গণেশ হালুই ও পূজাবার্ষিকী
প্রত্যাশামতোই
আনন্দবাজার পত্রিকার পূজাবার্ষিকী সংখ্যা আত্মপ্রকাশ করেছে। তারা শ্রাবণ মাস
পর্যন্ত অপেক্ষা করে নি, মড়া আষাঢ়েই হয়েছে প্রকাশ, এবং গতবারের মতো, এবারেও
প্রচ্ছদ বিতর্কে গত দুই দিন ধরে ফেসবুকে চোখ রাখা দায়। প্রসঙ্গত গতবারের ‘দেশ’
পত্রিকায় শ্রদ্ধেয় রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দুর্গা’ যথেষ্ট আলোড়ন তুলেছিল, আমার
বিশ্বাস, তা পত্রিকার বিক্রীটাকে বাড়িয়ে দেয়। এবং আমার আরও বিশ্বাস, এবারে
আনন্দবাজার পত্রিকার পালা। কারণ, আনন্দবাজার পত্রিকা’র সে জৌলুস বহু বছর আগেই
অস্তাচলে।
এবং এবারের
পালা শ্রদ্ধেয় গণেশ হালুই-এর।
এই ছবি নিয়েও
দুই ভাগ হয়ে গেছে। তৃতীয় একটা অদ্ভুত দলকে চোখে পড়ছে, তাদের কথা পরে আসছি।
প্রথম ভাগ,
অবশ্যই ছবির সমর্থনে কথা বলছেন। তাদের বক্তব্য, এই ছবির মাহাত্ম্য অসাধারণ
পর্যায়ের। গণেশ হালুই নিজেই কিংবদন্তী। তিনি দুর্গা-ই বা কেন আঁকবেন? শিল্পে কি
বিদ্রোহ হতে পারে না? নতুনত্ব আসতে পারে না? পূজোসংখ্যায় দুর্গা আঁকাটাকেই কি
মাস্ট করতে হবে? গণেশ হালুই শারদীয়ার বন্দনা করেছেন, নিজের মতো করে, প্রচলিত
প্রথায় নয়, এবং এ এক ধরনের বিদ্রোহ। প্রথাগত শারদ প্রচ্ছদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।
শিল্পীর স্বাধীনতাকে এনারা স্বাগত জানিয়েছেন।
প্রশ্ন হল,
শিল্পী যখন বিদ্রোহী হওয়ার জন্যে একটা বাণিজ্যিক মাধ্যমকে বেছে নেন, যে মাধ্যমের
নিজেরও সমসাময়িক থাকার একটা দায় আছে, তখন, সেখানে, তা কতটা স্বাধীন বিদ্রোহ আর
কতটা সুপরিকল্পিত বিদ্রোহ, তা নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। আমি জানি না, প্রচ্ছদ
নিয়ে পূজাসংখ্যাটির ভেতরে বিস্তারিত কোন লেখা আছে কি না, কিন্তু অতি সাধারণ দর্শকদের
সামনে উচ্চতত্ত্ব নিয়ে এসে, দর্শকদের নিরক্ষর বলে গাল দেওয়াটা এক ধরনের মুর্খামি।
সাধারণ স্কুল-কলেজে শিল্পজগত সম্পর্কে জ্ঞানদান, কোথায় হয় শুনি? আমরা কিভাবে বুঝব
গণেশ হালুইয়ের মাহাত্ম্যকে? যে সমস্ত বোদ্ধারা এই ছবিকে স্বাগত জানিয়েছেন, তাদের
অনেকেই আর্ট সম্পর্কে বিস্তর খবর রাখেন, তারা কি কোনদিন শিল্পকে স্কুলে স্কুলে
নিয়ে যেতে পেরেছেন, বা তার ব্যবস্থা করতে পেরেছেন? তারা কি কোনদিন ছবি সম্পর্কে
আমাদের সম্যক জ্ঞানদান করেছেন? একটা ছবিকে বুঝতে গেলে কতটা অন্তর্দৃষ্টির জাগরণ
ঘটাতে হয়, তা তারা নিজস্ব জীবনসাধনা দিয়ে বুঝেছেন, কিন্তু, তারা কি সেটাকে সাধারণ
মানুষের কাছে, সাধারণ মানুষের ভাষায় নিয়ে আসতে পেরেছেন? গান এবং সাহিত্য যে জায়গায়
বাংলায় এসেছে, সাধারণ মানুষের বোধের মধ্যে, দুঃখের সাথে জানাই, চিত্রকলা কিম্বা ভাষ্কর্য
তার ধারেকাছেও আসতে পারে নি। তাদের অনেকের বক্তব্য, লোকজন এক্সিবিশনে যায় না।
কিন্তু কেউ তো লোকজনের কাছেও যায় না ছবি নিয়ে! নাটক-যাত্রা-সিনেমা-বই-পালাগান-জলসা
যেভাবে সাধারণের কাছে গেছে বা এখনও যাচ্ছে, এক্সিজিবিশান কি সেভাবে মাঠেঘাটে
প্যান্ডেল-ম্যারাপ বেঁধে সাধারণের কাছে এসেছে?
কোনদিনও না।
ফলে সাধারণ মানুষে আর চিত্রকলায় বিস্তর ফারাক। তারা যেটা বোঝেন না সেটাকে বর্জন
করেন।
এখন এই
ছবিটার মানে কি? সে সাধারণ মানুষের বোধগম্যের বাইরে। আমিও বুঝতে পারি নি। হঠাৎ করে
কান্দিনস্কি-কে মনে পড়িয়ে দিয়েছে মাত্র, তাও আমি কান্দিনস্কির ছবি আগে দেখেছি
বলেই। কান্দিনস্কি বা পল ক্লী আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের কাছে ততটা অবগত নয়, যতটা
পাবলো পিকাসো, লেঅনার্দো দ্য ভিঞ্চি। এখন তাই, আমাকে হাত পাততে হচ্ছে অভিজ্ঞের
কাছে। শ্রদ্ধেয় চিত্রকর সনাতন দিন্দা কি লিখেছেন দেখা যাক,
“গণেশ হালুইয়ের
এই প্রচ্ছদে আমি দেখলাম শরতের আকাশের মধ্যে কিছু জিনিস ঘুরে বেড়াচ্ছে। হতেই পারে তা
ঘুড়ি, কিংবা আরও কিছু এলিমেন্ট। সব উপাদান তো খালি চোখে দেখা যায় না এই মেটাযুগে।
শিল্পী তো সেটা দেখবেন, দেখানোর চেষ্টা করবেন আরও মানুষকে। তাঁর ওই দিব্যচক্ষু আছে।
শরতের আকাশ মানেই পেঁজা মেঘ আর পুঞ্জ পুঞ্জ কাশফুল? এছাড়া কি কিছু হয় না শরতের আকাশে?
সারা দুনিয়ায় গণেশ হালুই পরিচিত বিমূর্ত শিল্পী হিসেবেই। তিনি তাঁর মতো করে দেখেছেন
শরতকে। শরতকালে শুধু যে দুর্গাপুজো হয়, তা তো না। এ তো আরেকটা অকালবোধনও হতে পারে।
কোনও শিল্পীকে বুঝতে গেলে, তাঁর ডিসকোর্স বুঝতে হবে। তাঁর যাত্রাপথ না জানলে, তাঁকে
চেনা হয় না। যাপনচিত্র ছাড়া তাঁকে আবিষ্কার করা যান না। আপনারা অবাক হবেন হয়তো, তিনি
যখন প্লেনে চড়েননি, তখন ল্যান্ডস্কেপ করেছেন বার্ডস আই ভিউ থেকে। বাংলার নদী-পথ-ঘাট– জীবনানন্দের কবিতার মতো তো তিনিই দেখিয়েছেন ছবিতে। যা করেছেন,
বেশ করেছেন গণেশ হালুই। এতদিন কিছু করেননি কেন, তাই ভাবছি। তিনি যদি এমনটা করতেন তাহলে
আমরা আরও সাহস পেতাম। আরও ভাঙতাম নিজেকে। সামনে যে ক’টা পুজোবার্ষিকীর প্রচ্ছদ করব, আমি ভাবছি, কোনওভাবেই ত্রিনয়ন
কিংবা দুর্গার মুখ ব্যবহার করব না। শিল্প তো চিন্তার বৃত্তটা বড় করে, শিল্পবিচারের
সময় বৃত্তটা কেন ছোট হতে যাবে?” বোঝবার সুবিধার্থে আরও দুই অভিজ্ঞ
তৌসিফ হক এবং জয়দীপ মুখার্জীর প্রচেষ্টাও যুক্ত করলাম। তাদের মত, এটি একটি নীলকণ্ঠ
পাখী। আমার মনে হয়, সাধারণ দর্শক, যারা হতচ্ছেদ্দা করছি, নিজের সিদ্ধান্তে অন্ধের
মতো আটকে থাকছি, তারা, একটু খোলা চোখে ছবিটাকে বোঝার চেষ্টা করবেন। গণেশ হালুই-এর
মতো চিত্রকর যা খুশি তাই আঁকবেন, এরকম তো হতে পারে না। তার আঁকাটাকে বোঝার জন্যে
নিজেদের একটু পরিশ্রম করতে হবে বৈ কি।
দ্বিতীয়
দলের জন্যে, যেখানে আমিও আছি, মন খারাপ লাগে। তারা নিজেরাও বুঝতে পারেন না যে,
তারা বাণিজ্যিক বিকিকিনির শিকার। এমন ছবির ভেতরে যে বিষয়বস্তু আছে তার প্রায়
এক-দুই দশক ধরে কোন পরিবর্তন নেই, সেখানে মারাত্মক কোন নতুনত্ব নেই। সেখানে বলার
মতো কোন লেখা প্রায় থাকেই না বলতে গেলে। ফলে লেখাগুলোকে নিয়ে তেমন কোন গঠনমূলক
আলোচনাও চোখে পড়ে না। সেখানে সেই সংখ্যা বিকানোর জন্যে তো একটা হল্লা প্রয়োজন। বড়ো
বড়ো প্রকাশনা, কোন বই প্রকাশের আগে অনেক পরিকল্পনা নেয়। দেখা যায়, সেই বাণিজ্যিক
বিপননের সুপরিকল্পিত মোটিভে সাধারণ বই অসাধারণ হয়ে যায়। কিন্তু, সেটা বিপনন কৌশলের
সাফল্য। এখানেই ঘটনা ঠিক একই ঘটানোর চেষ্টা চলছে। আর, নিজেদের ভালো লাগা মন্দ
লাগাকে এতোটা গুরুত্ব দিয়ে খাপ পঞ্চায়েত বসিয়ে ফেললে আখেরে নিজের ক্ষতি, এইটা
বোঝার সময় এসেছে, না হলে বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগের সময়কাল আরও অনেকদিন বাড়বে।
তৃতীয় দলকে,
যাদেরকে আমার এবার চোখে পড়ল, তাদের বক্তব্য, ভারী তো প্রচ্ছদ! প্রচ্ছদের কোন মূল্য
তেমন করে কোনদিনও ছিল না। আসল ব্যাপার কনটেন্টে। যে কারণে পূজাসংখ্যাটা বেরিয়েছে,
সেই সাহিত্যই হল এর মধ্যমণি, এতএব বাকিগুলোকে পাত্তা দেওয়ার কিছু নেই। তাদের প্রতি
কথা দুটো --- এক, আপনার শিল্পের কিস্যু বোঝেন না। সাহিত্যকেও সুন্দরভাবে পরিবেশন
করতে হয়। আপনারা কি হারুকি মুরাজামি-র বইগুলো দেখেছেন, যেগুলোর মলাট এঁকেছেন নোমা
বার? কিম্বা আলব্যের কাম্যু-র বইয়ের প্রচ্ছদ? যা বেরোচ্ছে ভিন্টেজ পাবলিকেশান থেকে,
সাদায়-কালোর কয়েকটি রেখায়? কী বুদ্ধিদীপ্ত সব কাজ! হাতের কাছে আরেকজনকে মনে পড়ছে –
ধ্রুব এষ। বাংলাদেশের লিজেন্ড। হুমায়ুন আহমেদের বইয়ের সমস্ত প্রচ্ছদ পড়ব কি, আগে
দেখতেই থাকি, আর পড়ার তৃষ্ণা বাড়তেই থাকে। আর দুই, যার একটা শিল্পের প্রতি শ্রদ্ধা
থাকে, তার অন্যান্য শিল্পের প্রতিও শ্রদ্ধা থাকবেই, বুঝুন চাই না বুঝুন। নিজের
ক্ষেত্রটাকে গভীরে গিয়ে উপলব্ধি করলে, তিনি এটাও উপলব্ধি করতে পারতেন, সব শিল্পের
একটাই উদ্দেশ্য --- মানবতাকে প্রকাশ করা। কেবল ভঙ্গি আলাদা।
তো, অবশেষে
বলি, ছবিটার ব্যাপারে আমার মত। আমি ছবিটাকে বুঝিনি। বিন্দুমাত্র বুঝতে পারি নি।
কিন্তু একটা কথাই আমার বলার আছে, আনন্দবাজার পত্রিকা-র উচিৎ ছিল, ছবিটাকে নিয়ে গণেশ
হালুইয়ের এক বিস্তারিত সুগভীর সাক্ষাৎকার, তার নিজস্ব বক্তব্য, সাধারণ পাঠকবর্গের
দিকে তাকিয়ে। তাহলে আপনাদের জন্যে গণেশ হালুইকে, অন্তত, এতটা বিড়ম্বনায় পড়তে হত
না।
==============
ছবিগুলি ইন্টারনেট
থেকে সংগৃহীত। কোন ছবির সত্যতা যাচাই করা হয় নি।
Comments
Post a Comment