Angry Young Men

 


দিদি’র বাড়ি কার্যগতিকে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখলাম, ‘আমার বর’(*) নেই। তিনি দিদির সাথে তার ইচ্‌কুল থেকে এখনও ফেরেননি। জামাইবাবু বসেছিল, কিছু একটা দেখছিল বসে বসে। আমাকে দেখেই বলল, এসো আমার হাফ গার্লফ্রেন্ড। অনেকদিন দেখা নেই যে? ‘পথ দখল’ করছিলে বুঝি?

আমি জামাইবাবুর পাশে বসে জিজ্ঞাসা করলাম, খালি বাজে কথা! কুট্টিকে (আমার বর) নিয়ে দিদি আসেনি এখনও?

জামাইবাবু বললেন, না হে। স্কুলে গেছে। আসতে একটু দেরী হবে। ওখানে আজ প্রোগ্রাম হচ্ছে।

জামাইবাবু আমার মাথার তালুতে নিজের হাতের চেটো চেপে ধরল। আমি বললাম, কি হচ্ছে এটা?

দেখছি তোর মাথাটা কত্তো গরম থাকে। হ্যাঁ রে! তোর মাথা কি ঠান্ডা হবে না কখনও? এরকম রুদ্রানীই থাকবি? ফেসবুকে যা লিখছিস, লোকে তো বাড়ি এসে ঠেঙ্গিয়ে যাবে তোকে? একটু শান্ত কবে হবি মা?

জামাইবাবু আমাকে অনেক ছোট্টোবেলা থেকে দেখে আসছে। ফলে তার কাছে আমি এখনও কচি খুকি-ই আছি। মতিগতিতে আমার সাথে তার ছেলের কোন পার্থক্য সে খুঁজে পায় না। তার মতে, আমরা দুটোই সমান লেভেলের গাধা প্রজাতির মনুষ্য। বোধবুদ্ধি কিচ্ছুই হয় নি, কেবল গায়ে-গতরেই বাড়ছি।

আমি বললাম, তাই? তোমার কি মনে হয় যা লিখেছি ভুল লিখেছি?

জামাইবাবু একটু হাসল। বলল, অন্ধকারে হাতাহতি হলে বোঝা বড়ো দুষ্কর কে বন্ধু আর কে শত্রু। আলো না পড়া পর্যন্ত একধারে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করাই ভালো।

ও বাবা! এ যে কাব্যি ঝাড়ে! রবীন্দ্রপ্রভা এমন করে এনার মস্তিষ্কে আছড়ে পড়ল কি করে? আমি একটু অবাক হয়ে তাকালাম তার দিকে। জামাইবাবু বলল, আয় একটা ডকুমেন্টারি দেখি দুজনে। এংরি ইয়ং মেন। ভাবছি তোকে নিয়ে এরকম একটা ডকুমেন্টারি বানাব, এংরি ইয়ং ওম্যান।

জামাইবাবু ডকুমেন্টারিটা চালিয়ে দিল। দেখলাম ডকুমেন্টারিটা সদ্য শুরু হয়েছে। জামাইবাবু গুছিয়ে দেখতে বসেছে দ্বিপ্রাহরিক আহারের পর।

লোকটাকে চিনি না। জামাইবাবু বলল, সেলিম খান। সলমন খানের বাবা। তুই সেলিম-জাভেদের নাম শুনিস নি?

ন্যাঃ...

শোলে, দিওয়ার, ত্রিশূল বা ডন?

নাম শুনেছি, শোলে আর ডন অর্ধেক দেখেছি...

ওদের লেখক হল এরা দুজন, সেলিম খান আর জাভেদ আখতার। ওরাই Angry Young Man হিসাবে অমিতাভ বচ্চনকে পোর্ট্রেট করেছে।

জাভেদ আখতারকে খুব চিনি। কিন্তু সে যে এত বড়ো মাপের ইন্ডাস্ট্রি কাঁপানো লেখক, জানতাম না। আমার কাছে সে কেবল কবিমাত্র। অবাক হলাম, চব্বিশটা সিনেমার মধ্যে বাইশটা সিনেমা হিট! এনারা হিরোর থেকে এক লক্ষ টাকা বেশি পারিশ্রমিক নিতেন একটা পর্যায়ে! এদের পর এমন সুপারহিট লেখক আজও বলিউডে আসে নি, যার নামে টিকিট বিক্রী হতে পারে। “দি গ্রেট সেলিম-জাভেদ”, জামাইবাবু বলল, “শোলে যেদিন টিভিতে দেখায়, রাস্তা ফাঁকা ছিল রে সেদিন। আমার বাবা সারারাত লাইন দিয়ে শোলে দেখেছে।”

আমি কত কম জানি! আসলেই সত্তর-আশির দশক থেকে আমি অনেকটাই দূরে। আর সিনেমায় নায়ককেই লোকে বেশি মনে রাখে। কিন্তু সেলিম-জাভেদের কল্যাণে ভিলেনকে মানুষ মনে রাখতে শুরু করল। গব্বর সিং কিম্বা শাকাল।

সেলিম-জাভেদের সিনেমার একটা পর্যায়ে ‘মা’ বিশাল বড়ো চরিত্র হিসাবে কাজ করেছে। দিওয়ারের সেই বিখ্যাত ডায়লগ দিওয়ার না দেখেও আমি জানি। অমন একটা ‘মা’ চরিত্রের শেডে অমন একটা ডায়ালগ সিনেমাটাকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে যে আজও তার আবেদন অস্বীকার করা যায় না।

সিনেমার ডায়ালগ এমন হিট হতে পারে তা কে জানত? ‘কিতনে আদমী থে’ কিম্বা ‘আজ তো বহোত খুশ হুয়ে তুম’ আমি সিনেমাগুলো না দেখেও জানি, আমার অনেকগুলো মুখস্থও। কিন্তু তার উৎসমুখ সম্পর্কে কে জানে? সত্যিই তো, সিনেমার লেখকদের কে মনে রাখে? কে বলতে পারবে বাহুবলীর লেখক কে? কিম্বা পাঠান-জওয়ানের ডায়ালগ কে লিখেছেন? অধিকাংশই পারবেন না। এটা দুর্ভাগ্য। এটাই সত্যি।

সেলিম-জাভেদের ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ আমাকে ধাক্কা মারে। জাভেদ যখন বলে ওঠেন, আমার হোটেলের ঘরে যখন ট্রলিতে করে ব্রেকফাস্ট আসে আমি তখন নিজেকে জিজ্ঞাসা করি, আমি কি এর যোগ্য? তার চোখ জলে ভিজে আসে। আমার কান্না পায়। উত্তর শুনতে পাই, আমার আজও মনে হয় না আমি এর যোগ্য।

সেলিম যখন বলেন, আমি আট ঘন্টা অপেক্ষা করে বিতাড়িত হই যখন তখন আমার মনে হয় না যে, আমিও একদিন অনেক বড়ো মানুষ হয়ে দেখিয়ে দেবো তোমাকে। বরং আমার মনে হয় আমি যেন কারো সাথে এরকম ব্যবহার না করি। আমার দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ে একটা। বড়ো মানুষ এমনি এমনি বড়ো হয় না।

জাভেদ সাহেবের একটা কথা বড়ো সুন্দর লাগল, অধিকাংশ লেখক ব্যর্থ হয় কেন? জীবনের রাস্তায় চলতে চলতে শ্রান্ত হয়ে পড়ে সে একসময় থেমে যায় বলে। না হলে আরেকটু চললে সে ঠিক তার গন্তব্য পেয়ে যেত। এই চলাটাই সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার। আর বললেন, ক্ষিধে আর ঘুম, এই দুটো মানুষের অনেক বড়ো ব্যাপার। যারা এই দুটোকে স্বেচ্ছায় কিম্বা বাধ্য হয়ে ত্যাগ করতে পারে, তারা কিছু না কিছু করতেই পারে। জাভেদ সাহেব জানলা থেকে আসা বিকালের নরম আলোর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন। আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকি। এক নাস্তিক কবির দিকে তাকিয়ে থাকি, যিনি কি না একসময় গব্বর সিং-এর নৃশংসতার কথা লিখেছেন।

একসময় ডকুমেন্টারি শেষ হয়ে যায়। কিন্তু আমি জাভেদ সাহেবের পড়া কৃষ্ণ চন্দরের কবিতাটা ভুলতে পারি না ---

"अपनी ज़िंदगी में तुमने क्या किया?

किसी से सच्चे दिल से प्यार किया?

किसी दोस्त को नेक सलाह दी?

किसी दुश्मन के बेटे को मोहब्बत की नज़र से देखा?

जहाँ अँधेरा था वहाँ रौशनी की किरण ले गये?

जितनी देर तक जिये, इस जीने का क्या मतलब था?"

 

আর ভুলতে পারি না, কবিতাটা পড়তে পড়তে তার কান্নাটা গলার কাছে দলা পাকিয়ে ওঠার যন্ত্রনাটা, যখন তিনি বলছেন,

 

“किसी दुश्मन के बेटे को मोहब्बत की नज़र से देखा?”

     

আমরা কি পারব? শত্রুপুত্রের দিকে স্নেহভরে তাকানোর উদারতা দেখাতে?

===================

(*) আমার বর আমার দিদির সদ্য ইস্কুলে ভর্তি হওয়া পুত্র। তিনি তার জন্ম থেকেই জানেন আমি তার প্রেয়সী তথা সহধর্মিনী। আমরা দুজনে সুযোগ পেলেই লুকিয়ে চুরিয়ে যেহারে চকোলেট ভক্ষণ করি, তা থেকে আমাদের ‘ধর্ম’ যে এক ও অভিন্ন তা নিয়ে দিদি-জামাইবাবু কারোরই সন্দেহ নেই।

===================

Angry Young Men

Amazon Prime

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে