ভার্জিনিয়া উলফ

 


আমরা, প্রত্যেকেই, কম-বেশি, স্বপ্নসন্ধানী। স্বপ্ন আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। আমরা কি কখনও স্বপ্নদের তাড়া করি?

      আমার এক বন্ধু নিজের সাথে কথা বলে। একা থাকলে আপন মনে বিড়বিড় করে। আমরা ছোটবেলায় হাসাহাসি করতাম তাকে নিয়ে। সে লজ্জা পেত। চুপ করে যেত। কিন্তু কখন যেন আপন মনে আবার বিড়বিড় করতে শুরু করত। সেই ইন্ট্রোভার্ট বন্ধুটি তাঁর স্বপ্নগুলোর সাথে কথা বলত। নিত্যনতুন স্বপ্নের জন্ম দিত সে। চিরপুরাতন স্বপ্নগুলো অনেক সময় নিত্যনতুন রূপে-রূপান্তরে তার কাছে ধরা দিত। সে স্বপ্নকে তাড়া করত। স্বপ্নপুরণের জন্যে নয়। স্বপ্নের সাথে আরও কিছুক্ষণ কাটাবে বলে।

      সে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, তুই যে চিন্তাগুলো করিস মনে মনে, সেগুলোকে কোনদিন অবসার্ভ করেছিস? পরপর?

      সেদিন তাঁর মানে বুঝিনি। আজ বুঝতে পারছি। বুঝতে পারছি তার কারণ, ভার্জিনিয়া উলফ। ধরতে পারছি না, তাঁর কারন নিজের অনভ্যাস।

      আমি রাতের পর রাত জাগি। নিজের চিন্তার স্রোতকে ধরব বলে। লিখব বলে। তাকে একটা সার্থক রূপ দেব বলে। আমার সামনে এসে দাঁড়ায় মিসেস ডলওয়ে, মিসেস র‍্যামসে, লিলিরা। আমি কখন যেন চিন্তার স্রোতে ভেসে যাই। আমার অবচেতন মনের মধ্যে বয়ে যাওয়া হাজারো চিন্তার স্রোত আমাকে একা রেখে চলে যায়। নতুন স্রোতের ভিড়ে নিজে আবার একা হয়ে যাই। ভীড়ের মধ্যে এই একা হাটার নাম ভার্জিনিয়া উলফ।

      ভার্জিনিয়া উলফ মেয়েদের জন্য একটা নিজস্ব ঘর আর কিছু অর্থ চেয়েছিলেন। তাঁর নারীবাদের তত্ত্বই দাঁড়িয়ে আছে এই দুই ভিত্তির ওপরে। আজকের নারীদের এই দুটিই করায়ত্ত। আর সেই কারনেই ভার্জিনিয়া লোকচক্ষুর আড়ালে। আজকের নারীবাদীরা প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাস্তায় দাঁড়ায় রোদচশমা পড়ে। কিম্বা থানায় গিয়ে ডায়রী লিখিয়ে আসে। কিম্বা নিজের দুঃখের কথা ইনিয়ে বিনিয়ে বলে সহানুভূতির মালা পড়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করতে চায়। কিন্তু ভার্জিনিয়া হতে চায় না।

      “কীটের খোঁজে কে দেয় রে হাত কেউটে সাপের গর্তে” --- মনে আছে রবীন্দ্রনাথের এই কবিতার লাইনের ভাববস্তুটিকে? ভার্জিনিয়া কেউটে সাপের গর্তে হাত ঢুকিয়ে একের পর এক বের করে নিয়ে এসেছেন ‘টু দ্য লাইটহাউস’, ‘মিসেস ডলওয়ে’, ‘দ্য ওয়েভ’ এবং ‘অরল্যান্ডো’-দেরকে। সেই কেউটে সাপের বাচ্চাগুলোকে তিনি ল্যাজে খেলিয়েছেন। আমরা তাতে হাত দেওয়ার সাহসও দেখাইনি। ফলে, আমাদের এপার বাংলায় ‘নিজের একটি কামরা’ এবং ‘বাতিঘর অভিমুখ’ --- মাত্র এই দুটি বই অনুবাদ হয়েছে। প্রথমটা এখনও পাওয়া যায় বটে, পরেরটা বহুদিন আউট অফ প্রিন্ট।

      আসলে গল্পের বাইরে থাকা সাহিত্য জগতটার মধ্যে নিজেকে টেনে কে নিয়ে যেতে চায়? আমরা চাই গল্প। ভার্জিনিয়ার গল্পের চরিত্রেরা নিজেদের কথা বলে। দৈনন্দিন জীবনের সে কথা আটপৌরে আনন্দ-বেদনার কথা। ফলে তাঁর স্রোতের মধ্যে ধীরে ধীরে নৌকা বাইতে গেলে যে ক্রমাগত একমাত্রিক চেতনাস্তরের সাথে ভাসতে হবে, সেই ভেসে থাকার ক্ষমতা আমাদের নেই। আমরা নদীর দুপাশে প্রতিমুহূর্তে চলচ্ছবিকে দেখতে চাই। নদীর স্রোতের স্থিরছবিকে দেখতে চাই না। ভার্জিনিয়া সেই স্থিরছবির কথা বলেন। সেই স্থিরছবির কথা লেখার টেকনিককে আমরা নাম দিয়েছি, স্ট্রীম অফ্‌ কনসাশনেস। ভার্জিনিয়া তাঁর সার্থক রূপকার। আরেক রূপকার জেমস জয়েস। আরেক রূপকার মার্সেল প্রুস্ত। মার্সেল প্রুস্তের বিখ্যাত উপন্যাসটি সুনীল শেষ করে উঠতে পারেন নি। বাংলায় অন্য কেউ কি শেষ করেছেন? কিম্বা যে শেষ করেছেন সে কি জীবিত আছেন?

      চিন্তার স্রোতে গা ভাসিয়ে দিই। আমার অবচেতন মনের চোরস্রোতের ঘুর্ণী থেকে নীচের জল ওপরে উঠে আসে। সে স্রোতকে কখনও দেখেছি কি? পাতার পর পাতা জুড়ে ভার্জিনিয়া দেখতে চেয়েছেন। দেখেওছেন। সেই স্রোতের মধ্যে অবগাহন করতে গিয়ে আমি মুখোমুখি হই আর এক অবচেতন বিষন্নতার। সেই স্রোত উদাসীন। সে কখনও কোন তীরে ঢেউয়ের মতো এসে আছড়ে পড়ে না। সে আস্তে আস্তে বয়ে যায়, একা, উদাসীন... সেই ভেসে যাওয়ার কথা ভার্জিনিয়া লেখেন। আমরা তাকে বলি ‘ইন্টেরিয়ার মনোলগ’।

      আমার সেই বন্ধুর আপন মনে নিজের সাথে বকে যাওয়াটাও কি ইন্টেরিয়ার মনোলগ? আমরা কি প্রতিদিনই নিজের সাথে কথা বলছি না? সেই কথাগুলোকে আমরা কেউ কি লেখার চেষ্টা করেছি? লিখলে কি সেটা ইন্টেরিয়ার মনোলগ হত না? তারও কত উত্থান পতন! তারও কত ঘটনার ঘনঘটা! কিন্তু সেই মনোলগের কথা কি আমাদের প্রাণে বাজে? না কেবল কতকগুলো অভিমান আর অহংবোধ আমাকে মনের নদীতে মধ্যে চর তৈরী করে। আমাদের চলার স্রোতকে সে আটকে দেয়। আমরা আস্তে আস্তে কখন যেন মরে যাই, টের পাই না। ভার্জিনিয়া সেই মরা নদীর মধ্যে বেচে থাকা চোরাস্রোতের কথা বলেন। আমরা সযত্নে তা এড়িয়ে যাই। সেই কারনেই তাঁর বইয়ের অনুবাদ করার মুরদ বাঙালী অনুবাদকদের হয় না।

      ভার্জিনিয়া কি কেবল একটুক্ষণের কথাই বলেন? জীবন সমুদ্রের ঢেউয়ে ঢেউয়ে এক-একটা মানুষ কখন কীভাবে তাঁর জীবনের চলার প্রান্তে চলে যায় তাঁর কথাও বলেন। দ্য ওয়েভ উপন্যাসে ছয়জন বন্ধু শৈশব থেকে বার্ধক্যে চলে আসে। প্রত্যেকের চলন আলাদা। কিন্তু জীবনের চাল? সে তাদেরকে একই গন্তব্যে নিয়ে যায়। মৃত্যু।

      আবার এক মানুষে কত মানুষ থাকে। সে ছেলেও হতে পারে। মেয়েও হতে পারে। ছেলের মধ্যে মেয়ে কিম্বা মেয়ের মধ্যে ছেলে। এক জীবনে অনেক জীবন। প্রথম ট্রান্সজেন্ডারের কথা কি ভার্জিনিয়ার উপন্যাসে পাওয়া যায়? যে বেঁচে থাকে তিনশো বছর ধরে। সমাজটাকে দেখে। তাকে নিরীক্ষণ করে নিজের সত্ত্বা দিয়ে, অরল্যান্ডো উপন্যাসে?

      ভার্জিনিয়ার বইগুলো নিয়ে লেখার ক্ষমতা এই মুহূর্তে আমার নেই। মানে একবার পড়ে তাঁর বইয়ের সম্পর্কে লিখতে যাওয়ার ধৃষ্টতা আমি দেখাতে চাই না। তাঁর কথা ভবিষ্যতের জন্য তোলা থাক। বেচে থাকলে লেখার চেষ্টা করব। কেবল একটা কথা বলতে পারি, বর্তমানে অনেক নামকরা লেখক লেখিকার লেখা না পড়ে ভার্জিনিয়া উলফের লেখা পড়লে ক্ষতির চেয়ে লাভ হবে বেশি।

=================

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে