ঘরোয়া
“দেখো মনে সব থাকে। সেই ছেলেবেলা কবে কোন্কালে
দেখেছি রাজেন মল্লিকের বাড়িতে নীলে সাদায় নকশা কাটা প্রকাণ্ড মাটির জ্বালা, গা-ময়
ফুটো, উপরে টানিয়ে রাখত। ভিতরে চোঙের মতো একটা কী ছিল তাতে খাবার দেওয়া হত। পাখিরা
সেই ফুটো দিয়ে আসত, খাবার খেয়ে আর-এক ফুটো দিয়ে বেরিয়ে যেত। অবাধ স্বাধীনতা, ঢুকছে
আর বের হচ্ছে। মানুষের মনও তাই। স্মৃতির প্রকাণ্ড জালা, তাতে অনেক ফুটো। সেই ফুটো
দিয়ে স্মৃতি ঢুকছে আর বের হচ্ছে। জালা খুলে বসে আছি, কতক বেরিয়ে গেছে কতক ঢুকছে
কতক রয়ে গেছে মনের ভিতরে, ঠোকরাচ্ছে তো ঠোকরাচ্ছেই, এ না হলে আর হয় না আবার।
আর্টেরও তাই। এই ধরো-না বিশ্বভারতীর রেকর্ড, রবিকাকা কোথায় গেলেন, কী করলেন, সব
লেখা আছে; কিন্তু তা আর্ট নয়, ও হচ্ছে হিসেব। মানুষ হিসেব চায় না, চায় গল্প।
হিসেবের দরকার আছে বৈকি, কিন্তু ওই একটু মিলিয়ে নেবার জন্য, তার বেশি নয়। হিসেবের
খাতায় গল্পের খাতায় এইখানেই তফাত। হিসেব থাকে না মনের ভিতরে, ফুটো দিয়ে বেরিয়ে
যায়, থাকে গল্প। সেই ‘ঘরোয়া’ গল্পই বলে গেলুম তোমাকে।”
বলছেন
অবন ঠাকুর, কাটুম-কুটুমের স্রষ্টা, বাংলা ছবির জগতের অবিসম্বাদিত মুকুটহীন রাজা।
গল্প বলছেন রাণীকে। রাণী চন্দ। তার ছাত্রী, আরেক প্রজ্ঞাবান আর্টিস্ট, যিনি চলে
গেছেন অন্তরালে। অবনীন্দ্রনাথের এই স্মৃতিসত্তার মৌলিকতার খোঁজ পেয়েছিলেন
রবীন্দ্রনাথ। ঘরোয়া’র সূত্রপাতেই রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “আমার জীবনের প্রান্তভাগে
যখন মনে করি কাকে বিশেষ সন্মান দেওয়া যেতে পারে তখন সর্বাগ্রে মনে পড়ে
অবনীন্দ্রনাথের নাম।” রবীন্দ্রনাথ তাকে বলছেন ‘সরস্বতীর বরপুত্র’ --- লিখছেন, “এঁকে
যদি আজ দেশলক্ষ্মী বরণ করে না নেয়, আজও যদি সে উদাসীন থাকে, বিদেশী খ্যাতিমানদের
জয়ঘোষণায় আত্মাবমান স্বীকার করে নেয়, তবে এই যুগের চরম কর্তব্য থেকে বাঙালী ভ্রষ্ট
হবে।”
জোড়াসাঁকোর
বাড়ীতে রবীন্দ্রনাথ। ১৯৪০। অসুস্থ। রানীসহ অনেকেই ছিলেন সেবার জন্য। অবন ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথকে দেখতে আসতেন প্রতিদিন। এক সময়ে রানীর সাথে আলাপ। বহু গল্পের ঝুলিতে
ভর্তি অবন ঠাকুর যে এক-আধ ছটাক রাণীর কাছে প্রকাশ করেন, রানী লিখে রাখেন নিজের মতো
করে। রবীন্দ্রনাথ একটু সুস্থ হলে ফিরে আসেন, শান্তিনিকেতনে। রানীর ওপর ভার পরে
সেবার। রবীন্দ্রনাথ কখনই চুপচাপ বসে থাকা পছন্দ করতেন না। তিনি বলে, “রানী, তুই
একটু লেখার অভ্যাস কর্-না।... চুপচাপ বসে থাকিস --- আমার জন্য কত সময় তোদের নষ্ট
হয় --- আমার ভালো লাগে না।”
রানী
অবন ঠাকুরের স্মৃতির ঝাঁপি খুলে দেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ।
যৌবনের রবীন্দ্রনাথকে কজনই বা চেনে? তখনও, এখনও। তিন বলেন, “এ অতি সুন্দর হয়েছে,
অবন কথা কইছে, এমি যেন শুনতে পাচ্ছি। কথার একটানা স্রোত বয়ে চলেছে --- এতে হাত
দেবার জায়গা নেই, যেমন আছে তেমনিই থাক্।”
রবীন্দ্রনাথ
রানীকে আবার পাঠান জোড়াসাঁকোয়। অবন ঠাকুর বেজায় খুশি। রবিকাকার ভাল লেগেছে বলে
কথা! বললেন, “যত পার নিয়ে নাও; সময় আমারও বড়ো কম। কে জানত রবিকাকার আমার এই-সব
গল্প শুনে এত খুশি হবেন।”
ফিরে
আসেন রানী তার নিজের ঝুলি ভরে। রবীন্দ্রনাথ পড়েন, প্রতিদিন একটি-দুটি করে। সব শেষ
হলে পর তিনি বলেন, “কী সুন্দর অবন সেকালের-আমাকে তুলে ধরেছে। আমি কি ছিলুম। সবাই
ভাবে আমি চিরকাল বাবুয়ানি করেই কাটিয়েছি, পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে। কিন্তু কিসের
ভিতর দিয়ে আমাকে যে আসতে হয়েছে, এ লেখাগুলোতে তা স্পষ্টরূপে ধরা পড়েছে। ... সে
একটা যুগ। ... আবার সে যুগে ফিরে গিয়ে নিজেকে দেখতে পাচ্ছি। ওইখানেই পরিপূর্ণ আমি।
পরিপূর্ণ লোকেরা আমাকে চেনে না --- তারা আমাকে নানা দিক থেকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে
দেখেছে। তখন বেঁচে ছিলুম --- আর এখন আধমরা হয়ে ঘাটে এসে পৌচেছি।”
কেমন
ছিলেন রবীন্দ্রনাথ? অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে কেমন দেখেছেন --- “কী প্রোডাকশন ওঁর
লেখার, আর কী প্রচন্ড শক্তি। নদীর যেমন নানা দিকে ধারা চলে যায়, তাঁর ছিল তেমনি।
আমাদের মতো একটা জিনিস নিয়ে, ছবি হচ্ছে তো ছবি নিয়েই বসে থাকেন নি। একসঙ্গে সব
ধারা চলত। কংগ্রেস হচ্ছে, গানবাজনা চলেছে, নাচও দেখছেন, সামান্য
আমোদ-আহ্লাদ-আনন্দও আছে, আর্টের চর্চা করতেন তখন। ... প্রকান্ড ইন্টেলেক্ট, অমন
আমি দেখি নি আর। বটগাছ যেমন নানা ডালপালা ফুলফল নিয়ে আপনাকে প্রকাশ করে রবিকাকাও
তেমনি বিচিত্র দিকে ফুটে উঠলেন। যেটা ধরছেন এমন-কি ছোটোখাটো গল্প, তাতেও কথা কইবার
জো নেই, সব-কিছু এক-একটি সম্পদ। লোকে বলে এক্সপিরিয়েন্স নেই, কল্পনা থেকে লিখেছেন।
তা একেবারেই নয়।”
রানীকে
অনেক ধন্যবাদ। ভাগ্যিস আপনি ছিলেন। ভাগ্যিস আপনি লিখেছিলেন। ভাগ্যিস আপনি স্মৃতিধর
ছিলেন। না হলে এ রবীন্দ্রনাথ আমাদের অচেনা অজানাই থেকে যেত। আমরা তাকে জানতেই
পারতাম না। আর সেই সাথে অবন ঠাকুরও আরেকটু বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যেত, তাড়াতাড়ি...
=====================
ঘরোয়া
রানী চন্দ
বিশ্বভারতী পাবলিকেশান
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ ইন্টারনেট
Comments
Post a Comment