অ্যালিস মুনরো, আপনি কোথায়?

 



অ্যালিস মুনরো মারা গেলেন। ১৩ই মে ২০২৪। অ্যালিস মুনরো ‘নোবেল’ পুরস্কার পেয়েছেন ২০১৩ সালে। উইম্যান হয়ে ‘ম্যান বুকার প্রাইজ’ পেয়েছেন। পেয়েছেন কানাডার গভর্নর জেনারেল পুরস্কার, তিনবার। যারা এইসব ‘ছোটখাটো’ পুরস্কারকে পাত্তা দিতে নারাজ তাঁদের বলি, তাঁর ছোটগল্প কখন যে চিরন্তনী কথা হয়ে গেছে, বিশ্ব টেরও পায়নি, কেবল অজ্ঞাতসারে আপন করে নিয়েছে মাত্র।

      শুনেছি তাঁর ছোটগল্প ম্যাজিকের মতো। ছোটগল্পই লিখেছেন বেশি। মেয়েদের কথা লিখেছেন। তাঁদের ছোট ছোট সুখদুঃখকে বলেছেন। সেই লেখায় নারীদের ওপর অত্যাচার নিয়ে অহেতুক কান্নাকাটি নেই। ‘আমরা কতো অসহায়’, এই বেদনা নিয়ে অযথা চেচামেচি নেই। বদলে আছে নারীদের ‘নারীত্ব’ নিয়ে সত্যিকারের গল্প। যে নারীত্ব জীবনের মুখোমুখি হয়ে জীবনকে দেখে, দেখে তার উথালি পাথালিয়া, চাওয়া পাওয়া, অসহায়ত্ব, তার আটপৌরে সাধারণী আত্মপ্রকাশ। তাঁর গল্পে ‘নারীবাদ’ চিরন্তনী স্নিগ্ধতা নিয়ে ধরা দেয়। যা একরকম নিত্যকালের চিরপুরাতন। চরমপন্থী নারীবাদী লেখিকা মার্গারেট এটউড পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছেন, “Alice Munro is among the major writers of English fiction of our time. . . . Among writers themselves, her name is spoken in hushed tones.” খুঁজেপেতে আমার বন্ধু সমর্পিতা তাঁর একটা বই নামিয়ে দিল --- Alice Munro’s Best, দেখলাম মার্গারেট সেই বইয়ের ইন্ট্রোডাকশান লিখেছেন এবং শুরুই করছেন উক্ত কথাগুলো দিয়ে।

      একটা নির্দিষ্ট পরিচিত সীমানার বাইরে আমরা যেতে পছন্দ করি না। ভয় পাই কি? না কি ‘কমফোর্ট জোন’ তত্ত্ব? কিন্তু যাই হোক না কেন, আমরা অ্যালিস মুনরোকে চিনি না। ফলে তাকে নিয়ে কোন কলাম চোখে পড়ে নি। বাংলা ছোটগল্পের ইতিহাস এক বিরাট ইতিহাস। সে ইতিহাসে অনুবাদেরও মাহাত্ম ছিল। ফলে সেই ইতিহাসে এই ঋদ্ধতা ছিল। কিন্তু আজ? সেই ইতিহাসের মোড়ে মোড়ে যারা ছিলেন, তাঁদের নিয়ে আমরা মাতামাতি করি, কিম্বা একই পথের সমান্তরালে আরেক চেনা পথ তৈরী করে সেই পথ ধরে চলি। থোড়-বড়ি-খাড়া। আজ আর নতুন পথের কোনরকম কোন চিহ্নই নেই। আর একটা বড়ো কারণ, বহির্বাংলা থেকে আসা কোনরকম কোন পথনির্দেশকে আমরা একরকম ‘ব্যান’-ই করেছি নিজের হাতে। এতএব, অ্যালিস মুনরোকে নিয়ে আমরা উদাসীন। সীমার বাইরে পা দেওয়ার ক্ষমতা যে আমরা হারিয়েছি!

      অ্যালিস মুনরো-র একটি বই কিভাবে যে আমার আলমারীর ছায়াচ্ছন্নতায় রয়ে গেছে, মনেও ছিল না। আজ তাকে আবার বের করেছি। অনেক বই কেনা হয়, পড়া হয় না, জমানো হয় মাত্র। অ্যালিস মুনরো আমার জীবনে তেমনই একটা উদাহরণ। বাংলাদেশ থেকে করা একটি মাত্র অনুবাদই আজ আমার হাতে। পশ্চিমবাংলায় এসব ‘ছেদো’ লেখিকাকে নিয়ে মাতামাতি করার কোন মানে হয় না ভেবে, কপিরাইটের কুমীর দেখিয়ে, কোনরকম কোন অনুবাদই হয় নি, অন্তত আমার জানা নেই। বাংলাদেশে ওনার আরও দুটি বইয়ের অনুবাদ হয়েছে বটে, কিন্তু এই মুহূর্তে হাতে পাওয়ার সম্ভবনা নেই বলে ইংরাজী বই দিয়েই কাজ চালাতে হবে। আমার কাছে যে অনুবাদ আছে, তাঁর শিরোনাম ‘পলাতক’। সম্ভবত তাঁর বিখ্যাত বই Runaway–এর অনুবাদ। অনুবাদিকা কোনরকম কোন ইতিহাস, নির্দেশিকা দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন নি। কোন ভূমিকা নেই। তাকে নিয়ে কোন প্রবন্ধও নেই। কেবল ব্লার্বে দায়সারাভাবে কিছু তথ্য দিয়ে কাজ সারা হয়েছে। তবুও হয়েছে, একটা অনুবাদ। তাঁর মান কেমন, এবার ঠাহর পাব।

      অ্যালিস মুনরো জীবনের সীমানা পেরিয়ে জীবনকে দেখেছেন, অন্য দেশে, অন্য ভাবে। আমিও তাঁর সাথে তার সৃষ্ট জীবনবিশ্বকে দেখতে ইচ্ছুক। আমি কয়েকজন লেখকের নামাবলী দিয়ে কোলবালিশ বানিয়ে বুকের কাছে জড়িয়ে নিশ্চিন্তে নিদ্রা যেতে চাই না। আমি গভীর রাতের নিদ্রাভাঙা স্বপ্নকে দেখতে চাই, তা বাস্তব হবে না জেনেও... অ্যালিস মুনরো কি সেই পথ দেখাবে আমাকে?

===========================

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে