থ্রি ডেজ অফ হ্যাপিনেস
আমি একটু একটু করে যত জাপানী
সাহিত্যের মধ্যে ঢুকছি, বিস্ময় লাগছে। এখনও, গল্প বলার যে প্রথা, উপন্যাস কিম্বা
ছোটগল্পের মধ্যে, যা, সম্ভবত অনেকটাই, সে ধারা ভেঙ্গে অন্যরকমভাবে চলার চেষ্টা
করছেন পাশ্চাত্যের লেখক-লেখিকারা, সেখান থেকে সরে এসে, গল্পটাকে রেখে, নিজেদের মতো
করে উপস্থাপনা করার প্রথা দেখায় যায়। এ অনেকটা, এরিস্টটলীয় সাহিত্য সংজ্ঞা থেকে
ভেঙে এসে অন্যরকম উপস্থাপনা। প্রসঙ্গত, বাংলা সাহিত্যও এখনও শুধুমাত্র গল্প বলার
ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে না, যদিও, তাদের গল্প বলার পদ্ধতিটা, আমার অনেক সময়
মনে হয়, বেডটাইম ড্রামা টাইপ। টিভি-সিরিয়ালগুলো ‘বেডটাইম’টাকে
সরিয়ে নিয়ে ড্রামাটাকেই বড়ো করে দেখাতে গিয়ে প্রাচীন যাত্রাপালা এবং খেউর টাইপ
নষ্টামী তার সাথে যুক্ত করে ব্যাপারটাকে ভয়ংকর সুন্দর বানিয়ে দিয়েছেন। আমি ভয় পাই।
আমার হবু শ্বাশুড়ী এবং বড় ননদ সন্ধ্যেবেলায় নিয়ম করে ঘন্টা দুয়েক মন দিয়ে সিরিয়াল
দেখেন এবং বন্ধুসমভিব্যহারে তা নিয়ে আলোচনা করে। প্রসঙ্গত, আমার মাতাঠাকুরাণীও এর
বাইরে নন, যদিও, তাকে খুব একটা সিরিয়াল আলোচনা করতে দেখি নি।
ধান ভানতে শিবের গীত টেনে এনেছি, দুঃখিত, আসলে, এই তালে, মনের
কিছু কথা কয়ে নিলাম। এবার গল্পে ঢুকে পড়ি।
সুগারু মিয়াকির এই গল্পে, কেন্দ্রীয় চরিত্র, কুসুনাগি, যে কি না
একটা ছেলে (জাপানী নামে ছেলে-মেয়ে বড্ডো গুলিয়ে যায়), এবং হতদারিদ্র, তার কুড়ি বছর
বয়সে তার অবশিষ্ট তিরিশ বছর তিন মাস জীবনের ত্রিশ বছর বিক্রী করে দেয়। এ প্রসঙ্গে
বলি, জাপানী সাহিত্যে, বিষন্নতা, একাকীত্বতা আর আত্মহত্যার এক মিশেল খুব দেখা যায়।
জাপান, অনেক অগ্রগামী দেশের একটা দেশ হয়েও, শুনেছি, সেখানে আত্মহত্যার হার অনেক
বেশি। ফলে এই গল্পেও কুসুনাগির বিষন্নতা একটা সময়, কোথাও যেন, আমাকেও গ্রাস করতে
চায়। এমন নয় যে, সে হতদারিদ্রের কারণে বিষণ্ণ। সে কারো সাথেও মিশতে পারে না।
এই যে অন্তর্মুখী এক চরিত্র, যার অন্তর্মুখীনতা এতটাই তীব্র, সে,
তার কুড়িটা বছর, স্কুল কিম্বা কলেজে, ঘরে কিম্বা কাজের জায়গাতে, সম্পূর্ণভাবে একা
--- “যখন ছোট ছিলাম, আমি ভাবতাম বড় হয়ে বিখ্যাত কেউ একজন হবো। আমি
ভেবেছিলাম আমার যুগের বাকি সবার চেয়ে কয়েক কদম এগিয়ে ছিলাম আমি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, যে ছোট নরকে আমি বাস করতাম তাতে বাবা-মায়েরা ছিল বিরক্তিকর
এবং অকর্মণ্য। যারা বিরক্তিকর বাচ্চাকাচ্চা জন্ম দিয়ে
যাচ্ছে। তাদের অকর্মণ্য ছেলেমেয়েরাই হচ্ছে আদর্শ। এটাই
আমাকে এই ভুল ধারণার দিকে ঠেলে দিয়েছিল।”
আমরা কি নিজেকে নিয়েও এমনই ভাবি না। আমরা ভাবি, পৃথিবী আমার
জন্যেই নিজেকে প্রস্তুত করেছে। দুনিয়া আমার হাতের মুঠোয়। একসময় এই ভুল ভাঙ্গে, তখন
অন্যকে দুষতে শুরু করি। একসময় সেই পর্যায় থেকে বেরিয়ে এসে গতানুগতিক জীবনে চলতে
শুরু করি, কিম্বা, একাকী বিষন্নতায় ডুবে যাই। এটাই মায়া।
তারপর? শেষ বয়েস আসে --- “মৃত্যু নিকটবর্তী হলে সবাই চরমপন্থী কথাবার্তা
বলে। বিশেষত সেসব লোকজন, যারা বলতে পারবে
না এই পর্যন্ত ওদের জীবন পরিপূর্ণ ছিল। একই
যুক্তিতে, যে যুক্তিতে হারতে থাকা জুয়াড়ি পাশার দান ঘুরে যাবার আশায় খেলেই
যেতে থাকে। যারা জীবনে প্রতিনিয়ত হারতে থাকে; তারা অবাস্তব সুখের আশা করে। মৃত্যু ঘনিয়ে
আসলে জীবনের দ্যুতিতে অনেকেই উজ্জীবিত অনুভব করে। তারা
বিশ্বাস করে তারা এটা করতে পারবে, ওটা করতে পারবে; কিন্তু এসব লোকজন একটা গুরুত্বপূর্ণ ভুল করে। তারা
মাত্রই শুরু করেছে। তারা মাত্রই অনেকদিনের বিরতির পরে আত্মসংযম ফিরে পেতে
শুরু করেছে। এই সুযোগকে সবকিছু আমূল বদলে দেওয়ার সুযোগ মনে করাটা
বিরাট ভুল এবং এটা তাদের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না।”
এটাও মায়া। আমি না, সুগারু মিয়াকি বলছেন।
এ তো গেল কুয়াসানাগির চরিত্র। এখন এই আয়ুষ্কাল বিক্রী ব্যাপারটা
কি? মজার ব্যাপার, এটা কোন সায়েন্স ফিকশান গল্প নয়। কে আয়ুষ্কাল কিনছে, কেন কিনছে,
তা এই উপন্যাসের কোনরকম কোন বিষয়ই নয়। আসলে, আমরা জানি না, আমাদের হাতে সময় কত
আছে। অথচ, আমরা ভাবি, আমরা অনেক সময় হাতে নিয়ে এসেছি। কিন্তু হঠাৎ করে যদি, আমরা,
রোগে-শোকে, জীবনের প্রান্তসীমায় এসে পৌছই, যখন, জীবনে সামান্যতম আশাও অবশিষ্ট নেই,
তখন, আমাদের কাছে জীবনটা কেমন? জীবনের মূল্য কেমন?
মুল্যবোধ। জীবনের মুল্যবোধ, তখনই আমরা খুঁজতে চেষ্টা করি, যখন
আমরা অস্তিত্বের সংকটে এসে পৌছই। কিন্তু সুগারু মিয়াকি আরোও একধাপ এগিয়েছেন। তিনি
লিখছেন, কুসানাগি তখনও তার জীবনকে মূল্যায়ন করতে পারছেন না, “মৃত্যুর যত কাছে আসতে
লাগলাম; পৃথিবীটা আমার কাছে হঠাৎ তত সুন্দর হয়ে উঠছে না। মনে
হচ্ছে সবকিছুর প্রতি আমার মতামত শুধরে নিতে হবে। আমি
ভাবতে লাগলাম। হয়তো বা পৃথিবীটা সেসকল মানুষের কাছে সুন্দর হয়ে
ধরা দেয়; যাদের ইতিমধ্যে মৃত্যু ঘটেছে। এটা
নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু মনে হচ্ছে আমি আমার শিশুসুলভ চিন্তা এখনো ঝেড়ে
ফেলতে পারিনি। মনের গভীরে কোথাও, আমি এখনো আশা
করছি হঠাৎ করে পৃথিবীটা সুন্দর লাগা শুরু করবে।”
ঠিক এইখান থেকে শুরু হয় তার যাত্রা। শেষ তিনমাসের যাত্রা। মৃত্যুর
সামনে দাঁড়িয়েও কোনরকম কোনা আশা না থাকা মানুষের যাত্রা। আর ঠিক এই সময়েই,
আবির্ভুত হয় আরেকটি চরিত্র – মিয়াগি। মিয়াগি কুসানাগির পর্যবেক্ষক। সে সময় বিক্রী
করেছে, এবং সেই কারণেই, সে আয়ুষ্কাল বিক্রী করা মানুষের শেষ বছরটা সবসময় সঙ্গে
থাকে, যাতে সেই মানুষ, মৃত্যুভয়ে, সমাজের কোন বড়োরকমের ক্ষতি করতে না পারে। একটা
সময় বোঝা যায়, মিয়াগি, কোথাও যেন, কাসানাগি’র অপর একটা সত্ত্বা হয়ে উঠেছে, যে
কুসানাগিকে পর্যবেক্ষণ করছে, অর্থাৎ, কুসানাগি নিজের ভেতরে প্রবেশ করছে। আর এখান
থেকেই শুরু হয় এক অন্যরকম যাত্রা।
গল্প এগোয়, তার স্বভাবসিদ্ধ গতিতেই। আমি মুগ্ধ হয়ে পড়তে থাকি।
কুসানাগি মুখোমুখি হয় হিমোনো, নারুসে, ওয়ানাকা --- এভাবে এক এক করে প্রতিবেশী তথা
সমাজের সাথে। স্বপ্ন আশা জাগিয়ে রাখে, কুসানাগি স্বপ্ন দেখে, আশা তাকে এগিয়ে নিয়ে
যায় মৃত্যুর দিকে। এই পর্যায়ের সবথেকে বড়ো অধ্যায় এগারো নম্বর পর্ব। এখানেই আসলে
কুসানাগি নিজেকে নিজে মূল্যায়ন করে। তার অতীতের কাছে সে নিজেকে নিজেই মূল্যায়ন
করে। সে মূল্যায়নের সামনে তার অতীত স্থবির, বিবর্ণ, বৃদ্ধ। সে কুসানাগির মুখের
দিকে তাকিয়ে কেবল একটাই কথা জানায়,
“বিদায়।”
অসাধারণ এই
বইয়ের অতি অসাধারণ অনুবাদে মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল, নিজের মাথার চুল ছিঁড়ি। নজরুল
ইসলামের মতন অনুবাদক বাংলা ভাষা এবং বাংলাদেশের মান-সন্মান জলাঞ্জলী দিচ্ছেন এ
নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। যে সমস্ত বই পড়ুয়ারা ‘ইংরাজী পড়তে পারি না’ বলে মুখ ভেটকিয়ে
পঞ্চাশের দশকের সাহিত্যে গিয়ে মুখ লোকান, তারা, কিম্বা, যারা বর্তমানের লেখাগুলো
ইংরাজীতে পড়তে চান না, এই ধরণের অনুবাদ যদি তাদেরকে পড়াতে বাধ্য করা হয়, আমি
নিশ্চিত, ছয় মাসের মধ্যে তারা হয় বই পড়াই ছেড়ে দেবেন, অথবা, ইংরাজীতে বই পড়তে শুরু
করে দেবেন।
============================
থ্রি ডেজ অফ
হ্যাপিনেস
সুগারু
মিয়াকি
অনুবাদকঃ
নজরুল ইসলাম
প্রকাশকঃ
নয়া উদ্যোগ
মুদ্রিত
মূল্যঃ ৩৮০ টাকা
Comments
Post a Comment