বিশ্বকাপ, ভারত ও একটা মন খারাপের কথা

 


ভারত বিশ্বকাপ জিতেছে। মোটামুটিভাবে শেষ বল করার আগে থেকেই আমার আশেপাশে বাজী ফাটতে শুরু করেছিল। বেশিরভাগ ঘর থেকেই লোকজনের উল্লাস ভেসে আসছিল। সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট আসতে শুরু করেছিল। শেষ বলের পরে বন্যার মতো তারা ভাসিয়ে দিয়ে যায় আমার আশপাশ। আমার উন্মাদনা। আমার ইমোশন।

      ক্রিকেট দলগত খেলা। আমি ক্রিকেট খেলা দেখতে ভালবাসি। খুব একটা এ নিয়ে কথা বা পোস্ট কোনদিনই করি নি। আগের বিশ্বকাপে অমন মর্মান্তিক হারের পরেও কারো সাথে এ নিয়ে মুখ ফুটে, অন্তত সোশাল মিডিয়ায়, কিছু আলোচনা করি নি। আজ করছি। কারন, দলের মধ্যে থেকে গোটা তিনেক মুখ আমার চোখের সামনে ভেসে আসছে। অত্যন্ত যন্ত্রনাকাতর দু-তিনটে মুখ। কাল রাত্রে যখন একটা নিবিড় শান্তি নিয়ে ঘুমাতে গিয়েছিলাম, ঘুম আসার আগে পর্যন্তও সেই তিনটে মুখ ভেসে আসছিল বারবার। স্বপ্নে কি তারা এসেছিল? জানি না। আমার স্বপ্ন সাধারণত মনে থাকে না। কালকেরটাও মনে নেই।

      বিরাট কোহলি। রোহিত শর্মা। জসপ্রীত বুমরা।

      আমাদের সময়ের তিন জাদুকর। আমার বাবা-কাকারা বলেন কপিল দেবের কথা, শচীন তেন্ডুলকরের কথা, সৌরভ গাঙ্গুলীর কথা। আমি বলব এদের কথা। শেষোক্ত দুজন আন্তর্জাতিক টি২০ খেলা থেকে নিজেকে সরিয়ে দিল। আমার মনে হয়, সঠিক সিদ্ধান্ত। ভারতের এখন সোনার সময় চলছে। বাকি কাঁচা সোনাগুলোকে পুড়িয়ে পাকা করার মতো কঠিন কাজটি, আশা করি, গৌতম গম্ভীর, খুব ভালোভাবেই করতে পারবেন।

      যন্ত্রনার উপশম হল। নিজের দেশে, একদিবসীয় বিশ্বকাপের ফাইনাল হারার যন্ত্রনা। খানিকটা। যদিও, কোথাও আমার মনে বিশ্বাস, আমরা সে কাপ জিতেছিলাম। ভাগ্যদেবতা অস্ট্রেলিয়ার দিকে মুখ ফিরিয়েছিলেন মাত্র, ভুল করে। কাপ আমাদের নেই। কিন্তু ওই ‘বিশ্বকাপ’ আমাদের। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ওই বিশ্বকাপের প্রতিটি ম্যাচ দেখবে বিস্মিত হয়ে। কোনও টিম এর আগে এতটা ডমিনেন্সি নিয়ে খেলতে পারে নি। পারবেও না। এই বিশ্বকাপেও একই ব্যাপার হল। সেদিনও ফাইনাল খেলার আগে ভারত অপরাজিত ছিল, এবারও তাই। সেদিনও ফেভারিট ছিল, এবারও তাই।

      তবে, সোশাল মিডিয়াতে, একটা ব্যাপার, খানিকটা আগে থেকে আন্দাজ করা থাকলেও, দেখে একটু খারাপই লাগছে। সোশাল মিডিয়ায়, আমরা, যারা ভারতের, বিশেষ করে বাংলার বাসিন্দা, তাদের অনেকেই (পরিমাণটা কিন্তু অনেকটাই) নিজেদের জয়ের পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশকে নিয়ে চরম খোঁচা দিচ্ছেন। কেন দিচ্ছেন? কারণটা নিয়ে বিস্তারিত কথা বলার কোন মানেই হয় না। আমি মনে করি, এ তাদের প্রাপ্য। আমাদের মধ্যে কতটা খারাপ লাগা অজ্ঞাতবাস করলে এই ধরনের পোস্ট করতে বাধ্য হই, সেটা ভাবার দায়িত্ব এবার কিন্তু প্রতিবেশী দেশটির। আমার খারাপ লাগছে তাদের মুর্খতার পরিণাম দেখে।

      তবে, এও সত্যি, মনে হয় না তারা ভাববে, এ তাদের স্বাভাবেই নেই। কাল সারাদিন ধরে আমি সোশাল মিডিয়াতে ছিলাম বটে, কিন্তু, নীরব। দেখছিলাম, প্রতিবেশী দেশের অনেকেই কি অদ্ভুতভাবে সাউথ আফ্রিকাকে সমর্থন করছে। সমর্থন করার অর্থ যদি ভারতের প্রতি বিদ্বেষে হয়, তাহলে, এটাকে কুচুটেপনা বলে। তারা সেটাই করেছে। এমনকি তাদের অনেক বড়ো বড়ো জনপ্রিয় মানুষেরাও। যাদেরকে আমি অন্তত এতদিন ধরে বুদ্ধিমান ভেবে এসেছিলাম। মজার ব্যাপার, বাংলাদেশ বড়ো মাপের খেলায় কাউকে হারাতে পারে না বটে, কুচুটেপনায় সবাইকে বলে বলে আউট করবে। এখন তাদের অনেকেই আবার ভারতের জয়ের পেছনে বেশ কিছু অদ্ভুত ধরনের ব্যাখ্যা করছে, যার অর্থ, ভারত চালাকি করে জিতেছে।

      অজুহাত দুর্বলের ধর্ম। বাংলাদেশ ঠিক সেটাই করছে। এখন সবল যদি মারমুখী হয়ে ওঠে সেটাও কি সবলের পক্ষে উচিৎ? না। তবে পদ্মাপাড় থেকে যত বেপরোয়া শব্দের ধাক্কা এসেছে, আমরা তার বিরুদ্ধ প্রত্যাঘাত কিন্তু সমানে সমানে করি নি। করেছি অতি অল্পই। আমাদের সমস্ত শক্তি আমরা ক্ষয় করেছি কাজে। তারা এবং তাদের ক্রিকেটারেরাও, কথা বেশি বলে, কাজের কাজ কম করে। আমরা কাপ জিতে দেখাই, নিদেনপক্ষে ফেভারিট হয়ে অন্তত ফাইনাল / সেমিফাইনালে যাই। শব্দ একটা এনার্জি। এই এনার্জি কাজে পরিণত করতে পারলে ভারতের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠা যায়, এশিয়ায়, তাঁর প্রমাণ আফগানিস্থান রাখছে, অদূর ভবিষ্যতে নেপালও রাখবে, বিশ্বাস করি। আর কেবলমাত্র কথা দিয়ে জিততে চাইলে, পরিশ্রমের বদলে চালাকি করে বিপক্ষের ব্যটসম্যানকে আউট করলে (তা সে যতই নিয়মমাফিক হোক না কেন) কিম্বা বিপক্ষকে, আম্পায়ারকে ও ক্রিকেট কাউন্সিলকে দোষ দিয়ে দিয়ে দিন কাটালে তাদের অবস্থা আমাদের অপর প্রতিবেশীর মতোই যে হবে তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। সিদ্ধান্ত তোমাদের। আমাদের কিছু এসে যায় না। যত চীৎকার করবে, ততই আমরা দ্রুত ওপরে উঠব। প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে আমরা আর এখন তোমাদের ভাবি না। আমরা অস্ট্রেলিয়াকে ভাবি, ইংল্যান্ডকে ভাবি, সাউথ অফ্রিকা বা আফগানিস্থানকে ভাবি।

      ভারতকে অভিনন্দন। ফুলে মোড়া রাস্তা তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা অপেক্ষা করছি। তোমাদের জন্য। তোমাদের প্রাপ্য আমরা ভালোবাসার অত্যাচার দিয়ে মিটিয়ে দেব। তোমরা প্রস্তুত হও...




Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে