সোলারিস : গ্রহের ফেরে মানুষের বিশ্বচেতনার চিরসংশয়

 


যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা বিভাগ থেকে এ বছর বইমেলাতে কামিল শেৎচিনস্কি-র করা অনুবাদ ‘সোলারিস’ প্রকাশিত হয়েছে। ‘সোলারিস’ বিখ্যাত এবং ক্লাসিক উপন্যাস। আন্দ্রেই তারাকোভস্কি এবং স্টিভেন সোডেরবার্গ একে আরও বিখ্যাত করে দিয়েছেন। ফলে প্রকাশনা বিভাগ মনে করছেন যে, সাধারণ পাঠকের এই বইটা সম্পর্কে না জ্ঞাত থাকাটা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। ফলে বইটার কোন মুখবন্ধ নেই। বইটার বিষয়ের সাথে পরিচিত করানো, বইয়ের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া কিম্বা সমকালে বইটার প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে কোন আলোচনার দায়বদ্ধতা থেকে অনুবাদক কিম্বা প্রকাশক নিজেদের মুক্ত রেখেছেনধুম করে বইটা শুরু হয়েছে এবং অসংখ্য ছাপার ভুল সহযোগে, ভুল বাক্যের বিভ্রান্তি দিয়ে, অদ্ভুত সব শব্দের বঙ্গানুবাদের প্রয়োগে একরকম বিস্মিত হয়ে, বিভ্রান্ত হতে হতে, হোঁচট খেতে খেতে উক্ত উপন্যাসটা শেষ করার পর ভাবছিলাম, ইংরাজীতে বইটা পড়লে সময়ের এবং খরচের দিক থেকে কতটা লাভবান হতাম?

      স্তানিস্লাভ লেম-র ‘সোলারিস’ সায়েস্ন ফিকশান গল্প। গল্পটার কাঠামোর দিকে যদি নজর দেওয়া যায়, তাহলে মোটামুটিভাবে বলা যায়, ‘সোলারিস’ নামক একটি গ্রহে মানুষ কলোনী গড়েছে, মূলত গবেষণাগারসেই গ্রহে একটি মাত্র মহাসাগরীয় জৈবিক প্রাণ। অত্যন্ত বুদ্ধিমান এই প্রাণসত্ত্বা মানুষের স্মৃতির ভিতর প্রবেশ করে অতীতের মানুষকে সামনে আনতে সক্ষম। কেলি্‌ভন যখন প্রথম সোলারিসে পৌছল তখন সেখানে মাত্র দুজন মানুষ, দুই অর্ধোন্মাদ বিজ্ঞানী, স্নাউট এবং সার্তোরিয়াস। তৃতীয়জন সদ্য আত্মহত্যা করেছে। কেলি্‌ভন কিছুদিনের মধ্যেই আবিস্কার করে হারেয়কে। তার প্রেমিকা, যে পৃথিবীতে থাকাকালীন আত্মহত্যা করে। আস্তে আস্তে সোলারিসের রহস্যচৈতন্যের চক্রব্যুহে পড়ে যায় কেলিভ্‌ন। সোলারিসের রহস্যচৈতন্য? কিম্বা তার নিজের অন্তরের মগ্নচৈতন্যের আলো-আঁধারি? গল্প এগিয়ে চলে।

      মোটামুটিভাবে উপন্যাসটার দুটো বড়ো দিক আছে। দর্শন এবং মনস্তত্বের একটি জটিল আলেখ্যএছাড়াও অন্যান্য দিকগুলোকে যদি ভালোভাবে লক্ষ্য করা যায় তাহলে এই উপন্যাসের যে মূল ‘কনসেপ্ট’ তা হল চেতনার বাস্তবিকতা, মানব সম্পর্ক, এবং মানুষের বোধের সীমাবদ্ধতা --- “আমরা ... তাই একাকীত্ব, লড়াই, মৃত্যু কোনটাই ভয় করি না। অতি বিনয়ের জন্যে এগুলি নিয়ে আমরা উচ্চবাচ্য নই, তবে মাঝে মাঝে মনে মনে ভাবি আমরা কত না মহান। এর মধ্যে আমরা মহাকাশ জয় করতে চাই না, আমরা শুধু পৃথিবীর পরিসর বাড়াতে চাই। কোন গ্রহ হবে সাহারার মতো বালিভরা, কোন গ্রহ হবে ব্রাজিলিয়ান জঙ্গলের মতো আরণ্যক। আমরা মানববাদী তাই আমরা অন্য প্রজাতি দখল করতে চাই না, আমরা শুধু তাদের আমাদের মূল্যবোধ অনুদান করার জন্যে প্রতিদান নেব তাদের ঐতিহ্যর। আমরা নিজেদের পবিত্র যোগাযোগের ধর্মযোদ্ধা বলে মনে করি। এটা আর একটা মিথ্যে কথা। আমাদের অন্য জগত দেখার দরকার নেই। আমাদের আয়না চাই। অন্য জগত নিয়ে কি করব জানি না। একটাই যথেষ্ট, তাও তার মধ্যে খাবি খেয়ে মরি। আমরা আমাদের নিজস্ব আদর্শ মূর্তির খোঁজে মরিয়া; কিছু জায়গায় খুঁজি আমাদের চেয়ে উন্নত সভ্যতা, যার এক জায়গায় আমাদের পিছিয়ে-পড়া ইতিহাসের ফসিল। এখন অপারে যা খুঁজে পাওয়া গেছে তাকে ধরার আমাদের সাধ্য নেই, তার থেকে আমরা ভয়ে থাকি, অথচ মাহাত্ম্যের পাথেয়টুকু ছাড়া আর কিছু আনিনি পৃথিবী থেকে! আমরা যেমন আছি, তেমনি করে এলাম এজন্য অপারটি যখন আমাদের চেপে রাখা প্রবৃত্তি আমাদের চোখের সামনে তুলে আনছে তখন আমরা কিছুতেই তাকে মানতে পারছি না।”

      বলা বাহুল্য, উপরোক্ত অনুবাদে যদি বাক্যের দুরূহতায় আপনার চোখ কুঁচকে যায়, তাহলে তার দায় এই অভাগিনীর নয়, ইনি কেবলমাত্র লেখাটিকে কপি করেছেন মাত্র।

      আবার মূল বিষয়ে আসা যাক, এই উপন্যাসের সবথেকে উপজীব্য বিষয় কেলি্‌ভন-হারেয় ব্যক্তিস্বত্ত্বার দ্বন্দ্ব। যাকে আমরা অতীতে হারিয়ে ফেলি এবং হারিয়ে ফেলার পরমুহূর্তেই বুঝতে পারি, আমার জীবনে সে কতটা প্রয়োজনীয় ছিল, অথচ, সেই সময়ে, তাকে কেবলমাত্র আমার স্বার্থের সাথে মিলিয়ে নিয়েছি, কিম্বা বলা ভাল, ব্যবহার করেছি, সেই মানুষটি, যদি, আবার আমার জীবনে ফিরে আসে, তখন, তাকে কিভাবে গ্রহণ করব? তাকে কি আদৌ গ্রহণ করতে পারব? হারানিধিকে ত্যাহ্য করার পর, হারিয়ে গ্রাহ্য মনে হলে, ফিরে পেয়ে কি হবে? ত্যাহ্য-গ্রাহ্যের মধ্যেকার এক টানাপোড়েনের নামই হল ‘সোলারিস’।

      মানব জগতের চেতন সত্ত্বার দ্বন্দ্বটাই বা কীরকম? চৈতন্যের মহাসাগরের মধ্যে নিজেকে কি ক্ষুদ্র এবং তুচ্ছই না লাগে! তবুও আমরা সেই মগ্নচৈতন্যের আস্বাদ পেতে চাই। তাকে জয় করতে চাই। তাকে প্রয়োজনে ধ্বংস করার আস্বাদও পেতে চাই। এই চৈতন্যের দ্বন্দ্বই হল ‘সোলারিস’

      পৃথিবী নিজেই রহস্যময়ী তার এই রহস্যময়তার ওপারে, বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডের রহস্যময়তা আরও ভয়ানক এবং জটিল। মানবচেতনার সীমাবদ্ধতার সংকেত এই বই জুড়ে। সোলারিসের রহস্যময়তা চিরকালই আমাদের কাছে রহস্য থেকে যায়। কিন্তু মজার ব্যাপার, আমরা সেই সীমাবদ্ধতাকে মানি না। বইয়ের পর বই জুড়ে আমরা সেই সীমাবদ্ধ চেতনসত্ত্বার জাহির করে নিজেদের আরও অন্ধকারে ঠেলে দিই, কিম্বা নিজেদের এই জ্ঞানই নিজেদের বিরুদ্ধ হাতিয়ার হয়ে মূল জ্ঞানের থেকে অনেক দূরে আমাদেরকে ঠেলে দেয়। এই সীমাবদ্ধতার সংকেতই হল ‘সোলারিস’

      আমাদের স্মৃতি এবং আবেগ কতটা আমাদের বন্ধু, আর কতটাই বা আমাদের শত্রু? আমরা কি তা কখনও ভেবে দেখেছি? আমাদের স্মৃতি কখনও কখনও আমাদেরকে চার দেওয়ালের মধ্যেই আটকে রাখে। আমাদের আবেগ আমাদের আত্মহতারও কারণ হয়। স্মৃতি এবং আবেগের টানাহ্যাঁচড়ায় আমাদের ভেতরের কোন আসল মানুষটা পড়ে থাকে? তাকে কি আমরা খুঁজে পাই? এই প্রশ্নচিহ্নের নামই হল ‘সোলারিস’

      আমাদের অস্তিত্বের অর্থ কি? I exist, আমি আছি --- এই ভাবের সার্থকতা কি? আমরা কি কারোও স্বাপেক্ষে অস্তিত্ববান? আমরা কি আদৌ আসল? আমাদের স্মৃতি এবং চেতনাবোধ আমাদের যে অস্তিত্বের কথা বলে তা কতটা যুক্তিযুক্ত? কেলি্‌ভন-এর সামনে যখন হারেয় এসে উপস্থিত হয়, তখন এই বিশ্বজনীন প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার নামই হল ‘সোলারিস’

      প্রসঙ্গত, এই চৈতন্যের দ্বন্দ্বে এবং সম্পর্কের টানাপোড়েনের যে স্তরবিন্যাস এই উপন্যাসে আছে তাকে যদি পর্যবেক্ষণ করা যায়, তাহলে, কতকগুলি বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায় --- ১) শোক এবং ক্ষতি, ২) অনুশোচনা এবং অপরাধবোধ, ৩) একাকীত্ব এবং বিচ্ছিন্নতা, ৪) কারো যাথে যুক্ত হতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা এবং ৫) অস্তিত্বগত ক্ষোভ। এই উপন্যাসের মূল চরিত্র কেলি্‌ভন এই প্রত্যেকটা স্তরের সঙ্গে লড়াই করতে করতে এগিয়ে যায়। তার স্মৃতি তার স্বত্ত্বার সামনে প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়ায়। এই দ্বান্দ্বিক সজ্জবিন্যাসের রূপরেখাই হল ‘সোলারিস’

      একটি কল্পবিজ্ঞানের উপন্যাসে কতই না স্তর থাকে! নিত্যপরিচিত ড্রামা থেকে সরে এসে একটি কল্পনার বিশ্বের মধ্যে মানুষকে দাঁড় করিয়ে সেই চিরকালীন রহস্যময় সমস্যার উত্তর খুঁজতে যাওয়ার চেষ্টাই অবশেষে হয়ে দাঁড়ায় স্তানিস্লাভ লেম নামক পোলিশ লেখকের হাতে ‘সোলারিস’ নামক উপন্যাস।

======================

সোলারিস

স্তানিস্লাভ লেম

অনুবাদকঃ কামিল শেৎচিনস্কি

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশন

মুদ্রিত মূল্যঃ ৩০০ টাকা

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে