তিলোত্তমা

 


আগের পোস্টে লিখেছিলাম, বিষন্ন লাগছে। আজও আমার সেই বিষন্নতা কাটে নি। কেন কাটে নি? এক এক করে গোছানো যাক ---

১) মেয়েরা নিরাপদ নয়। শক্তিশালী আইন তাদের পক্ষে যাওয়ার পরেও নয়। কথাটা আমার কাছে ইদানীং আংশিক সত্য লাগে। এলিট কিম্বা মধ্যবিত্ত লেভেলে যেভাবে পুরুষদের প্রতি অন্যায় সুবিধা মেয়েরা নিচ্ছেন, তাতে করে বলাই যায়, 'নিরাপদ' শব্দটা আপেক্ষিক। কিন্তু তবুও, সংখ্যাটা এতই বেশি যে, মেয়েদের সুরক্ষার জন্যে পথে নামাটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল। অন্তত একটা বড়ো মাপের আন্দোলনের প্রয়োজন ছিল। তা ঘটেছে। সেই আন্দোলনের ঢেউ কলকাতার রাস্তা থেকে বাংলাদেশ হয়ে লন্ডনে গিয়ে আছড়ে পড়েছে। আমি বিস্মিত, আনন্দিত, অভিভূত। মেয়েদের অধিকার আমরা মেয়েরা অর্জন করে নেব, নিজেদের ক্ষমতায়, এ আমি মনেপ্রাণে চাই।

কিন্তু, বড়ো ধীরে আমরা এগোচ্ছি। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে যেন, সময় বড়ো কম। এখনই যদি না তেড়েফুড়ে ওঠা যায়, তাহলে আর কখনই নয়। সেটা হবে কি? না কি, এক রাতের পথ দখলের পর আমরা আবার ফিরে যাবো আমাদের ড্রয়িংরুম ড্রামা-তে। অবস্থা কিন্তু সেদিকেই এগোচ্ছে। একমাস পরে এটা আর ঐতিহাসিক ঘটনা থাকবে না। ব্যর্থতার কারণ জানতে চেয়ে স্কুলে ইতিহাসে প্রশ্নও আসতে পারে। তখন আমরা এর কি উত্তর দেব?

আমি উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না।

 

২) যারা তিলোত্তমার জন্য পথে নেমেছেন, তাদের অনেকের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। আমি সোশাল মিডিয়ায় চোখ রেখেছিলাম। আমি টিভিতে চোখ রেখেছিলাম। আমি খবরের কাগজে চোখ রেখেছিলাম। এছাড়াও আশেপাশের আলোচনাতেও কান দিয়েছিলাম।

আর আমি দেখলাম গুজব, কদর্যভাবে অপরকে প্রত্যাঘাত, জোর করে মেরুকরণের এক অদ্ভুত সমীকরণ। এবং স্রোতের উল্টোদিকে কেউ হাটতে চাইলে তাকে কি কুৎসিতভাবে আক্রমণ। যেন, চিন্তার কোনরকম কোন প্রতিঘাত থাকবে না। প্রতিচিন্তা থাকতে নেই। দেখলাম অন্ধ আবেগ কীভাবে আমাদের চালিত করে। কীভাবে আমাদের মস্তিষ্ককে অচল করে দেয়। এবং কুৎসিত ব্যক্তি আক্রমণ কি কদর্য পর্যায়ে চলে যেতে পারে। এখানে সাধারণ মানুষ সাধারণ মানুষকে কি বীভৎস ভঙ্গীতে আক্রমণ করছে। ভাষার শালীনতাবোধ এবং মনুষ্যত্ববোধ থেকে সরে গিয়ে সোশাল মিডিয়ায় আমরা মধ্যযুগীয় বর্বরতায় ফিরে গেছি। চেনা মানুষ হঠাৎ করে অচেনা হয়ে গেছে।

আমি এই কদিন সব দেখেশুনে, আরও নিশ্চিত, সোশাল মিডিয়াতে আমার ব্যক্তিগত কোন ছবি পোস্ট করব না। কারো সাথেই ভয়েস মেসেজ কিম্বা ভিডিও কল করব না। কারো সাথে নিজের ব্যক্তিগত / পারিবারিক খেজুরে আলাপ করবই না। কারণ 'বিশ্বাস' শব্দটা, 'নির্ভরতা' শব্দটা যে কিভাবে ধূলিসাৎ হতে পারে, তা আরেকবার দেখলাম। গুটিকয়েক বন্ধু, ফেসবুকে আছেন। তারা থাকুন। তাদের ওপর আমার ভরসা। তাদের সাথে কথা বলেই আমার আরাম। না হলে পৃথিবীতে বেঁচে থাকারই কোন মানে হয় না। এইটুকুই যা প্রাপ্তি আমার এখান থেকে।

 

৩) মিডিয়ায় অনেক আন্দোলনকারী জনৈক অভিনেত্রীর শঙ্খে ফুঁ দেওয়া নিয়ে ব্যঙ্গ করছেন; একজন লেখিকার বক্তব্য নিয়ে কুৎসিতভাবে তাকে হেয় করা হচ্ছে; অনেকে বিজ্ঞজনেরা কেন পথে নামেন নি তা নিয়ে ব্যঙ্গ করছেন; অনেকে আন্দোলনে যে নেমেছেন তার ছবি দিয়ে ইতিহাসে সামিল হওয়ার বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন। আর যারা চুপ আছেন, তাদের বিরুদ্ধে 'জেহাদ' ঘোষণা করেছেন। মজার ব্যাপার, একটু ভালো করে দেখলে বোঝা যাবে, অনেক ক্ষেত্রে নারীর শালীনতা রক্ষা নিয়ে আসরে নেমে আমরা সেই নারীদের সাথেই অশালীন আচরণ করছি বক্তব্যে, পরোক্ষে! অনেক ক্ষেত্রে নারীরাই দায়িত্ব নিয়ে এই কাজটা করছি। এটাও বোধহয় যে একরকমের শ্লীলতাহানি সেটা আমরা ভাবতেই পারি না।

আমার প্রশ্ন হল, কেন?

তাদের এ কাজের মূল লক্ষ্য তিলোত্তমার 'জাস্টিস' নয়। মূল লক্ষ্য নিজেদের 'কোয়ালিটি' সময় একটু অন্যভাবে কাটানো। এনারা খানিকটা ভেড়ার পালের মতো। যেদিকে স্রোত, সেদিকে এনারা থাকেন। ফলে আন্দোলনের মূল লক্ষ্য নিয়ে এনারা ততটা ভাবেন না, যতটা নিজেদের 'এক্টিভিটি' নিয়ে ভাবেন। আর ভাবেন বলেই খুঁটিনাটি দোষত্রুটি নিয়ে এনারা ঝাঁপিয়ে পড়েন। ব্যঙ্গ করেন। আর ভাবেন, অনেক রাজা-উজির মারলাম। হয়তো অনেকেই স্ক্রীণশট রেখে দেবেন, পরের প্রজন্মকে দেখানোর জন্য, তারা কত মহান কাজ করেছিলেন! এক্ষেত্রে নারী-পুরুষ এদের কাছে সব সমান। আর তাই, আমার আশঙ্কা, এই গণ-উত্থান গণ-হিস্টিরিয়াতে পরিণত হয়ে একদিন অন্য বিষয়ে মোড় নেবে।

মজার ব্যাপার সোশাল মিডিয়ায় এত কিছু হয়ে যাচ্ছে, অথচ চায়ের আড্ডায়, পথে-ঘাটে  বাজারে-শপিং মলে কিম্বা ঘরোয়া আড্ডায় মানুষের মধ্যে তেমন স্বতঃস্ফুর্ত উত্তেজনা দেখছি না। অন্তত মধ্যরাতের পথ দখলের পর থেকে তো আরও নয়। তারা এ ব্যাপারে একরকম উদাসীনই বলতে হবে। অথচ, ভারত-পাকিস্থান খেলা থাকলে ঘটনা ঠিক উলটো ঘটে, এমনটাই দেখতে অভ্যস্ত আমি। এবং, অথচ, সোশাল মিডিয়ায় সক্রিয়তার ঢেউয়ে আমি ভেসে যাচ্ছি।

আর তাই, আমার মনে হয়, অনেক দূরের ঘটনা বলেই হয়তো রিঅ্যাক্ট করা এত সহজ। কারণ, এনাদের অধিকাংশই পাশের বাড়ীতে হওয়া অত্যাচার চোখ বুজে উড়িয়ে দেন। সেখানে নাক গলানোর সাহস দেখাতে যান না। কারণ, সেখানে কোন ভেড়ার পাল নেই। সে সময়ে তারা হঠাৎ করে রামকৃষ্ণ পরমহংস বনে যান। হাতে করতাল নিয়ে বেতালে কীর্তন করতে শুরু করেন।

 

 

৪) অনেকে তিলোত্তমার ছবিসমেত গদোগদো পোস্ট দিচ্ছেন। কবিতা দিচ্ছেন। গদ্য লিখছেন। অনেকে তা শেয়ার করছেন। তিলোত্তমার মায়ের জন্যে, তিলোত্তমার জন্যে দুঃখে তাদের কতটা বুক ফেটে যাচ্ছে, তা ইনিয়ে বিনিয়ে লিখছেন। অনেকে সেই পোস্ট লাইক করছেন, কমেন্টস করছেন।

বুদ্ধিমানেরা বলেন, ছোটদের হাতে ফোন দেওয়া উচিৎ নয়। আমি বলি, এদের হাত থেকে আগে ফোন কেড়ে নেওয়া উচিৎ। এই গণ্ডমুর্খেরা জানেন না, যে, এরকম ঘটনায় মৃতার ছবি দেওয়া আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। মানবিক দিক থেকেও অনুচিত বটে। এনারা দিচ্ছেন। কেন? কারণ, আসলেই তিলোত্তমা এদের লক্ষ্য নয়। সোশাল মিডিয়ায় নিজেদের দেখানোটা লক্ষ্য। এনারা এইসব পোস্ট করে নিজেদের সেলেব্রিটি ভাবছেন এখন। এইসব সোশাল মিডিয়ার অধিবাসীরা আমাকে আরও বিষন্ন করে তুলছেন।

 

৫) একটা অডিও সাম্প্রতিক ছড়িয়েছে আগুনের মতো। এই অধিকাংশ এক্টভিস্ট, যারা পথে নেমেছিল, সোশাল মিডিয়ায় কিম্বা রাতের রাস্তায়, তারা, বিশ্বাস করেছেন। সেই ভয়েস সমেত অগ্নিময় সব পোস্ট করেছেন। কিম্বা তা নিয়ে অনেক সুন্দর সুন্দর জ্বালাময়ী 'নিজস্ব বাণী' পোস্ট করেছেন। তারা একবারও ভাবেন নি যে, কথাগুলোর পেছনে সত্যতা আছে কি নেই। থাকলেও কতটা আছে। বাঙালী গুজবে বিশ্বাস করতে কতটা ভালোবাসে, তা নিয়ে এখন আর আমার সন্দেহ নেই।

সোশাল মিডিয়ার এই আদালতের এইসব বিচারকের নববিধান আমাকে বিষন্ন করে তুলেছে।

 

৬) অনেকেই বিচার ব্যবস্থার প্রতি সুনজর দেন না। কিন্তু, ভালো করে দেখতে গেলে, জাস্টিস ব্যাপারটাই কোর্টের আওতায়। আমরা যদি একটু শান্ত থেকে, অযথা হুজুগে কিম্বা আবেগে গা না ভাসিয়ে, ঘটনাটাকে এগোতে দিতাম, কোর্টের ওপর আস্থা রেখে পুলিশকে পুলিশের কাজ করতে দিতাম, সেটা অনেক বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ হত। কিম্বা একটা বড়ো মুক্তমঞ্চে দিনের পর দিন নীরব ধর্ণা, জাস্টিস না পাওয়া পর্যন্ত, যা গান্ধিজী বহুবার করে দেখিয়েছেন, তা করলে, অনেক বেশি এফেক্টিভ হত।

কিন্তু দখলের উত্তেজনায় সেসব ভাববার সময় কোথায়?

বদলে আমি দেখলাম, রাজনৈতিক এবং অরাজনৈতিক দল ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে গেল। আর জি করের প্রতিবাদীদের থেকে সরে গিয়ে প্রতিবাদ যে কোন কোন অদ্ভুত বিষয় নিয়ে উড়তে শুরু করেছে, তার আর থৈ পাওয়া যাচ্ছে না। কত দাবী, কত ষড়যন্ত্র, কত দাবাখেলা চলছে এখন, তার ইয়াত্তা নেই। তিলোত্তমা তার মধ্যে আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে।

তিলোত্তমার জাস্টিসের থেকে শিফট হয়ে আরও কত জাস্টিসের দিকে নজর সরিয়ে দিয়ে একদিন এই জাস্টিসের বড়ো ঢেউ যে কখন সমুদ্রের তটে পড়ে বালির তলে হারিয়ে যাবে, আমরা টেরও পাব না। তখন আমরা হয়তো ডিজে-র গানে কোমর দোলাতে দোলাতে ভাসানে মা দুর্গা-কে ভাসানে নিয়ে যাচ্ছি। আর সেই আওয়াজে কোন বহুতল বাড়ীর ছাদে অন্য কোন তিলোত্তমার আওয়াজ ঢাকা পড়ে যাবে।

মহালয়া আসতে আর বেশি দেরি নেই কিন্তু!

এসব চিন্তা আমায় বিষন্ন করে তুলছে।

 

পরিশেষঃ আরও অনেক কথা বলা যেতে পারত। কিন্তু এখানেই থামি। বড় লেখা পড়ার অভ্যাস আমাদের অনেক আগেই চলে গেছে। তবে, সোশাল মিডিয়ায় অনেকে অনেকের সম্পর্কে মুখ খুলছেন। অনেক তথাকথিত বড়মানুষ সম্পর্কে অনেক মন্তব্য দেখছি। যাদের সম্পর্কে একসময় আমরা গদোগদো ভক্তি করেছি, তাদেরকেই আজকে নিকৃষ্ট ভাষায় আক্রমণ করতে করতে বলছি, আমার তো এনাকে কোনকালেই পছন্দ ছিল না ইত্যাদি...

সব কিছু দেখে-শুনে-পড়ে আমার কেবল রবীন্দ্রনাথের দুটো লাইন মনে পড়ছে,

"আমারো ছিল মনে

কেমনে বেটা পেরেছে সেটা জানতে।"

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে