আলাপচারী রবীন্দ্রনাথ
রাণী চন্দের রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা ‘গুরুদেব’
অথবা ‘আলাপচারী রবীন্দ্রনাথ’ --- এইদুটোর যে কোনও একটাকে আমি পড়তে বলব। ‘গুরুদেব’
বইটিতে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তিনি যে কথা ঘটনাপরম্পরায় লিখে গিয়েছেন, তার অধিকাংশই
‘আলাপচারী রবীন্দ্রনাথ’ বইতে পাওয়া যাবে, পার্থক্য শুধু একটাই, এই বই মুলত সংলাপ
নির্ভর। যে আটপৌরে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের ছায়াঘেরা মায়াময় সম্পর্কের
আলো-আঁধারিতে বিরাজমান, সেই রবীন্দ্রনাথ কোথাও যেন, এখানে, গুরুদেবের আসনে
প্রতিষ্ঠিত। যেন বা একটু দূরের। যেন বা একটু ভক্তির আবেশে প্রতিষ্টিত।
“গুরুদেব চলে গেছেন, এখন তাঁর
স্মৃতি নিয়েই দিন কাটছে। শেষ দশবছর তাঁর অতি কাছেই ছিলুম। তাঁকে প্রণাম করে দিনের
কাজে হাত দিতুম, সকালে উঠে তাঁর মুখই আগে দেখতুম জানালা দিয়ে। অতি প্রত্যুষে
অন্ধকার থাকতে উঠে বাইরে এসে একটি চেয়ারে বসতেন পুবমুখো হয়ে, কোলের উপর হাত দুখানি
রেখে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রাতরাশ শেষ করে লেখা শুরু করে দিতেন। কোনোদিন
দেখতুম বসেছেন কোনার্কের বারান্দায়, কোনোদিন শ্যামলীর বারান্দায় --- আমগাছের
ছায়ায়, কোনোদিন বা বাতাবিলেবুর গাছটির পাশে। সে যেন দেবমুর্তি দর্শন করতুম রোজ।
মানসচোখে প্রতিদিনকার সে-সব মুর্তি এখনো দেখি; আরো দেখব যতদিন বাঁচব।”
যতদিন ছিলেন, রাণী,
শান্তিনিকেতনের সেইসব অমলিন স্মৃতি নিয়ে বেঁচেছিলেন ‘জিতভূম’-এ। আর্টিস্ট রাণী যখন
লেখিকা হয়ে রবীন্দ্রনাথকে আমাদের সামনে হাজির করেন, তাঁর সেই লেখা বহুমূল্য। আসলে
কি জানেন? রবীন্দ্রনাথ তো শুধুমাত্র রচনাবলীর মধ্যেই নেই, তিনি তাঁর চারপাশের
পরিজন-পরিকরদের মধ্যেও ছিলেন। তাদের চোখে যখন রবীন্দ্রনাথ ধরা দেন সে রবীন্দ্রনাথ
তখন তাঁর লেখনশৈলী, কিম্বা অঙ্কনশৈলী, কিম্বা সঙ্গীতশৈলী, কিম্বা আশ্রমের কর্ণধার
কিম্বা ভারতপথিক নন, অথচ সব মিলিয়ে কিছু একটা। এই ‘কিছু একটা’-কে নানাজনে নানাভাবে
ধরতে চেয়েছেন। কেউ সঙ্গীতে, কেউ অঙ্কনে, কেউ বা স্মৃতিচারণে।
রাণী এবারে ধরেছেন কথপোকথনে।
“দেখো, এই সংসারটা মোটেই ভালো জায়গা নয়। চার দিকে এমন দুঃখকষ্টে ঘেরা --- চার দিকে
এর এমন অন্ধকার। ভালো আর লাগে না। রাতে যখন শুতে যাই এই-সমস্ত গ্লানিতে মন ভরে
ওঠে। আর ইচ্ছে করে না চলতে, ইচ্ছে করে না কোন কাজ করতে এই সংসারে।” --- শুরুতেই
বলছেন রবীন্দ্রনাথ। ৭ই জুলাই ১৯৩৪। এই যে তাঁর বলা, এ হঠাৎ করেই বলা। চিঠিতে যেমন
হঠাৎ করে একটু অগোছালো বলা হয়, এই কথন তেমনই হঠাৎ করে সম্পূর্ণ আনমনা হয়ে বলা। আর
আমরা জানি, আনমনা মানুষের ভাষ্যে মানুষের ভেতরের অবস্থাটার অনেকটা আটপৌরেভাবেই ধরা
পড়ে। রবীন্দ্রনাথ রাণীর কাছে ধরা পড়ে গিয়েছিলেন, বারবার, আটপৌরেভাবে।
কতরকম সে-সব টুকরো কথা, “দেখ্
--- সংসারের একটা যে-কোন জায়গায় কিছু আয় করা প্রত্যেক মেয়েরই দরকার বলে আমার মনে
হয়। ... একটা নিজস্ব জোর থাকা খুবই প্রয়োজন মেয়েদের পক্ষে।” ... বলছেন রবীন্দ্রনাথ
৯ই জুলাই ১৯৩৪-এর এক দুপুরে। হঠাৎ করেই। আমি ভাবি, কবেকার কথা এ? রবীন্দ্রনাথ কবে
থেকেই বলে গেছেন নারীস্বাধীনতার সোপান কি হতে পারে। আর আজ, এখনও, আমরা, অধিকাংশ
নারীরা, বিশেষত গ্রামে-মফস্বলে, সিরিয়ালের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখছি।
শুনেছি, অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। নারীদের অনেকেই স্বাধীনভাবে উপার্জন করছে,
কিন্তু, হায়, প্রায় একশো বছর পেরিয়ে গেছে। যারা পুরুষের আধিপত্যের অভিযোগ করে দায়
এড়াতে চায়, তাদেরকে বলছেন, ২৭শে মে, ১৯৪১ সালে, “ও কথা বোলো না। অনুগ্রহ-নিগ্রহের
কথা ওঠে না। বেশ তো, মানতে রাজি না হও --- মেনো না, কিন্তু ‘কি করব’ ব’লে পুরুষকে
দোষ দিয়ে মাঝামাঝি থাকা ভালো নয়। নিজেদের কর্মক্ষেত্র নিজেরা তৈরী করে নাও, দেখবে
পুরুষেরা বাধা দেবে না, বরং সহায় হবে, পাশে এসে দাঁড়াবে। আজকাল আমাদের দেশেও অনেক
মেয়ে বেরিয়ে পড়েছে --- নিজেদের কর্মক্ষেত্র তৈরি করে নিয়েছে --- খুঁজে নিয়েছে। কই
তাদের তো কেউ অখ্যাতি করে না। হয় মানো, নয় মেনো না। কিন্তু দোষ দিও না, বা
মাঝামাঝি থেকো না --- এই হচ্ছে আমার বলবার বিষয়। প্রথমে হয়তো বিদ্রোহ করতে হয়।
বিদেশেও দেখেছি তাই, কিন্তু পরে পুরুষেরা জায়গা ছেড়ে দেয় --- সরে দাঁড়ায় ---
সত্যিকার কাজের ক্ষেত্রে তারা বিরোধ করে না।”
কি সাঙ্ঘাতিক একটা কথা রাণীকে
বলছেন, “মুক্তি দে, তবে মুক্তি পাবি --- নিজের জন্য কাউকে বাঁধতে চাস নে, তা হলে
নিজেই তাতে বন্দী হবি।”
রবীন্দ্রনাথ মুক্তি পেতে
চেয়েছিলেন। জীবনের শেষের দিকে কাজের বোঝার থেকেও ভারী হয়ে উঠেছিল আপনজনের কাছে
থেকেও দূরত্বের বোঝা। ৭ই এপ্রিল ১৯৩৯–এর দুপুরে তাঁর কথাগুলো আর্তনাদের মতো লাগে,
“পারিস তোরা আমাকে আবার ফিরিয়ে দিতে আমার সেই ছেলেবেলার দিনগুলি --- যেখানে কোনো
দায়িত্ব নেই, কর্তব্য নেই? মহা আনন্দে দিনগুলো কাটিয়ে দিতুম তবে।”
রবীন্দ্রনাথ নিজেকে দেখেছেন,
নিজের সৃষ্টিগুলোকে দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি জানতেন তাঁর অধিকাংশ সৃষ্টিই বর্জিত হবে
কালের নির্মম আঘাতে, “এই ধরো-না, তোমার ছেলেই আমায় গালাগালি দেবে; বলবে যে-কালে
রবীন্দ্রনাথ এই-সব লিখেছেন, সেটা ছিল ‘প্রিমিটিভ যুগ’। সুক্ষ্ম মনস্তত্ব এতে
কোথায়। কত গালিগালাজই তখন আবার এদের কাছে খেতে হবে।” রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন,
মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণের যুগ আসছে। তিনি দেখতে পেয়েছিলেন, এইসব পরকীয়া, ড্রামা,
মেলোড্রামা ইত্যাদি থেকে বিশ্বসাহিত্য সরে আসবে। দস্তয়েভস্কির যুগকে ঠেলা দেবে
কাম্যু-মার্কেজের লেখনী। তারও পরিবর্তন আসবে, মুরাকামি-কোয়েলহো-এটউডের হাত ধরে।
এরকমভাবেই চলতে থাকবে সাহিত্যের ধারা, জনমানসে। কেবল বাংলা সাহিত্য ঐ একই
গ্যাদগ্যাদে প্রেমের তুষের ধিকিধিকি গোপন আগুনে সুখ খুঁজবে, এরা পারলে ভুতের
কিম্বা তন্ত্রের মধ্যেও পরকীয়া-আতুপুতু-বিষাক্ত প্রেম মেশাবে --- তারাশঙ্কর-বিভূতিভূষণের
রবীন্দ্রনাথ বোধহয় এই বাস্তবটা টের পান নি, পেলেও বিশ্বাস করেন নি। অথচ, আজ তা মর্মান্তিক
সত্য!
এর পেছনের বাস্তব সত্যটা কি? কেন
এমন অবস্থা হবে সাহিত্যের কিম্বা শিল্পের? “লিখেছি, ছবি এঁকেছি, গান্ গেয়েছি ---
আনন্দ পেয়েছি। তাতেই সন্তুষ্ট থাকলে হত। কিন্তু তা নয় --- মানুষ চায় মানুষের কাছ
থেকে রিকগ্নিশন; চায় সবাই বলুক, “বাঃ, বেশ হয়েছে, সুন্দর হয়েছে।” এই যে নামের
একটা মোহ --- এ কিছুতেই এড়ানো যায় না।” রবীন্দ্রনাথও এড়াতে পারেন নি, কিন্তু
বারবার বেরিয়ে এসেছেন তা থেকে। এই মোহ তাঁকে কিছুতেই পেড়ে ফেলেও পেড়ে ফেলতে পারে
নি। আর পারে নি বলেই তিনি এত বহুত্বে একত্ব লাভ করতে পেরেছিলেন।
একদম শেষ বয়সে রবীন্দ্রনাথকে
শান্তিনিকেতনের গরম পেড়ে ফেলেছিল। ঘরে এসি লাগাতে হয়েছিল। এরই মধ্যে,
আধোঘুম-আধোজাগরণে, জীবনের একেবারে শেষপ্রান্তে, এক রাত্রিশেষে লিখে যাচ্ছেন, “সত্য
যে কঠিন / কঠিনেরে ভালোবাসিলাম।” সকালে উঠে যোগ করছেন আরও কয়েকটি লাইন, রাণীর
অনুলিখনে, যার প্রথমটা হল,
“সে কখনও
করে না বঞ্চনা...”
=========================
আলাপচারী রবীন্দ্রনাথ
রাণী চন্দ
বিশ্বভারতী পাবলিকেশান
মুদ্রিত মূল্যঃ ১৮০ টাকা
Comments
Post a Comment