পঞ্চায়েতঃ সিজন ৩

 


মানুষে মানুষ থাকে। সে মানুষ শাহরুখ কিম্বা রজনীকান্তের অভিনীত চরিত্রের মতো Larger than Life নয়। সে মানুষ মাটিতে পথ হাটে। সে মানুষে বিষাক্ত প্রেম আছে। সে মানুষে অভিমান, ভয়, হিংসা আছে। সে মানুষে প্রতিরোধ আছে। সে মানুষে ভালোবাসা, দয়া, করুণা আছে।

আমার সেই মানুষদের দেখতে বড়ো ভালো লাগে।

সেই মানুষ কথায় কথায় অপার্থিব ধর্মীয় সুখানুভূতির কথা বলে না। সেই মানুষ ভয়ঙ্কর প্রতিশোধের আগুনে আশেপাশের সবাইকে পুড়িয়ে দেয় না। সেই মানুষ দর্শনের বেলাগাম শব্দের অতিপ্রয়োগ ঘটায় না। সে মানুষ বার্বিডলেদের মতো এক কাল্পনিক পৃথিবীতে হাটাচলা করে বোঝাতে চায় না যে, আমরা এই পৃথিবীর মানুষ। সে মানুষ রাবীন্দ্রিক পরিভাষায় কথা বলে বোঝাতে চায় না যে, এলিট ক্লাসের নাগরিকই আসলে হোমো সেপিয়েন্সের প্রতিনিধি।

আমি ইদানীং সেই মানুষ দেখতে চাই --- গানে-গল্পে-কবিতায়-ছবিতে-সিনেমায়।

সে মানুষ মাটির মানুষ। সে মানুষ ঔদ্ধত্বের গান গায়। সে মানুষ বলে, আমার মাথায় যেহেতু বিধায়কের হাত আছে, এতএব, আমি যা খুশি ইচ্ছা করতে পারি। কিছু মানুষ সে ঔদ্ধত্যের আগুনে জ্বালানী দেয়, রাগ কিম্বা লোভ, সেই আগুনের উষ্ণতার ওমে নিজেদের হাত-পা সেঁকতে সেঁকতে কখন যে নিজেদেরই হাত-পা পুড়িয়ে দেয় খেয়ালই থাকে না। হাসপাতালের সামনে একটা থাপ্পরে সে আগুন দপ করে নিভে যায়।

মানুষ বিভীষিকার গান গায়। সে গানের ধাক্কায় একজন মানুষ বুঝতেই পারে না, তার কোথায় ভুল হয়েছে, সে বুঝতে পারে, তার বাঞ্ছিত অনুকূল আচরণ তার সাথে করা হয় নি। একটা রিভলবারের বুলেটে সেই সব আচরণের শেষ দেখতে চায়। সে দেখতে পায় না, সেই গুলীর বারুদের উল্টোদিকে তার জন্যে অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে আছে নির্ভীকতা, তেজ, জাত্যাভিমান আর জনরোষ। ‘এক’ মানুষ কখন যেন ‘বহু’ হয়ে গেছে। সে দেখতে পায় না, বশংবদ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর ভেতরে কতটা ঘৃণা তার জন্যে জমা আছে। তারা সামনে হাত জোড় করে বটে, পেছনে বলে, এই সমস্ত নৃশংস মানুষের সাথে কথা বলতেও তারা ঘৃণাবোধ করে।

ক্ষোভ এক তীব্র বিষ। একটু একটু করে আত্মাকে ক্ষয় করে। ক্ষোভের আগুনে পুড়তে পুড়তে একটা মানুষ ভালো আর মন্দের মধ্যে পথ হারিয়ে মাথা খুঁড়ে মরে। সে কখনও প্রতিবেশীর বৃদ্ধা মায়ের প্রতি খারাপ ব্যবহারের জন্য শুধুমাত্র তিরস্কারই করে না, মা-কে ডাক্তার দেখানোরও ব্যবস্থা করে। আবার, বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়েও পড়ে একসময়। মৃত্যুর সামনে এসে মৃত্যুদাতার কাছে হাতজোড়ও করে, কারণ, অনেক মানুষের জীবন, যার মধ্যে তার চিরকালীন শত্রুরাও আছে, তারাও বিপন্ন। মানুষ মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায়। এই ক্ষোভই আবার উল্টো কাজ করে পরক্ষণেই। বন্দুকের নলের সামনে সেই মানুষগুলোকেই আবার দাঁড় করিয়ে দেয়। ক্রুরতা, নিষ্ঠুরতা আর জান্তব বীভৎসতার সামনে তার ভেতরের ভালো মানুষটা মাথা নত করে। ক্ষোভকে প্রশ্রয় দিলে মানুষ যে কতটা নীচে নামতে পারে, এ একটা বড়ো উদাহরণ।

একাকীত্ব বড়ো বালাই। কেউ একাকীত্ব বেছে নেয়। কেউ একাকীত্বের সাথে লড়াই করে। জলের ট্যাঙ্কের ওপর কেউ চায়ের ফ্লাস্ক নিয়ে চড়তে চায়, কেউ বা মদের বোতল নিয়ে চুপটি করে পড়ে থাকে। একাকীত্বের সামনে মানুষ বড়ো অসহায়, আবার একাকীত্বই মানুষকে নীরবে প্রস্তুতি নিতে সহায়তা করে, জীবন জয়ের প্রস্তুতি। একটু ভালোবাসার প্রস্তুতি। প্রস্তুতি, নিজেকে আরও বড়ো জায়গায় নিয়ে যাওয়ার। একাকীত্বই মানুষকে গাছের ছায়ায় নিয়ে আসে, একাকীত্বই মানুষকে এক জ্বলন্ত রোদেলা মাঠের মাঝখানে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করায়।

      বিদ্রোহের সামনে পর্বত মাথা নত করে। বিদ্রোহের সামনে রাজনীতি মাথা নত করে। বিদ্রোহের সামনে ঔদ্ধত্য পিছনে সরতে শুরু করে। যে বিদ্রোহী, যার আত্মাভিমান আছে, সে কখনও পিছু হটে না। তার দুইপাশে সাক্ষাৎ মরণ এসে বিড়ি চাইলেও পিছু হটে না। সে তাদের চোখে চোখ রেখে দেখে। সে বিড়ি খেতে খেতে হঠাৎ উঠে পিছন ফিরে মৃগদৌড় দেয় মাঠ-ঘাট ছাড়িয়ে, সীমানা পেরিয়ে। বন্দুকের নল কিম্বা মানুষের ভীতবাক্য তাকে মাথা নত করতে দেয় না। মানুষই তাকে পঞ্চায়েত অফিসে লুকিয়ে রাখে, মানুষই সেই পঞ্চায়েতের জানালা থেকে শাষায়, মানুষই মানুষের কাছে সেই শাষানির বার্তা পৌছে দেয়, মানুষই তাকে নিগ্রহ করতে আসে, মানুষই সেই নিগ্রহের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। কখন যে এইভাবে, আস্তে আস্তে, এক মানুষ অনেক হয়ে যায়, আবার সেই অনেক মানুষ ‘এক’ হয়ে দাঁড়ায়, খেয়ালই থাকে না।

পঞ্চায়েতের তৃতীয় সিজন দেখার পরে এই কথাগুলোই মনে হচ্ছিল। সচরাচর, এক-একটা সিরিজে হয় কি, সিজনের পর সিজনের মান আস্তে আস্তে কমতে থাকে, খেলো হতে থাকে, টেনে-হিঁচড়ে বাড়ানোর কলাকৌশল চোখের সামনে স্পষ্ট হতে থাকে। ব্যতিক্রম খুব কমই আমার চোখে পড়েছে। ‘পঞ্চায়েত’ ওয়েব সিরিজ একটা ব্যতিক্রম।

      অভিনয়ে আপনি কাকে ছেড়ে কার নাম করবেন? সবাই নিজের জায়গায় সেরাটা দিয়েই চলেছে। আমি বিশেষ করে চারজনের নাম করব। প্রথম, ফয়সল মালিক ওরফে প্রহ্লাদ। দ্বিতীয় সিজনে সে আমার চোখ টেনেছিল। এবারের সিজনে চোখ আটকে রাখল। মনে পড়ে তার নিজের পরিত্যক্ত বাড়ীর একটা ঘরে ধুলোমাখা এক সোফায় বসিয়ে জগমোহনের ঠাকুমার সাথে কথা বলার দৃশ্যটা? কিম্বা একেবারে শেষে জলের ট্যাঙ্কের ওপর থেকে গুলীর প্রত্যুত্তরে গুলীর বজ্রনির্ঘোষ দিয়ে মোক্ষম জবাব দেওয়ার সময় তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ? আমার মনে পড়ে। বারবার মনে পড়ে।

      আর বাকি তিনজন? দুর্গেশ কুমার (ভূষণ), অশোক পাঠক (বিনোদ) এবং বুল্লু কুমার (মাধব)। নেগেটিভ চরিত্রের অভিনয় কিম্বা বোকা বোকা শয়তানি --- যেমনটা গ্রামের অশিক্ষিত মানুষজন করে থাকেন আর কি, তাকে ক্যামেরার সামনে এমন অবলীলায় আনতে পারাটা চাট্টিখানি কথা নয়। যতবারই তারা ক্যামেরার সামনে এসেছেন, বিশেষত, অশোক পাঠক এবং বুল্লু কুমার --- আমায় বিস্মিত করেছে। এদেরকে খুঁজে বের করে, এদের মধ্যে থেকে অভিনয়টা বের করে নেওয়ার হিম্মত দেখিয়েছেন যিনি, সেই পরিচালক দীপক কুমার মিশ্রকে আমার অভিনন্দন।

      সিরিজের একদম অন্তিম লগ্নে পরিচালক চতুর্থ সিজনের বিষয়বস্তুকেও বলে দিয়ে গেলেন। ঝগড়া, ঝঞ্ঝাট, মারপিট... বলুন... এবার কিন্তু মনে হচ্ছে পঞ্চায়েত ইলেকশান চলে এসেছে..., BDO বলছেন থানার অফিসারকে। ভারতবর্ষে পঞ্চায়েত ভোট যে কি বিধ্বংসী পর্যায়ের তা এককথায় বলে দিলেন। যদি চতুর্থ সিজনে সেটা অবলীলায় বিষয়বস্তু করে দেখান, তাহলে, বলতে হবে, আপনার মশায়... জবাব নেই...

=========================================

Panchayat : Season 3

Written by : Chandan Kumar

Directed by : Deepak Kumar Mishra

Starring : Jitendra Kumar, Raghubir Yadav, Neena Gupta, Chandan Roy, Faisal Malik

OTT : Amazon Prime

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে