এখনকার নারীদের একটু অন্যরকম কাহিনী

 



কিছু কিছু সময় আমার বড়ো আক্ষেপ হয়। আক্ষেপ হয় এই ভেবে যে, আমি সিনেমার রিভিউ খুব একটা ভালো করতে পারি না। সাহিত্যের বিদ্যে দিয়ে সিনেমার রিভিউ করলে তা একদৃষ্টি হরিণের মতো হয়ে যায়। সেই সিনেমার রিভিউ অসম্পূর্ন হয়ে যায়।

কিন্তু যখন মনে করি সিনেমা যাদের জন্যে বানানো হচ্ছে তারা কারা? তারা তো আমার মতোই অতি সাধারণ মানব মানবী। আমার মতোই তারা সিনেমার আর্ট ডিরেকশান কিম্বা ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল বোঝেন না। তারা সিনেমার পাল্‌স-টা ধরতে চেষ্টা করেন এবং সেখান থেকেই সেই সৃষ্টির সাথে নিজেদেরকে যুক্ত করতে চান।

তো সেই আঙ্গিকে সিনেমাটা কেমন লাগে সেটা জানানোটাও কি একটা দৃষ্টিভঙ্গী নয়? অবশ্যই একটা দৃষ্টিভঙ্গী। আমি সেই দৃষ্টিভঙ্গী দিয়েই আমার ভালো লাগা মন্দ লাগার কথা জানিয়ে যেতে চাই।

‘লাপাতা লেডিজ্‌’ দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, এ কোন ভূমিপুত্রদের আত্মা মাটি ফুড়ে বের করে এনে কুশীলবদের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছেন কিরণ রাও? প্রতিভা রত্না, বিশেষ করে নিতাংশী গোয়েল বা স্পর্শ শ্রীবাস্তবদের পেজ ত্রি-তে দেখলে তো এক মুহূর্তের জন্যে মনে হয় না যে এই মহিলাটি একটি অজ্ঞাত স্টেশানে একরাত্রি কাটাতে পারে, কিম্বা মনে হয় না মদ্যপ একটি ছেলেকে উঠান থেকে তুলে এনে গ্রাম্য একটি কর্মঠ মেয়ের মতো ধরে বিছানায় শুইয়ে দিতে পারে, কিম্বা খোয়া ওঠা রাস্তার ওপর দিয়ে প্রাণপণে ট্রেনের সাথে পাল্লা দিয়ে সাইকেল চালাতে চালাতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গিয়ে পরক্ষণেই উঠে সেই সাইকেলে চড়ে বসে আবার প্রাণপণে সাইকেল চালাতে পারে! মেথড অ্যাক্টিং আর ক্যামেরার সামনে স্বাভবিক আচরণের মধ্যেকার পার্থক্য এরা ঘুচিয়ে দিল কি করে? সিনেমাটা দেখতে দেখতে আমার কেন জানি না কেবলই ইরানিয়ান সিনেমার অভিনয় মনে পড়ে যাচ্ছিল। অতি অভিনয়ের দূরত্ব কি তাহলে আস্তে আস্তে ঘুচে যাচ্ছে?

কানাঘুষোয় শুনলাম রবি কিষেণের জায়গায় আমির খান অভিনয় করতে চাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু স্ক্রীণ টেস্টের পর কিরণ রাও তাকে বাতিল করে দেন। আমির খান-কে না বলার ক্ষমতা দেখানোর থেকে বড়ো কথা, যে অভিনেতার কারণে তাকে বাতিল করছেন কিরণ রাও সেই অভিনেতা কতটা তার কাছে এই সিনেমার জন্য বাস্তবযোগ্য সেটা সিনেমাটা দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যায়। একই মানুষের মধ্যে লোভ এবং মনুষ্যত্ব বাস করে, যা অতি স্বাভাবিক, এটা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল ভাগ্যিস আমির খান অভিনয় করেন নি।

বিপ্লব গোস্বামীর মূল গল্পটি কেমন তা জানার যো নেই, কিন্তু এই সিনেমাতে যে অতিরিক্ত কিছু চোখে পড়ে না তা বলাই যায়। আঁটোসাঁটো গল্পের ঠাস বুনোট। অহেতুক গানের ভারে ন্যুব্জ নয়, গানগুলি বিরক্তও ধরায় না। বরং গল্পের মাঝে মাঝে, কিছু কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে মহিলাদের সামাজিক অবস্থানটাকে স্পষ্ট করে দেওয়ার যে সাংঘাতিক ক্ষমতা সেটা আমাকে বিস্মিত করে। মেয়েদের ওপর অনেক জোরজুলুম কিম্বা অন্যায় অবিচার হয় ঠিকই, কিন্তু, তা নিয়ে অহেতুক নাকিকান্না, অভিযোগ-অনুযোগ কোত্থাও নেই। স্পষ্ট প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর এবং প্রতি উত্তরের মধ্যে দিয়ে, চিন্তার পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে মেয়েদের অবস্থানের পরিবর্তন --- সিনেমার প্রাণপুত্তলিকোথাও কোন বিদ্রোহ নেই, অথচ বড়ো রকমের বিদ্রোহ আছে। মঞ্জু মাঈ (ছায়া কদম) কি বিদ্রোহ করেন নি? করেছেন, নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন, মানসিকভাবে পিছিয়ে পড়া ভীত ফুল কুমারীকে আশ্রয় দিচ্ছেন, সাবধান করছেন, কিন্তু অহেতুক আবেগপ্রবণ বক্তৃতা কিম্বা নিজের অতীত নিয়ে কাসুন্দি ঘাটছেন না, কাঁন্নাকাটি করে দর্শকের সহানুভুতি আদায় করার চেষ্টা করছেন না। কিরণ রাও-ও ওই পর্যায়ে কোন মেলোড্রামা আনছেন না।

কিরণ রাও জানেন, সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করে গেলে, নারীর কোনদিনও নারী হয়ে ওঠা হবে না, প্রয়োজন নালিশের একঘেয়ে বন্দীত্ব থেকে মুক্ত হয়ে সহজভাবে নিজের সার্থকতাকে খুঁজে নেওয়া। তাই এক পর্যায়ে মঞ্জু বলে ওঠেন, বোকা হওয়ার মধ্যে কোন দোষ নেই, কিন্তু বোকামির গর্ব করাটার মধ্যে কোন শোভনীয়তা নেই। এক পর্যায়ে যশোদা (গীতা আগরওয়াল) তার প্রিয় খাবার আবার বানাতে শুরু করে, নিজের জন্যে, যা তিনি বিসর্জন দিয়েছিলে বিয়ের পরে পরেই, কারণ ওই খাবারটি তার স্বামী-পুত্র পছন্দ করেন নাআরেক পর্যায়ে বেলা (কানুপ্রিয়া ঋষিমুম) ছবি আঁকতে শুরু করে, কারণ সেটাই তার স্বাভাবিক ক্ষমতা। কিন্তু কোথাও কোনও অবস্থাতেই সংসার জতুগৃহ হয়ে ওঠে না। নারীজাগরণের এরকম স্বাধিকারের আদায়ের কথাই কি আমাদের প্রাচীনা নারীবাদীরা কল্পনা করেন নি? বলেন নি? বার বার করে বোঝান নি? এটাই কি নারীবাদের মূলভিত্তি হয়?

আবার সত্যিকারের বিদ্রোহিণী নারীদের সাহায্যে কি পুরুষ এগিয়ে আসেন না? এই সিনেমাতে তাও দেখানো হয়েছেঘুষখোর লোভী পুলিশও একসময় আয়রণম্যান হয়ে যানঅত্যন্ত সাদাসিদে গ্রামের ভীতসন্ত্রস্ত বালকটিও পুলিশের মুখের সামনে রুখে দাঁড়িয়ে বলতে পারে যে, সে তার স্ত্রী-র খোঁজে ততক্ষণ যাবে না যতক্ষণ না জয়া-র সমস্যার সমাধান হয়। এত সাহস আসে কোথা থেকে? এই পুরুষতান্ত্রিক পরিকাঠামোতে? এমনটাও হয়, এমনটাই হয়।

অনেক সমস্যাই এই সিনেমাতে উঠে এসেছে, কিন্তু অহেতুক সেই সমস্যার ভারে সিনেমা জর্জরিত হয় নি। আর জর্জরিত হয় নি বলেই সবস্তরের মানুষের কাছে সিনেমাটা বহুল প্রশংশিত হয়েছে, তারা কমিউনিকেট করতে পেরেছেমাত্র এক কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মিত সিনেমাটা এখনও পর্যন্ত বাইশ কোটি টাকা আয় করে নিয়েছে। সাঙ্ঘাতিক রকমের বিজ্ঞাপন থেকে সরে এসে, চড়া বিনোদনী অভিনেতা অভিনেত্রীদের মুখ না দেখিয়ে কিভাবে সাধারণ মানুষের কাছে সাধারণ মানুষের কথা সাধারণ অভিনেতাদের মুখ দিয়ে বলানো যেতে পারে তার একটা বড়ো উদাহরণ হয়ে রইল এই সিনেমাটি।

 

=============================

 

Laapataa Ladies

Directed by: Kiran Rao

Starring: Nitanshi Goel, Sparsh Srivastav, Pratibha Ranta, Abhay Dubey, Chhaya Kadam, Ravi Kishan

Duration: 124 minutes

OTT Relies: Netflix

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে