দ্য পিরামিড



১লা জুলাই, ইসমাইল কাদারে, মারা গেলেনঅ্যালবানিয়ার লেখক, ফ্রান্সের অভিবাসী। তাঁর মৃত্যুর খবর আমি পাই সোশাল মিডিয়া থেকে। অনেকে বলেন, বিশ্বসাহিত্যে তিনি কাফকা-র সার্থক উত্তরাধিকারি; অনেকে বলেন, আলবেনিয়ার জর্জ অরওয়েল; অনেকে তুলনা করেন মার্কেজ, গোগোল এবং নাগিব মাহফুজের সঙ্গে; অনেকের সিদ্ধান্ত, তাঁর নোবেল পাওয়াটা ছিল সময়ের অপেক্ষামাত্র।

তাঁর আগে তার নাম পর্যন্ত শুনিনি। তাতে আমার কোন দোষ নেই। আমার বয়স আর অনভিজ্ঞতা আমাকে সাহিত্য ক্ষেত্রে অনেক অজ্ঞাত অপরাধের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়ে এসেছে এযাবৎ। এখন ছোট-বড় অনেক প্রকাশক পুস্তক তালিকার ডিজিটাল ভার্সান নিয়ে এসেছেনআমি মাঝে মাঝেই সেখানে চোখ বোলাই। ইসমাইল কাদারে-র নাম নেই। অনুবাদশূন্য লেখকঅথচ বাংলা তর্জমা আমাদের মতো ইংরাজী দুর্বলা অবলার যে কতোটা সহায়ক তা বোঝাই কি করে? এছাড়াও কাদারে-কে নিয়ে কোন লেখা বড়ো বড়ো জনপ্রিয় সোশাল মিডিয়া গ্রুপে কিম্বা ম্যাগাজিনেও চোখে পড়েনি। যারা বিরোধিতা করবেন, তাদের বলি, মহাসমুদ্রের মধ্যে একটা সাবমেরিনের পেরিস্কোপের লেন্স চোখে পড়া সম্ভব কি? না।

এতএব বাংলাদেশের দিকে মুখ ফেরাই। খুঁজে পেতে একটাই উপন্যাস হাতে পেলাম। দ্য পিরামিড। অনুবাদ করেছেন রাফিক হারিরি। অনুবাদের সার্থকতার কথা পরে আসছি। অনেক কিছু বলার আছে অনুবাদ নিয়ে।

গল্পটার সারমর্ম একটাই, ফারাও চিওপস পিরামিড বানাতে চাইলেন। সবচেয়ে উঁচু এই পিরামিড। একে ‘দ্য গ্রেট পিরামিড অফ গিজা’ বলা হয়। পৃথিবীর সবথেকে বৃহত্তম পিরামিড। এই পিরামিড নির্মানের মুল্য চোকাতে হয়েছিল অসংখ্য সাধারণ মানুষকে। মৃত্যু এবং শ্রমের মধ্যে দিয়ে। কীভাবে, সেটারই কথা এই উপন্যাসের মূল উপজীব্য বিষয়। এতএব, এটা একটা ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস।

তাই কি?

গল্প এইটুকু হলে ‘কাফকায়েস্ক’ শব্দের অন্তর্গত গোত্রে নাম নথিভুক্ত করা যায় না। অরওয়েল হওয়ায় যায় না। রাষ্ট্রও লেখককে দেশ থেকে নির্বাসিত করে না। কাদারে নির্বাসিত হয়েছিলেন। আমরা উপন্যাসের হাত ধরে অ্যালবেনিয়ার ইতিহাসের দিকে একটু নজর দেব।

কাদারে-র জন্মভূমি অ্যালবেনিয়ার পরিস্থিতি একটু দেখা যাক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্বাধীন অ্যালবেনিয়ার জন্ম হয়। ক্ষমতায় আসেন এনভার হেক্সা। রাশিয়ার সাথে হাত মেলান। ‘কমিউনিস্ট’ অ্যালবেনিয়া ‘টোটালিটেরিয়ান’ অ্যালবেনিয়া হয়ে যায়। দেশে তাঁর বিরোধীরা আস্তে আস্তে ভ্যানিস হতে শুরু করে। ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, প্রোপাগান্ডা, সিক্রেট পুলিশ, অর্থনৈতিক ক্ষমতাকে নিজের হাতে তুলে নেওয়া, সেন্সরশিপ --- যা যা সম্ভব সবই এর আওতায় চলে আসে। এই টোটালিটেরিয়ান-ই কি পিরামিড? “মহামান্য প্রভু প্রথমত পিরামিড হল একটা ক্ষমতা, একটা ঐশ্বর্য। মহামান্য প্রভু ফারাও এটা আপনার সবচেয়ে বিশ্বস্ত অভিভাবক। আপনার গোপন রক্ষাকর্তা, আপনার সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী। এটা যতো উঁচু হবে ততো আপনার উদ্দেশ্য, মান-মর্যাদা পরিলক্ষিত হবে।” কাদারে ‘অ্যালিগরি’ ব্যবহার করেন। এখানেও অনেক অনেক অ্যালিগরি ব্যবহার করেছেন।

স্বাধীন হওয়ার পর যেকোন দেশের নিজেদের উন্নতি সাধন হওয়াটাই মূল লক্ষ্য হওয়া উচিৎ নয় কি? অবশ্যই। কিন্তু তাতে করে ক্ষমতাকে কেন্দ্রীকরণ করা যায় না। তাকে ছড়িয়ে দিতে হয়। কিন্তু শাষক কি তা চাইবেন? না। এতএব, ক্ষমতাকে একচেটিয়া করার প্রক্রিয়া শুরু হল। এর অমোঘ ফল, জনগনের ওপর রাশ টেনে ধরা। “... এই অতি উৎকর্ষতা, স্বচ্ছলতার কারণে জনগণ অনেক বেশি স্বনির্ভর আর স্বাধীনচেতা হয়ে পড়েছিল। তারা রাজকর্মচারীদের বিরোধিতা শুরু করল, সাথে সাথে ফারাওকেও। আস্তে আস্তে এটা বাড়তে থাকলোদিন যেতে যেতে সবাই বুঝতে পারলো এটা এমন একটা সমস্যা যেটার মুখোমুখি তারা ইতোপূর্বে কখনো হয় নি।” ... “এই সমস্যার একমাত্র সমাধান হচ্ছে রাষ্ট্রের এই উন্নতি, সমৃদ্ধিকে ধ্বংস করে ফেলতে হবে।” ... “মিশরের উচিৎ তার জনসংখ্যার অতিরিক্ত শক্তিটুকু ধ্বংস করে ফেলা। তার উচিৎ কল্পনাতীত এমন বিশাল এক কার্যক্রম হাতে নেওয়া যেখানে অধিকাংশ লোক অংশগ্রহন করবে আর তাতে অবাধ্য জনগনের অতিরিক্ত শক্তিটুকু ব্যয় করা হবে। এক কথায় এমন এক প্রকল্প গ্রহণ করা যায় যার উদ্দেশ্য মুখ্য নয় কিন্তু তাতে শরীর এবং আত্মার ধ্বংস সাধন হবে। আর এটা নতুন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য সমাধান।”

বলা হয়, অ্যালবেনিয়া তথা বিশ্ব স্বৈরতন্ত্রের মুখোশ কাদিরি খুলে দিয়েছিলেন। তাঁর দেশকে বিশ্বের আঙ্গিনায় নিয়ে এসেছিলেন। দেশের সংস্কৃতি, দেশের অনন্যতা। পিরামিড একটা স্বৈরতন্ত্রী রাষ্ট্রযন্ত্রের অহংকার। উপন্যাসের শেষে, দেখা যায়, চিওপসের পুত্র তাঁর নিজের জন্য আবার একটা পিরামিড বানাচ্ছেন। হোক্সার পুত্র ক্ষমতায় আসার পরে তেমন কোন পরিবর্তন এসেছিল কি? না কি শক্তিমত্তার পরিভাষা বদলেছিল মাত্র!

বইটির অনুবাদ করেছেন রাফিক হারিরি। বাংলাদেশের সাহিত্য সমাজের উচিৎ এবার একটা বোর্ড বসানো। কারণ, হাস্যকর অপরিণত অনুবাদের জন্য একটু নজরদারি প্রয়োজন। শুরুতেই এক জায়গায় অনুবাদ হচ্ছে, “তিনি কি এই কিছুদিন আগে মিশরের সবচেয়ে পুরাতন দুটি গির্জা বন্ধ করে দিলেন না?” মিশরের সময়ে গির্জা! মূল লেখাটা আমি দেখতে পাই নি। কি ছিল তাতে? ‘গির্জা’ নয় নিশ্চই। যীশুর জন্মের আগে গির্জা আর রাম জন্মানোর আগে রামায়ণ --- দুটোই একই রকম মহাকাব্যিক চেতনার দ্যোতনা। কাদিরি-র উপন্যাসে তা বড্ড বেমানান।

‘চিরন্তন সংশয়ের শীতকাল’ পর্বটা আমি তিনবার, হ্যাঁ হ্যাঁ, তিনবার পড়ার পরেও বুঝতে পারলাম না, ঠিক কি লেখা আছে এতে। হায়ারোগ্লাফিক লিপিতে থাকলে বোধহয় উদ্ধার করতে পারতাম, কিন্তু এরকম ঝিনচ্যাক হ-য-ব-র-ল বাংলা গুগল ট্রান্সলেটারও করতে পারবে না। AI–কে এখন আর অতটা হতচ্ছেদ্দা করা ঠিক না। একটা প্যারার উদাহরণ দিই---

“পিরামিডের ব্যাপারে সবচেয়ে কৌতুহল কোনটি? যা অনেক এবং অবতল দখল করে নেয়। তদন্তের এক মিনিটকে মনে হয় দুটি মহাকাল। যা সত্যই (সৈনিকদের কবর, হত্যার দৃশ্য ইত্যাদি) এবং অবাস্তব বিষয় আর বলা হয় অসম্ভব মহাকাল (তিনি চেয়েছিলেন শাশুড়ির সহযোগী এবং অন্যান্যদের), নতুন তদন্ত ছিলো অন্যের নয় কিংবা হতে পারে অন্যদের। কিন্তু উভয়টি ঘটে একই সময়ে।” [পৃষ্ঠা ৭৬] অনুবাদক খুব সম্ভবত আপন শশ্রুমাতার সাথে বাকবিতন্ডা করতে করতে অনুবাদ করছিলেন। এখন প্রশ্ন হল, সম্পাদক মহাশয় কি করছিলেন? তিনিও বোধহয় আপন শাশুড়ির সাথে প্রচন্ডালাপ করছিলেন। একেই বলে সমাপতন।

এমন রত্নের আপনারা কি করবেন আপনারাই জানেন। এই একটা পর্ব প্রচন্ড দুর্বোধ্য। বাকিগুলো কিন্তু পড়া যাচ্ছে। যদিও, মাঝে মাঝে, সুমধুর বাক্যবিন্যাস, দাড়ি-কমা’র উলোট চন্ডাল আর শব্দের ব্যবহারের মাধুর্য উপড়িয়ে গোটা উপন্যাসটাকে বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

আমার হয় নি।

=======================================

দ্য পিরামিড

ইসমাঈল কাদরি

অনুবাদকঃ রাফিক হারিরি

রোদেলা প্রকাশনী

মুদ্রিত মূল্যঃ ২৩০/-

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা 

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে