মোজেস

 


আব্রাহামিক রিলিজিয়ানে অন্যতম গুরুত্বপুর্ণ ব্যক্তি সম্ভবত মোসেস। কারণ আব্রাহামের দর্শন থেকে মোট সাতটি ধর্ম সম্প্রদায় উৎপন্ন হয়েছে। তাঁর মধ্যে তিনটি প্রধান --- খ্রীষ্টান, ইহুদী এবং মুসলিম। বাকি চারটে হল বাহাই, সামারিটান, দ্রুজ এবং রাস্তাফারি। প্রধান তিনটে ধর্মের যে মূল ধর্মগ্রন্থ সেখানে মোসেস-এর উল্লেখ আছে, বিস্তারিতভাবে। এর মধ্যে ইহুদী এবং খ্রীষ্টধর্মে মোজেস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

      গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার বড়ো কারণ – The Promise Land. ঈশ্বর আব্রাহামকে কথা দিয়েছিলেন, তাঁর উত্তরপুরুষেরা এই ‘প্রমিস ল্যান্ড’-এর অধিকারী হবে। কিন্তু বাস্তবে, দেখা যায়, প্রায় চারশো বছর ধরে মিশরের অধীনে তাদের ক্রীতদাস থাকতে হয়। এই সময়ে আসেন মোজেস। ঈশ্বরের বার্তাবাহক হয়ে। মিশরের রাজপরিবারে তাঁর বড়ো হয়ে ওঠা, সেখান থেকে পলায়ন, সিনাই পর্বতে ঈশ্বরের মুখোমুখি হওয়া, মিশরে ফিরে এসে ইহুদিদের মিশর থেকে স্বাধীন করা, তারপর এক অজ্ঞাত ক্ষমতা প্রয়োগে রেড সী-র মধ্যে দিয়ে সোজা আবার সিনাই পর্বতে ফিরে আসা। এরপর তিনি আর বেশিদূর এগোতে পারেন নি তাঁর সম্প্রদায়কে নিয়ে। নেবো পর্বতের পাদদেশে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যু অব্যবহিত পূর্বে তিনি দিব্যচক্ষে দেখতে পান তাঁর উত্তরসূরিরা সেই প্রত্যাশিত ভূমিতে পা রাখবে একদিন। ১৯৪৭ সালে, ইজরায়েলের জন্ম, স্বাধীন ইহুদী সম্প্রদায়ের স্বমহিমায় আত্মপ্রতিষ্ঠাআজও তারা বিদ্যমান, নিজস্ব স্বকীয়তায়যদিও মোজেস আর ১৯৪৭-এর মধ্যে অনেক সময়ের ব্যবধান।

কতটা? তা বলা ভারী শক্ত। কারণ মিথ এবং বাস্তব যে ঠিক কোথায় গিয়ে মেশে তা ঐতিহাসিকেরাও বলতে পারেন না। তা বলা যায় না। যদিও অনেকে ধারণা করেন ঘটনা তেরোশো খ্রীষ্টপূর্বাব্দের আশেপাশে ঘটেছিল। মোজেসের প্রভাব প্রধান তিন ধর্মগ্রন্থে এতটাই বেশি যে সেখান থেকেই ধারণা করা যেতে পারে যে, ব্যাক্তি মোজেস সেই সময় কি মারাত্মক প্রভাব রেখে গিয়েছিলেন আপন সম্প্রদায়ের প্রতি।

মোজেস কিংবদন্তী। সেই সাথে মোজেসই প্রথম, যিনি সম্প্রদায়কে একত্র করার উদ্দেশ্যে সমাজ বিধিব্যাবস্থা প্রণালী সৃষ্টি করেন, যে বিষয়ে পরে আসব। তো এই কিংবদন্তী মোজেসের সাথে অনেক সম্ভব-অসম্ভব কাহিনী জুড়ে গেছে। ‘টেস্টামেন্টঃ দ্য স্টোরি অফ মোজেস’ ডকুমেন্টারি আসলে সেই কাহিনীগুলোর মধ্যে থেকে কয়েক শত বছরের ক্রীতদাস এক জাতির স্বাধীনতা লাভের মধ্যেকার যে আকুতির বীজ সুপ্ত আছে, সেগুলোকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করা।

সেগুলোকে খুঁজেছেন যে বিশেজ্ঞরা, তারা ইহুদী, খ্রীষ্টান এবং মুসলিম সম্প্রদায় থেকে এবং তাঁর বাইরে থেকেও, যারা মূলত মোজেস নিয়ে গবেষণা করেছেন --- প্রত্যক্ষ কিম্বা পরোক্ষভাবে। যতটা সম্ভব আনবায়াসড হয়ে মোজেসকে এবং জনসমাজে তাঁর প্রভাবকে বিশ্লেষণ করা যায়, তা করার চেষ্টা করা হয়েছে। সেটা কতটা সার্থক, তা উক্ত সম্প্রদায়ের বিশেষজ্ঞরাই বলতে পারবেন। আমি কেবল এটুকু বলতে পারি, আমি দেখেছি, এবং ডকুমেন্টারির রিপ্রেসেন্টেশানে মুগ্ধ হয়েছি।

মোজেসের পুরো জীবনটার মধ্যে আমি যাচ্ছি না। কারণ, কিংবদন্তিকে নিয়ে আলোচনা করতে গেলে ফ্যাকড়া বেরোবে বেশি। আর আমি ওল্ড টেস্টামেন্ট, হিব্রু বাইবেল কিম্বা কোরাণ পড়ি নি।

এই ডকুমেন্টারির মূল ভিত্তি ওল্ড টেস্টামেন্টের ‘জেনেসিস’ এবং ‘এক্সোডাস’। সেখান থেকে পুরো গল্পটাকে তিন পর্বে সাজানো হয়েছে। বড়ো সুন্দরভাবে তারই মাঝে মাঝে ঘটনা পরম্পরার গুরুত্ব এবং পরবর্তী সময়ে তাঁর প্রভাব নিয়ে আলোচনা। সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে চার ঘন্টার এই ডকুমেন্টারি মোটের ওপর মন্দ নয়। দেখতে ভালো লাগে।

এবার আসি শেষ পর্বে, যেটা আমার ব্যক্তিগত আলোচনার জায়গা, যা এই ডকুমেন্টারির তৃতীয় পর্ব জুড়ে আছে।

মোজেস আমার মনে দাগ কেটেছে ইহুদীদের স্বাধীন করেছিলেন বলে নয়। স্বাধীন ইহুদী জাতির জন্যে একটা বিধিনিষেধ তৈরী করেছিলেন বলে। যা, বলা যেতে পারে, পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন সংবিধান। যা ঈশ্বরের মুখনিঃসৃত, মোজেস দ্বারা লিখিত, পরবর্তীকালে তাঁর উত্তরপুরুষ দ্বারা মানিত। মাত্র দশটি নিয়ম, যা ‘টেন কমান্ডমেন্টস’ নামে বিখ্যাত।

দশটি নিয়ম বা আজ্ঞা হল---

১. তোমার আমার ছাড়া অন্য কোনো ঈশ্বর থাকবে না।

২. তুমি নিজের জন্য কোনো মূর্তি বা প্রতিমা তৈরি করো না।

৩. তুমি তোমার ঈশ্বরের নাম বৃথা উচ্চারণ করবে না।

৪. বিশ্রামবার (শনিবার) মনে রাখবে এবং তা পবিত্র রাখবে।

৫. তোমার পিতা-মাতাকে সম্মান করবে।

৬. তুমি হত্যা করবে না।

৭. তুমি ব্যভিচার করবে না।

৮. তুমি চুরি করবে না।

৯. তুমি তোমার প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দেবে না।

১০. তুমি তোমার প্রতিবেশীর ঘর লোভ করবে না।

আমার কাছে এটা স্পষ্ট যে, এই আদেশগুলি একটি নৈতিক ভিত্তি গঠন করে যা ইতিহাস জুড়ে অনেক আইন ব্যবস্থা ও নৈতিক কাঠামোকে প্রভাবিত করেছে। আমার অবাক লাগে, কয়েক হাজার বছর আগে যে আজ্ঞা বানানো হচ্ছে, তার অধিকাংশই, আজও, যে কোন ধর্মের বুনিয়াদ তো বটেই, বরং প্রকারান্তরে এরই বিস্তারিত প্রয়োগ, বিভিন্ন ক্ষেত্রে। হত্যা না করা, ব্যাভিচার না করা, চুরি না করা, লোভ না করা কিম্বা পিতা-মাতাকে সন্মান করা --- কোন ধর্মে এর উল্টো বলা হয়? কোন ধর্মেই নয়।

ঠিক এইখানেই, ধর্মের উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে যায়। তাঁর উদ্দেশ্য, ‘এক’ করা। একত্র করার চেষ্টা নয়, অধিকার করার চেষ্টা নয়, দখল করার চেষ্টা নয়। কেবল ও কেবলমাত্র এক হওয়া এবং সবকিছুর মধ্যেই সেই এক-কে খুঁজে পাওয়া, যাকে ‘পরম’ বলা যেতে পারে --- এই তো ধর্ম। সেই পরমের নাম দেওয়া হয়, রূপ দেওয়া হয় ---- সে আলাদা ব্যাপার, সে মানুষের সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু উদ্দেশ্য একটাই --- সবই এক --- 'একং সদ্‌ বিপ্রা বহুধা বদন্তি'

=========================

Testament: The Story of Moses

Cast: Avi Azulay, Dominique Tipper, Mehmet Kurtuluş, Ishai Golan, Tülay Günal

OTT Platform: Netflix

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে