জলের ওপর পানি

 


“পৃথিবীর পথে এই নিহত ভ্রাতার ভাই আমি। আমাকে কনিষ্ঠের মতো জেনে তবু হৃদয়ে কঠিন হয়ে বধ করে গেল; আমি রক্তাক্ত নদীর কল্লোলের কাছে শুয়ে অগ্রজ প্রতিম বিমূঢ়কে বধ করে ঘুমাতেছি।”

      লিখছেন জীবনানন্দ। এই সেই সময়ের আর্তনাদ, যে সময়ে সবাই সবাইকে আড়চোখে দেখছে। হত্যা তখন বঙ্গজীবনের অঙ্গ। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, রঘুপতির জবানীতে, “পাপপুণ্য কিছু নাই। কে বা ভ্রাতা, কে বা / আত্মপর! কে বলিল হত্যাকাণ্ড পাপ! / এ জগৎ মহা হত্যাশালা।”

      এই হত্যাকান্ড কোন সময়ের? মূলত দুটো সময়ে। সাতচল্লিশ এবং বাহাত্তর। দেশভাগ। একটা পোড়া দগদগে ঘা। ১৯৪৭। ঘায়ের ওপর মাছি। ১৯৭২। জলের ওপর পানি। উপন্যাস। ১৯৬৮ থেকে শুরু। লেখক স্বপ্নময় চক্রবর্তী।

      ফর্মুলা একটাই --- সুনীলের সেই সময়-এর স্টাইল। ঐতিহাসিক এবং কাল্পনিক চরিত্র। ইতিহাস এবং ফিকশান। হাত ধরাধরি করে হেঁটেছে। স্বপ্নময় চক্রবর্তী হাঁটিয়েছেন। বলা হচ্ছে, এই উপন্যাসের উৎসবিন্দু ‘চতুষ্পাঠী’ উপন্যাস। পড়া হয় নি আমার। আমি সরাসরি প্রবেশ করেছি ‘জলের ওপর পানি’-তে। ধারাবাহিকভাবে বেরিয়েছিল একটি পত্রিকাতে। দাবী, তা প্রসংশিতও হয়েছিল। এখন সমস্যা এই, পত্রিকা বেশিরভাগ লোকে কেনে অভ্যাসে। নচেৎ এখনকার বাংলা পত্রিকাতে জাঁক করে বলার মতো কিছু থাকে না। ফলে পত্রিকার মান অনুযায়ী পত্রিকাপক্ষের দাবীতে ধারাবাহিক উপন্যাসকে অনাবশ্যক বর্ধিত কলেবর হতেই হয়। পনেরো দিন অন্তর কিম্বা মাসে একবার দশ মিনিট সময় দিলে খুব একটা গায়ে লাগার কথাও নয়। তেমন করে বোঝাও যায় না। কিন্তু সেই ধারাবাহিক যদি একত্রিত হয়ে নবকলেবরে, কাটছাঁট না করে, আরোও বর্ধিত কলেবরে আসে, সেক্ষেত্রে কিন্তু, উপন্যাস, কখনও কখনও টানাহ্যাচড়ার দূষণে অনেকখনিই ‘বোরিং’ হয়ে ওঠে।

      এখন, মুশকিল এই যে, ‘জলের ওপর পানি’ সাহিত্য অকাদেমী পুরস্কার পেয়েছে। পুরস্কারের সুবিধা এই যে, তা সৃষ্টিকে বিধবা সতী’র সাদা কাপড়ের মতো অমলিন করে দেয় এক ঝটকায়। শুধু তাই নয়, সমীহ আদায় করে নেয়। পাঠকও যখন পড়ে, বিশেষত ‘বোষ্টুম’ পাঠক, সে ধরেই নেয়, লেখাটা খুবই ভালো হয়েছে। তার ভালো না লাগলেও, কিম্বা কিছু কিছু জায়গায় ভালো লাগলেও, সে বেধড়ক নম্র হয়ে বলে, বাঃ! বেশ ভালোই লাগল নভেলটা।

      তাহলে কি এই উপন্যাসটা আমার ভালো লাগে নি? তার উত্তর পরে আসছি। আগে দেখি উইকিপিডিয়া সাহিত্য অকাদেমী পুরস্কারের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কি বলছে? উইকি দেখাচ্ছে --- “পুরস্কারের উদ্দেশ্য হল ভারতীয় লেখার শ্রেষ্ঠত্বকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং প্রচার করা এবং নতুন প্রবণতাগুলিকে স্বীকার করা। ... এই পুরস্কার ভারতীয় সাহিত্য-মণীষার স্বীকৃতি এবং ভারতীয় সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক। ভারতীয় সাহিত্যের নতুন নতুন ধারা ও আন্দোলনকেও এই পুরস্কারগুলি স্বীকৃতি জানায়। এগুলি সমকালীন সাহিত্যরুচির প্রতিফলক এবং এগুলি ভারতীয় বোধের জন্মদাতা।” এখন মনে কতকগুলো প্রশ্ন জাগছে সভাবতই---

১। এই উপন্যাসের ‘নতুন প্রবণতা’ কি আছে?

২। এই স্টাইলের লেখা কি আগে কখনও হয় নি?

৩। এই সময়কালকে নিয়ে কি এমনভাবে আগে কখনও কোনও লেখা হয় নি?

৪। সাহিত্যের নতুন ধারা বা নতুন আন্দোলন এই উপন্যাসে ঠিক কি আছে?

৫। অন্তিম প্রশ্ন --- এই উপন্যাসের পাশাপাশি আমি যদি লেখকের আরেকটি উপন্যাসকে রাখি? --- হলদে গোলাপ। মনে কি হয় না যে, লেখক উপরোক্ত সমস্ত গুণগুলো পরিপূর্ণভাবে উক্ত উপন্যাসে ঢেলে দিয়েছিলেন। সাহিত্য অকাদেমী পুরস্কার কি উক্ত উপন্যাসটির পাওয়া উচিৎ ছিল না? সমগ্র ভারতবর্ষে ওই পর্যায়ের আর ক’টা উপন্যাস আছে?

      জলের ওপর পানি চেনা লেখা। চেনা গল্প। চেনা ইতিহাস। চেনা ইমোশান। চেনা মানবিক জটিলতা। আমি অন্তত নতুনত্ব কিছু খুঁজে পাই নি। বরং, উপন্যাসটি বই আকারে প্রকাশিত হওয়ার সময় কাটছাঁট হওয়া দরকার ছিল। অবশ্য ৪৩২ পৃষ্ঠার সুবিশাল এই উপন্যাস বয়স্ক মানুষদের সময় কাটানোর জন্য এবং অতীতের দুঃখমধুর স্মৃতিচারণের জন্য ঠিকই আছে।

উপরোক্ত প্রশ্নগুলির উত্তর বইয়ের ব্লার্বে লেখক/প্রকাশক দিয়ে দিয়েছেন, যদিও, তা বিতর্কযোগ্য। বিতর্ক একটিই জায়গায়? সত্যিই কি এ ভাব আখ্যান নতুনত্বের দাবী রাখে?

“আমাদের উপমহাদেশের জীবন এলোমেলো করে দেওয়া দেশভাগ এবং পরবর্তী ত্রাণ ও পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার প্রেক্ষিতে লেখা এই উপন্যাসে এসেছে কলোনী জীবনের নিবিষ্ট শব্দচিত্রাবলি। একজন সমাজবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে লেখুক দেখেছেন এবং দেখিয়েছেন জীজিবিষার বহুমুখী প্রবাহ।

এই উপন্যাসে বিশদে এবং বিষাদে বর্ণীত হয়েছে বাংলার নাথ সম্প্রদায়ের ব্যথা, নমঃশূদ্রদের ব্যথা এবং বিহারের ভূমিচ্যুত মুসলমান উদ্বাস্তুদের কথাও যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে।

এই ধারাবিবরণীমূলক কথকতার পরতে পরতে বিছানো রয়েছে ইতিহাস, দর্শন, ধর্মতত্ত্ব। ধর্মের বাহিরের আবরণের কূটকেন্দ্রায়িত অপ্রমেয় অপ্রীতির সযত্ন অনুসন্ধান করেছেন লেখক। প্রবহমান কাহিনি-উপকাহিনির ভিতরে দক্ষ নৈপুণ্যে বুনেছেন অনেক অজানা তথ্য। স্বপ্নময় চক্রবর্তীর অন্যান্য অনেক উপন্যাসের মতোই এটিও তন্নিষ্ঠ গবেষণার ফসল, তবে লেখকের মতে এটি শেষ পর্যন্ত একটি প্রেমের উপন্যাস। আমাদের বিশ্বাস বাংলাসাহিত্যে এটি একটি অবশ্যপাঠ্য হয়ে উঠবে।”

ব্লার্বের বক্তব্যনুসারে, প্রেমের অবশ্যপাঠ্য উপন্যাসের জঙ্গলে আরেকটি উপন্যাস যুক্ত হল। এই অবশ্যপাঠ্য বইটি নিয়ে কিন্তু ইদানীং আর খুব একটা কথা / পোস্ট আমার চোখে পড়ে না।

=======

জলের ওপর পানি

স্বপ্নময় চক্রবর্তী

দে’ক পাবলিশং

মুদ্রিত মূল্যঃ ৫০০ টাকা

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে