দ্য অ্যালকেমিস্ট

 


‘দ্য অ্যালকেমিস্ট’ আমার পড়া প্রথম ইংরাজি উপন্যাস। আমি তখন স্কুলে শাড়ি পরে যাওয়া আরম্ভ করেছি মাত্র। গডব্রাদারের দেওয়া প্রথম ইংরাজী উপন্যাস, পেঙ্গুইনের বই, কলেজ স্ট্রিট থেকে আনানো, মহার্ঘ। আমার সংগ্রহে সেটা আর নেই। কিন্তু এটুকু মনে আছে পচাত্তর পার্সেন্ট বইটার বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারি নি আমি। একটা বড়ো কারণ ভাষা। একটা বড়ো কারণ সেই ভাষায় প্রথম আমি এতোবড়ো একটা উপন্যাস পড়ছি তখন পড়তে সময় লেগেছিল এক মাসের কিছু বেশি। আজ শেষ করতে আমার লাগল মাত্র তিনদিন। যদিও এবার বাংলায়।

      সে সময়ে, বুঝি চাই না বুঝি, আমার মনে একটা দাগ কেটে গিয়েছিল বৈ কি। প্রথম পড়া এবং প্রথম শেষ করতে পারা ইংরাজী উপন্যাস। সেই পারাটা আমার জীবনে একটা ‘অ্যাচিভমেন্ট’ বলা যেতে পারে। আর প্রত্যেকের জীবনে প্রথম শেষ করা বইয়ের স্মৃতি বড়োই মধুর হয়। আপনারা নিজেদের প্রথম শেষ করা বইয়ের কথা ভাবুন। তা সে মাতৃভাষাতেই হোক, কিম্বা অন্য ভাষা।

      তবুও, তার বাইরেও এমন একটা কিছু ছিল, বিষয়বস্তুর মধ্যে, যা আমাকে বার বার বইটার দিকে টেনে আনে। পরবর্তীকালে বেশ কয়েকবার বিচ্ছিন্নভাবে বইটা পড়লেও, বাংলা অনুবাদ যখন সহজলভ্য হয়ে উঠল, তখন না কিনে পারলাম না। আমাজন আমাদের মতো পাঠকদের একটা বড়ো ভরসা।

      দুইদিনে আবার শেষ করলাম এই উপন্যাসটা। অনুবাদ মারাত্মক রকমের ভালো। রাজা ভট্টাচার্যের অনুবাদ। সার্থক অনুবাদ।

      কেন এই বইটা আমার এত প্রিয়?

      আপনাদের কাছে একটা বিনীত প্রশ্ন, (উত্তর দেওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই), কতজন আমরা আমাদের স্বপ্নের কাছে ফিরে আসি? সেই স্বপ্ন, যে স্বপ্ন আমরা আমাদের যৌবন কিম্বা কৈশোরবেলায় দেখেছিলাম? “তুমি তোমার ভাগ্যকে সত্যে পরিণত করতে চাইছ। আর এখন তুমি ঠিক সেইখানে দাঁড়িয়েছ যেখানে দাঁড়িয়ে মানুষ হাল ছেড়ে দেওয়ার উপক্রম করে।” বৃদ্ধ রাজা বলছেন বালককে। আমরাও কি সেই পর্যায়ে কখনও আসি নি? এবং তারপর পিছিয়ে যাই নি? অনেকেই সেই স্বপ্নকে একটা ছোট্ট কৌটোতে বন্দী করে বুকের মধ্যে রেখে দিয়েছি, আর তাকে খুলি নি। কিম্বা খুললেও তাকে আর সত্য করার সাহস দেখাতে পারি নি। একটু দেখে আবার বন্ধ করে দিয়েছি। এবং আমরা একদিন আবিস্কার করেছি, স্বপ্নপুরণের আশাটুকুই আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। “কারণ ... আশাটুকুই আমাকে বাঁচিয়ে রাখে। সেটাই আমার বৈচিত্র্যহীন দিনগুলোর মুখোমুখি হওয়ার শক্তি যোগায়; সার দেওয়া এইসব মূক স্ফটিক, একই জঘন্য কাফেতে দুপুরে আর রাত্রে খাওয়া! আমার ভয় হয়, যদি কখনো আমার স্বপ্ন পূর্ণ হয়ে যায় আমার বোধহয় বেঁচে থাকার কোনো কারণ থাকবে না।” দোকানী বলছে ছেলেটিকে।

      পাওলো কোয়েলহোর ‘দ্য অ্যালকেমিস্ট’ সেই স্বপ্নপূরণের গল্প। লেখকের মতে, “নিজের নিয়তিকে উপলব্ধি করা একজন ব্যক্তির অবশ্য কর্তব্য।” কারণ, “যখন তুমি অন্তর থেকে কিছু প্রার্থনা করো, সমস্ত বিশ্ব চেষ্টা করে, সেটা তোমার হাতে তুলে দেওয়ার জন্য।”

      আমরা কতটুকু প্রার্থনা করি? অ্যালকেমিস্ট বলছে, সবকিছুই লেখা আছে, এও আরেক পথ - ‘মক্তুব’। হতাশা আর আশার মাঝের এক জীয়নকাঠি।

      কিন্তু কেউ যদি কারোর জন্য নিজের স্বপ্নকে বিসর্জন দেয়? যেমনটা দিতে চেয়েছিল সান্তিয়াগো, ফাতিমার জন্য? আমার মনে হয় ‘দ্য অ্যালকেমিস্ট’-এর সবচেয়ে মায়াভরা ভারকেন্দ্র ঠিক এই জায়গাটাতেই এসে দাঁড়িয়েছে। অ্যালকেমিস্ট সান্তিয়াগোকে বলে, দুই পৃষ্ঠা জুড়ে যার কথন, সংক্ষেপ করলে দাঁড়ায় (আমি বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতে যদি দেখি তাহলে ব্যাপারটা অনেকটা এরকম দাঁড়াবে)---

প্রথম বছরে সম্পদ এবং সুখ সুটোই করতলগত হবে। নিজে যে অবস্থানে আছো তাকে ভালোবাসতে শিখবে। একজন স্কিলড্‌ এবং প্রফেশনাল পার্সেন হিসাবে সুনাম হবে। দ্বিতীয় বছরে মনে হবে স্বপ্নের কথা। যা গুপ্ত ও সুপ্ত আছে হৃদয়ে। তাকে বার বার আস্বীকার করে তোমার এই অবস্থানে তুমি টিকে থাকতে চাইবে। তোমার খ্যাতি আরও বাড়বে। কর্মক্ষেত্রে তোমার ওপর নির্ভরশীলতা আরও বেড়ে উঠবে। তুমি সৌভাগ্যশালী হবে। তৃতীয় বছরে তোমার হৃদয় বারবার বলে বেড়াবে তোমার স্বপ্নগুলোর কথা। প্রেয়সীর সাথে কোথাও একটা দূরত্ব বাড়বে। কাছের মানুষ কোথাও যেন দূরের মানুষ হয়ে যাবে। তারা দুঃখ পাবে। তবুও ভালবাসা থাকবে। অস্তিত্ব থাকবে, কিন্তু ব্যক্তিত্ব থাকবে না। মনে হবে, স্বপ্নটাকে পূরন করতে পারলেই যেন কোথাও ভাল হত। চতুর্থ বছরে, কাজের জগতে আস্তে আস্তে আশেপাশে আরও অনেক স্কিলফুল নতুন নতুন লোকের আবির্ভাব ঘটবে। এবং তুমি আস্তে আস্তে নিজেকে আপগ্রেড করতে না পারলে দেখবে, পিছিয়ে যাচ্ছ। আস্তে আস্তে তুমি স্থৈর্য, ধৈর্য - হারাতে থাকবে, তোমার ক্ষমতা কমতে থাকবে। যদিও অভিজ্ঞতার নিরিখে তখনও তোমার মূল্য অপরিসীম। “জীবনের বাকি দিনগুলো তুমি কাটিয়ে দেবে এই কথা জেনে - তুমি তোমার নিয়তিকে অনুসরণ করনি, আর এখন বড্ড দেরী হয়ে গেছে।”

জীবনের এই চারটে পরাজয়ের পর্যায়, আমি আমার মতো করে আবিস্কার করেছি, পাওলো কোয়েলহোর ‘দ্যা অ্যালকেমিস্ট’-র হাত ধরে। আমি স্বপ্ন দেখি। আমার স্বপ্ন আস্তে আস্তে দূরে সরে যাচ্ছে। তবুও স্বপ্নকে মরতে দিই না। আমি প্রতিদিন লড়াই করে চলি। আমাকে আমার স্বপ্নকে উদ্ধার করতেই হবে। আমার নিয়তিকে আমি মরতে দিতে চাই না। আমি আর আমার নিয়তির মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে একমাত্র আমার ইচ্ছাশক্তি।

বেশ কিছু দর্শন এই বইটার মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এ পাওলো কোয়েলহো-র দর্শন নয়। বিভিন্ন ধর্ম ও দর্শনকে তিনি যেভাবে উপলব্ধি করেছেন তারই এক ককটেল ---

এক, প্রত্যেক মানুষের পথ ভিন্ন এবং তাকে আবিস্কার করাই তার একমাত্র উদ্দেশ্য। দুই, বিশ্বের একটা ভাষা আছে, যা ‘ইউনিভার্সাল’। তাকে আবিস্কার করা। মন তখন গুরু হয়, তখন পথ চলা সহজ হয়। তিন, লক্ষ্মণ বা ‘ওমেন’। জীবন বারংবার আমাদের স্বপ্নপূরণের জন্য লক্ষ্মণ বা সুযোগ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখে। আমরা তাকে দেখতে পাই না, কিম্বা দেখলেও এড়িয়ে যাই। চার, ব্রহ্মান্ডে এক বিশ্বাত্মা আছেন, তাকে অনুভব করা, কারণ সকল কিছুর সাথে তিনি যুক্ত। তাকে জানতে পারলে সবকিছুই জানা হয়ে যায়। আর তখন কোন ভয় থাকে না। পথ তখন সচল, আপন ছন্দে, আপন গতিতে। পাঁচ, স্বপ্নসন্ধানীর সৌভাগ্যের অতীব প্রয়োজন, যাকে বলা যেতে পারে Beginners’ Luck --- তা যদি সহায় হয় তখন এগোনো আরও সহজ হয়ে যায়। তা আসে, কেবল আমরা তাকে কজে লাগাতে পারছি কি না এটাই বড়ো কথা। ছয়, অধ্যবসায়। পরবর্তী ধাপ। যেখানে জীবন পরীক্ষা নেয়। অধ্যবসায় আমাদের একমাত্র অন্ধকারের যষ্ঠি। হিন্দুশাস্ত্রে তাকে বলে সাধনা। এবং সাত, নিজের হৃদয়ের কথা শোনা। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়া। তবেই এ পথের শেষে উপলব্ধি মিলবে। মিলবে পিরামিড। মিলবে গুপ্তধন। স্বপ্ন সফল হবে। যেমনটা হয়েছিল ছেলেটার, সান্তিয়াগো যার নাম।

পাওলো কোয়েলহো এই বই মাত্র দুই দিনে লিখে শেষ করেছিলেন। শুরুর বেশ কয়েকটা বছর তার এই বই বিক্রী হয়নি। আর আজ, বইটা সারা বিশ্বে এখনও আলোড়ন ফেলে যাচ্ছে। ‘দ্য অ্যালকেমিস্ট’ আমার জীবনের এমন এক বন্ধু, আমি জানি, যে আমাকে বারবার আশা যুগিয়ে যাবে। রুপকথা ধরলে রূপকথা, কল্পগল্প বললে কল্পগল্প। কিন্তু কল্পগল্পের মধ্যে এমন একটা সত্যি লুকিয়ে আছে, যা আশাহতদের এখনও আশাবাদী করে তুলতে পারে। আর যারা আশা নিয়ে এগোতে চাইছেন, তাদের কাঁধে বন্ধুর মতো হাত রাখতে পারে।

=====================

দ্য অ্যালকেমিস্ট

পাওলো কোয়েলহো

অনুবাদকঃ রাজা ভট্টাচার্য

মঞ্জুল পাবলিকেশান

মুদ্রিত মূল্যঃ ৩৫০/-

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে