সত্যজিতের ছাত্রসত্তার খোঁজে
বাংলার শেষ জনপ্রিয় আবেগময় মহাকূলপ্রদীপ সত্যজিৎ
রায়কে নিয়ে এত কিছু লেখা হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে যে, তার মধ্যে আমার কিছু বলা মানায়
না। আমি সিনেমা বিশেষজ্ঞা নই। সত্যজিৎ রায়ের কিছু সিনেমা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি,
কিছু সিনেমা দু-একবার দেখেছে, বেশ কিছু সিনেমা দেখা বাকি আছে। পথের পাঁচালী
ফ্রান্সে Best Human
Document Award না পেলে লোকটার কি দুর্গতি হত বলা মুশকিল। অস্কার
পুরস্কারটি তাকে সর্বকালের জাতে তুলে দিয়েছিল বটে, তবে বাঙালী তাকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ
শিশুসাহিত্যিক থেকে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকের তকমা দিয়ে দিয়েছে। এখনও তার
গল্পের বই আপামর বাঙালীরা বইমেলায় লাইন দিয়ে কিনে থাকেন। অনেক বাঙালি শিশুরা এখন
অবশ্য তার বইয়ের ট্রান্সলেটেড ভার্সান পড়ছে। তার বই এখনও ‘হট কচুরী’।
আমার
কাছে সবচেয়ে বিস্ময় মানুষটার মস্তিষ্ক। রবীন্দ্রনাথের পর অতবড় ভার্সেটাইল বাঙালী আর
জন্মেছে কি? সোজা উত্তর – না। তার ছবি, তার সঙ্গীত, তার সংলাপ, তার চিত্রকলা, তার
ইলাস্ট্রেশান এই সব কিছুর পেছনে একটাই ব্যাপার কাজ করেছে। তা হল তার ‘মগজাস্ত্র’। যে মগজাস্ত্রে তিনি দেশ
বিদেশের শিল্পকলার অন্তরস্থিত চেতনাকে আত্মীকরণ করেছেন এবং নিটোল বাংলায় তার
অনেকখানিরই সার্থক রূপদান করেছেন। সত্যজিৎ কথাপ্রসঙ্গে বলছেন, “বই! সারাক্ষণই তো
কিছু না কিছু পড়ছিই। মিডিয়াও তো আছে, ফিল্ম দেখছি, তাছাড়া চলচ্চিত্রে তো পৃথিবী
সম্পর্কে খুব একটা জ্ঞান প্রকাশ করি বলে মনে হয় না। আমার ছবি তো হয় কলকাতা, নয়
বাংলাদেশ কিংবা ভারতবর্ষ নিয়ে। সে-সব তো অভিজ্ঞতা, স্মৃতি থেকেই আসে। তবে হ্যাঁ,
আমার লেখালেখিতে জগতের নানা তথ্য সারাক্ষণ ব্যবহার করছি যা জেনে ফেলি বই পড়ে পড়ে।
নানা বই পড়ার অভ্যাস তো আছেই, বিশেষত নন-ফিকশন।”
আমার
সেই সত্যজিতকে জানতে ইচ্ছে করে, যে সত্যজিৎ তার একান্ত সময় কাটাচ্ছেন। সেই একান্ত
সময়ে তার হৃদয় এবং মস্তিষ্ককে পূর্ণ করছেন মানবতার ছোট ছোট টুকরো দিয়ে, যার পোষাকি
নাম ‘শিল্প’। চোখের
অপারেশান হল। এখন বেশ কিছুদিন বিশ্রাম। সত্যজিৎ রায় পড়ে ফেললেন দস্তয়েভস্কির ‘দ্য
ব্রাদার্স কারামাজোভ’। দস্তয়েভস্কি, ফ্লোব্যের, মান সম্পর্কে বলছেন, “ওসব লেখার
স্কেলটাই আলাদা। আজকের আধুনিক লেখকরা যে কথা একটা পরিচ্ছেদে সেরে ফেলবেন তাই ওঁরা
বলে যাচ্ছেন একশ’, সওয়া শ’ পাতা ধরে। আর কি ডিটেল, কী পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ।
একেকটা মহাকাব্যই যেন।” মনে রাখতে হবে, পরিচালক সত্যজিৎ ডিটেইলিং নিয়ে কিন্তু
মারাত্মক রকমের খুঁতখুঁতে ছিলেন।
পাঠক
সত্যজিতের যাদের লেখা ভাল লাগত তাদের স্পষ্ট দুটো ভাগে ভাগ করেছিলেন। কিছু লেখকদের
তিনি পড়তেন জীবন ও জগতকে জানার এক প্রেরণা থেকে, নিছক স্টাইল বা বিনোদন সেখানে
ধর্তব্য নয়। দস্তয়েভস্কি, কাম্যু, কাফকা বা মান এই ধারার লেখক। আর এদের পাশাপাশি
কিছু কিছু লেখকের প্রায় সব বই পড়ার আনন্দে পড়ে ফেলা, যেমন ডয়েল, যেমন অগাথা
ক্রিস্টি, যেমন উডহাউস। তার মতে এই সমস্ত লেখকের রয়েছে অসাধারণ বিনোদনী শক্তি!
মানুষটা
দাবা খেলতেন। নর্মান ক্লেয়ারের সাথে বিখ্যাত দাবাড়ুদের দাবার চালের ছক মিলিয়ে
মিলিয়ে আলোচনা করতেন। লেখক সত্যজিৎ বেথোভেন, বাক, মোৎসার্ট থেকে শুরু করে
রবীন্দ্রসঙ্গীত, ব্রহ্মসঙ্গীত পর্যন্ত যে কি মারাত্মক রকমের গভীরতায় শুনতেন ও
অনুভব করতেন তা আমরা সকলেই অল্পবিস্তর জানি।
সত্যজিৎ
রায় যদি নব্বই বছর বাঁচতেন, তাহলে আশি বছর বয়স অবধি ছবি করতে চাইতেন। যাদের জন্যে
ছবি করতেন, তাদের সম্পর্কে কি ভাবতেন তিনি? তিনি বলছেন, “দর্শক একটা তৈরি হয়েছে
মোটামুটিভাবে। যাকে আইডিয়াল দর্শক বলে সে আমাদের দেশে নিশ্চয়ই নেই। সে ধরনের
চলচ্চিত্রবোধ এখনও ব্যাপক ভাবে হয়নি। তো সেটা আমাদের মেনে নিতেই হয়েছে। এবং তার
মধ্যেই আমাদের যা কাজ করবার করতে হয় একটা আশা নিয়ে যে এতদিনে হয়ত বোদ্ধাশ্রেণির
সংখ্যা আরেকটু বেড়েছে।” এখনকার বাংলা সিনেমা, ওয়েব সিরিজ কিম্বা বাংলা সিরিয়াল
দেখলে সেইসব দর্শকদের সম্পর্কে কি মন্তব্য করতেন তিনি?
উপন্যাস লিখতে চান নি মানুষটা। কারন? তার মনে
হত, “উপন্যাসের মতো কোন থিম মাথায় এলে তা ফিল্ম সিনারিওতে চলে যাবে।” আরও বলছেন,
“এমনিতে বাংলায় ফিল্মেবল অর্থাৎ ফিল্মের উপযোগী গল্পের যে খুব প্রাচুর্য আছে তা তো
নয়। বরং নেই। অনেকই তো পড়ি, আর পড়ে পড়েই মনে হয়েছে... যে অনেক অনেক বিলিতি সাহিত্য
যখন পড়ি তখন দেখি ফিল্মের পক্ষে কী রকম তৈরি... ফিল্ম করার সম্ভাবনা কত বেশি, ছবি
হয়ও। বাংলা পড়ে কিন্তু সেরকম খুব একটা মনে হয় না।”
এই
দ্রষ্টা সত্যজিৎ, যার দৃষ্টিশক্তির সীমানাকে তিনি তার জীবদ্দশায়, প্রতিদিন, প্রতি
মুহূর্তে, একটু একটু বাড়িয়েছেন, আর চলে গেছেন দেশ-কাল-পাত্রের গন্ডীর বাইরে, সেই
সত্যজিতকে জানতেই আমার বড়ো বেশি মন চায়। আজকের সোশাল মিডিয়ার যুগে বেশিরভাগ বাঙালী
লেখক হতে চায়। আমি পাঠিকা হতে চাই। আর সত্যজিতের কাছে আমি চাই, ‘পাঠিকা’ হওয়ার পাঠ
নিতে...
[ বই থেকে একটু অংশঃ
সত্যজিত বলছেন, এটা পেতে হবে, ওটা হতে হবে এসব
উচ্চাকাঙ্খা আমার কোনদিনই নেই।
জিজ্ঞেস করলাম, অর্থ, সন্মান, উপাধি...
সত্যজিৎ নীরবে মুখের ভঙ্গিতে বোঝালেন, যার অর্থ
‘ধুস্!’ ]
===================
সত্যজিৎকে নিয়ে
শঙ্করলাল ভট্টাচার্য
সুমিত্রা প্রকাশনী
মুদ্রিত মূল্যঃ ৭০ টাকা
Comments
Post a Comment