়তো তাদের ব্যক্তিগত ক্ষোভ প্রকাশ করে শাস্তির পরিভাষায়, আজ এ নির্মম সত্য। ‘মুন্নাভাই এম বি বি এস’-এর শুরুতেই সুনীল দত্ত পকেটমার নওয়াজদ্দিন সিদ্দিকীকে সেই কথাই বোঝাচ্ছেন। আমাদের মনে আছে সেই কথাগুলো?

এতএব, জাস্টিস আসুক। প্রথাগত পথে। তথ্যপ্রমাণ সমেত। আসামীর কঠোর শাস্তি হোক। প্রথাগত পথে। যেন বিচারক রায় দেওয়ার পূর্বে কখনও যেন এমন ভাবনা না ভাবেন যে, তিনি বাধ্য হচ্ছেন এমন দন্ড দিতে যে দন্ড সঠিক নয়।

হয়তো কয়েক বছর পর যদি প্রমাণীত হয়, শাস্তি সঠিক মানুষের কিম্বা সঠিক উচ্চতায় হয় নি, তখন নিজেদেরকেও কি দায়ী করব না? সত্য অপেক্ষা করতে পারে, আমরা যদি সত্যকে চেয়ে থাকি, আমরা কেন অপেক্ষা করব না?

তবে বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা না রেখে নিজেরাই বিচারক হয়ে গেলে সমস্যা একটাই, কয়েকটা মাত্র তথ্য, তাও তা কতটা কল্পিত আর কতটা সত্য জানা নেই, তার ওপর ভিত্তি করে আমি যখন বিচারক, তখন আর যাই হোক, সংবিধান মেনে যে বিচার করতে পারব না, এ যেমন সত্যি, প্রকৃত বিচারও যে করতে পারব না, এও ততটাই সত্যি। আবেগ বড়ো বালাই। তার কোন সময়জ্ঞান নেই। তার সবকিছুই এখনই চাই।

‘মামলা লিগাল হ্যায়’ আপাদমস্তক একটা হাসির গল্প। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হাসতে হাসতে আমার সত্যিই পেট ব্যাথা হয়ে যাওয়ার জোগাড়। OTT Platform অভিনেতাদের এবং অন্যান্য কলাকুশলীদের জন্য যে স্বাধীনতা এনে দিয়েছে তাতে অবাক হয়ে যেতে হয়। রবি কিষেণ, তনভী আজমী, নাইলা গ্রেওয়াল, ব্রিজেন্দ্র কলা --- প্রত্যেকে কি অসামান্য অভিনয় করেছেন।।

কিন্তু এই সিরিজে, আলাদা করে মনে দাগ কেটে গেল নিধি বিস্তের অভিনয়।

এত কিছুর পরেও কিন্তু ওই কথাগুলো আমার মন থেকে বেরোচ্ছে না। আর আমি তাই বিচারকের দিকে তাকিয়ে থাকি। বিচারের দিকে তাকিয়ে থাকি। বিচারপদ্ধতির স্বচ্ছতার দিকে তাকিয়ে থাকি। অনন্তকাল থাকতে রাজী। কিন্তু আমি, সঠিক বিচার চাই।

যেমনটা চাইতেন, মহাত্মা গান্ধী।

==================

Maamla Legal Hai

Netflix

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে