তসলিমাঃ লেখকদের আসলে পাঠক কি পছন্দ করবে, তা ভেবে, লেখা উচিত নয়



কাফকা-র নাম ছোট্টোবেলা থেকে শুনে এসেছি। তার লেখা কালোত্তীর্ণ। অসামান্য। ‘মেটামরফোসিস’ যখন পড়লাম, মনে একদমই দাগ কাটল না। তিনটে বাংলা অনুবাদ এবং গোটা দুয়েক ইংরাজী তর্জমা পড়েও মনে হল না, এ লেখা খুব একটা ভালো লাগার মতো। ‘দ্য ট্রায়াল’ শেষ করে উঠে ভাবলাম, কেন পড়লাম? সময় নষ্ট। ‘দ্য কাসল’ অর্ধেক পড়ে রেখে দিয়েছি। মোট কথা, আমার চোখে কাফকা খুব একটা কহতব্য নয়। এর মানে কি? এর মানে এই যে, কাফকা বোঝার মতো বুদ্ধিসুদ্ধি আমার হয় নি। যে পর্যায়ে গেলে কাফকার লেখার মর্মার্থে আসা যেতে পারে, আমি সেই পর্যায়ে এক্সিস্ট-ই করি না। এই সিদ্ধান্ত কেন? কারণ, মার্কেজ থেকে শুরু করে মুরাকামি --- প্রতিথযশা লেখকের লেখায় এবং চিন্তনে কাফকার যে কি প্রভাব তা নিয়ে কোন বিতর্ক নেই। অনেক বিদিগ্ধ পাঠকও কাফকার কথায় চুপ করে যায় বিস্ময়ে কিছু বলতে না পেরে। লেখকেরা, বিদগ্ধেরা যখন লেখক কাফকার গুণগান করে, সন্দেহ নেই, তখন, পাঠক হিসাবে আমি চুড়ান্ত ব্যর্থ।

      এই গোড়চন্দ্রিকার উদ্দেশ্য কাফকা নয়, এক লেখকের প্রতি আর এক লেখকের বক্তব্য। মনে পড়ে, বেশ কয়েকবার শ্রদ্ধেয় রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখার সমালোচনা করেছিলাম। অনেকেই সমর্থন করেছিলেন, অনেকেই খড়গহস্ত হয়েছিলেন। দাড়িপাল্লা দুদিকেই ভারী ছিল। বিশেষত গত শারদীয়া কৃত্তিবাস সংখ্যায় যখন মার্লে ওবেরনকে নিয়ে তার উপন্যাসের সমালোচনা করি, তখন, অনেকেই, উপন্যসের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে আমাকে তীব্র আক্রমণ করেন। আমি তখন ভাবতে বসি, আমি কি তাহলে, সত্যি সত্যিই (যদিও তার তীব্রতা কম ছিল), ‘আর্ট’ বুঝি না?

      লেখিকা তসলিমা নাসরিন উক্ত উপন্যাস (গোলাপী মেমসাহেব না কি একটা যেন নাম ছিল...) এবং আরেকটি উপন্যাস ‘তুমিই যখন আমার রবীন্দ্রসঙ্গীত’ এই দুটি উপন্যাসের রিভিউ দিচ্ছেন সুদীর্ঘ তিন পাতা জুড়ে, এবারের কৃত্তিবাস সংখ্যায়। তিনি কি বলছেন? তিনি লিখছেন---

      “... রঞ্জনের নিজের জীবনে ঘটা কাহিনীর ওপর ভিত্তি করে লেখা (দ্বিতীয় উপন্যাসটি)। এই উপন্যাসে ষাট বছর বয়সি লোকের প্রেমিকার বয়স আঠারো। অস্বস্তি হয় পড়লে। এই উপন্যাসেরও পাতায় পাতায় যৌনতা। নারীকে প্রচুর পুরুষলেখক নেহাতই যৌনবস্তু হিসেবে দেখেছেন। রঞ্জনও আলাদা নন। অথচ রঞ্জন আলাদা হতে পারতেন। রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় একজন নিপাট ভদ্রলোক, তাঁর পাণ্ডিত্য (এ নিয়ে আমারও কোন সন্দেহ নেই), তাঁর রুচি, তাঁর সভ্যতা এবং শ্লীলতা-জ্ঞান আর দশজন বাঙালী পুরুষের তুলনায় অধিক।

কিন্তু তিনি কামকেই উপজীব্য করেছেন কেন? এই প্রশ্নটি অনেকের। আমি মনে করি না, যৌনতা বা কাম, জীবন থেকে বর্জন করা উচিত। কিন্তু এটিকে কেন্দ্রে রেখে সারাজীবন প্রদক্ষিণ করাটা কোন কাজের কাজ নয়। আমার মনে হয় রঞ্জন কোনো এককালে যৌনতা নিয়ে লিখে একধরনের পাঠকের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিলেন। সেই থেকে তিনি এবং তাঁর লেখার সম্পাদক এবং প্রকাশক মনে করেন, তাকে যৌনতা নিয়েই লিখতে হবে, এটিই তাঁর বিষয় (দ্য নাইফ, সালমান রুশদীর নবতম বই, সেখানেও তিনি মূলত যৌনতা ছাড়া আর কিচ্ছুই বিশেষ দেখতে পান নি)। তিনি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লিখলেও যেন যৌনতা থাকে, তিনি চেয়ার টেবিল নিয়ে লিখলেও যেন যৌনতা থাকে --- যৌনবুভুক্ষু পাঠকের দাবী হয়তো এটাই। আর রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় নিরন্তর তাদের দাবী মিটিয়ে যাচ্ছেন (এমন পাঠক বড়ো সেজেগুজে ভালোমানুষটি হয়ে থাকেন)। লেখকদের আসলে পাঠক কি পছন্দ করবে, তা ভেবে, লেখা উচিত নয়। লেখকের উচিৎ নিজের বোধ, বুদ্ধি আদর্শ আর দর্শন অক্ষত রেখে লেখা, লিখে তৃপ্তি পাওয়া যায়। আমি বিশ্বাস করি, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় চাইলে শেকসপীয়ারের জীবন নিয়ে চমৎকার একটি উপন্যাস নিয়ে লিখতে পারতেন। তাঁর বৈদগ্ধ্যকে জলাঞ্জলি না দিলে তিনি এখনও হয়তো লিখতে পারেন তেমন উপন্যাস।”

আমি নিশ্চিন্তে শ্বাস ফেলি। আমি বুঝতে পারি, আমি ভুল ছিলাম না। তসলিমা-র জন্য আমার বড়ো মন খারাপ হয়। তিনি জানেন না, বর্তমানের অধিকাংশ জনপ্রিয় বাঙালী লেখক তাঁর কোন এক ধরনের লেখা পাঠক মহলে জনপ্রিয় হওয়ার পর সারাজীবন সেই একই পন্থায় লোক টেনে চলেছেন (একে ‘থোড়-বড়ি-খাড়া’ বলে)। তিনি জানেন না, লেখকেরা আসলে পাঠক কি পছন্দ করবে, তা ভেবেই লেখা হয়। পরকীয়া আর তন্ত্র-গোয়েন্দা-র বাইরে আর কিছু নেই বলেই এখন ১০০/১৫০-টা বই বিক্রী হলেই বলা হয়, “বই সুপারহিট। পরবর্তী সংস্করণ শীঘ্রই আসছে।” আর সেই কারণেই, খুব কম সংখ্যক লেখক, যারা অন্যরকম লেখার চেষ্টা করছে (করছে কি? ওরকম দাবী সত্ত্বেও আমি ঠকেছি বেশিরভাগ সময়েই), তারা জনপাঠকের আগোচরে থেকে যায়। আর জনপাঠকের অবস্থাও তথৈবচ। বেশি পরিশ্রমে আমরাও বড়ো কাতর হয়ে পড়ি, আর তাই আমাদের রুচি আর উন্নত হতেই চাইছে না। পাঠকের বদলে এখন বানান পুলিশের ভিড়ে সোশাল মিডিয়া ভিড়াক্কার।

 

==================

কৃত্তিবাস - কাফকা সংখ্যা

মুদ্রিত মূল্যঃ ১০০টাকা

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে