গুরু-সান্নিধ্যে

 



চিত্রকর রাণী চন্দের প্রায় সমগ্র জীবনটাই কেটেছে শান্তিনিকেতনে। এবং, এর মধ্যে প্রথম অর্ধ কেটেছে রবীন্দ্রসান্নিধ্যে। এই রবীন্দ্রসান্নিধ্য আবার যেমন তেমন করে নয়। একটা পর্যায় তো কেটেছে একেবারে প্রতিবেশী হিসাবে। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ যে বাড়িতে থাকতেন, একদম তাঁর লাগোয়া বাড়ীতেই তিনি থাকতেন স্বামীসহযোগে। তাঁর স্বামী অনিল চন্দ। রবীন্দ্রনাথের সেক্রেটারি। রাণীর শুরুটা অবশ্য হয়েছিল শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক হিসাবে।

      রাণী চন্দের দাদা মুকুল দে গভর্মেন্ট আর্ট কলেজের অধ্যক্ষ, প্রথম অধ্যক্ষ। রাণীর রক্তে ছিল চিত্রকলা। রবীন্দ্র-উপদেশে শান্তিনিকেতনে রাণী ভর্তি হন কলাভবনে। অবন ঠাকুর, নন্দলাল বসুর স্নেহধন্যা রাণীর কয়েকটি মাত্র চিত্রকলা দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে, ইন্টারনেটের সৌজন্যে। Mother and Child ছবিটার দিকে যে আমি কতক্ষণ তাকিয়েছিলাম মনে নেই। রাণী ছবি আঁকা শিখলেও নিজের ছবি নিয়ে ততটা সংবেদনশীল ছিলেন কি? না কি শান্তিনিকেতনের অন্যান্য খ্যাতনামা চিত্রকরদের দাপটে তাঁর কাজ অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে? অবশ্য নারী চিত্রকরদের কজনকেই বা আমরা চিনি, বিশেষত শান্তিনিকেতনের?

      তো এই রাণী কলাভবনে নন্দলাল বোসের তত্ত্বাবধানে ছবি আঁকা শিখতে লাগলেন। একসময়ে অনিল চন্দের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথের প্রতিবেশিনী হয়ে এলেন। দিনের পর দিন রবীন্দ্রনাথকে দেখেছিলেন নিকট থেকে। এমনকি ছবি আঁকার সময়েও রবীন্দ্রনাথকে সহায়তা করতেন। রবীন্দ্রনাথের অ-প্রথাগত আঁকার মেজাজ-মর্জির সাথে রাণী এতটাই পরিচিত ছিলেন যে, বুঝতে পারতেন, কখন কি প্রয়োজন। ফলে ছবি আঁকার সময় হলে রাণীর উপস্থিতি ছিল রবীন্দ্রনাথের কাছে অতি-প্রয়োজনীয়।

এই অতি-প্রয়োজনীতার আরেকটি উদাহরণ দেওয়া অতিপ্রয়োজন। রবীন্দ্রজীবনের একদম শেষ অঙ্কে রবীন্দ্রনাথের অন্তিম কাব্যগ্রন্থ ‘শেষ লেখা’। এটি অসম্পূর্ণ এবং এর মধ্যে দু-একটি কবিতা অসংশোধিতও বটে। কিন্তু বলার কথা এই যে, রবীন্দ্রনাথের পক্ষে সেই সময়ে নিজের হাতে লেখার ক্ষমতাটুকুও চলে গিয়েছিল। তিনি মুখে মুখে কবিতাগুলো বলতেন, রাণী শুনতেন, এবং লিখে রাখতেন। রবীন্দ্রকবিতা এবং রবীন্দ্রমানসিকতার সাথে রাণী এতটাই পরিচিত ছিলেন যে, কোথায় কোন কবিতায় কতটা স্পেস কিম্বা লাইনে ছেদ টেনে পরের লাইন লিখতে হবে, সেটা পর্যন্তও তিনি বুঝতে পারতেন এবং রবীন্দ্রনাথ তাঁর অনুমোদনও করতেন। ফলে ‘শেষ লেখা’ কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতাই সফলভাবে অনুলিখিত।

      এহেন রাণী নিজেও লিখতে জানতেন। আর লিখতে জানতেন বলেই শুরু করেছিলেন তাঁর গুরু অবন ঠাকুরের মুখনিঃসৃত কথাগুচ্ছ। রবীন্দ্রনাথ তা পড়ে শুধু আনন্দিতই হন নি, রীতিমতো রাণীকে তাড়া দিতেন জোড়াসাঁকোয় গিয়ে আরোও লিখে আসতে। অবন ঠাকুরের কথাবিলাস ‘ঘরোয়া’ গ্রন্থে পাওয়া যায়। আমার পড়া হয় নি। পড়ার ইচ্ছা আছে। ‘গুরুদেব’ বইটিতে রাণী লিখছেন,

“যেদিন পড়া শেষ হয়ে গেল কাগজগুলি সরিয়ে নেব বলে উঠে এগিয়ে এলাম। গুরুদেব কোলের-উপর-রাখা লেখাগুলির উপর বাঁ হাতখানি চাপা দিয়ে রইলেন।

আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। গুরুদেব বললেন, রথীকে ডাক।

রথীদাকে ডেকে আনলাম। রথীদা এসে দাঁড়ালেন পিছনে; গুরুদেব বুঝতে পারলেন। লেখার কাগজগুলি হাতে নিয়ে ঘাড়ের পাশ দিয়ে তুলে ধরলেন, বললেন, প্রেসে দাও।

রথীদা লেখাগুলো নিয়ে ফিরে চলে গেলেন।

এই হল ‘ঘরোয়া’ বইয়ের সূত্রপাত।”

আমার বলার উদ্দেশ্য রাণীর লেখনীশক্তির প্রতি দৃষ্টিপাত করা। সহজ সরল সাধারণভাবে রাণী লিখেছেন দৈনন্দিন চালচিত্র। সেখানে আসলেই তিনি লেখিকা নন, তিনি শান্তিনিকেতনের এক আটপৌরে নারী। যে নারীর বুকে সুখ এবং দুঃখ দুটোই খেলা করে। আর খেলা করে বলেই এই বই ‘গুরুদেব’ শুরু হয়েছে হঠাৎ করে, শেষও হয়েছে হঠাৎ করে। কোন উপসংহার নেই, কোন সূচনা-ভূমিকা নেই। আর সুখ দুঃখ আছে বলেই ‘আটপৌরে রবীন্দ্রনাথ’ ধরা পড়েছেন।

‘আটপৌরে রবীন্দ্রনাথ’ আসলে কি বস্তু? এই প্রসঙ্গে আসার আগে বলে নিই, রবীন্দ্রনাথ দিনের শেষে ‘ঠাকুর’ নন, রক্তমাংসের মানুষ। ফলে তাঁর মধ্যে আলো-অন্ধকার আছে। আর আলো-অন্ধকার আছে বলেই না মানুষের অন্তরের এত বোধ তিনি এত অনন্যভাবে লিখে যেতে পেরেছেন। ফলে তাঁর অসাধারণত্বের কথা যেমন বলতে হবে, তেমনই তাঁর খামখেয়ালীপনার কথাও বলতে হবে বৈ কি।

রাণী সব উগড়ে দিয়েছেন এই বইটিতে, তবে বড়ো মোলায়েমভাবে, নচেৎ এই বই বিশ্বভারতী প্রকাশ করতেন না, আর তাছাড়া এই মোলায়েমতা রানীর স্বভাবজ। এটা শান্তিনিকেতনের প্রকৃতির প্রভাব অথবা রবীন্দ্রপ্রভাব অথবা দুটোই, বলা মুশকিল। দিনের শেষে সব দোষ-গুণের ঊর্ধ্বে গিয়ে মানুষ রবীন্দ্রনাথও সাধারণ মানুষের থেকে অনেকটাই এগিয়ে থাকেন। সেখানে দু-একটা ঘটনা যদি আঘাত করেই থাকে, তা-ই কি দিনের শেষে বড়ো হয়ে দাঁড়ায়? না তো। রাণী যেমন পরিপূর্ণ হয়েছেন, রাণী তেমনি ভেঙে টুকরো টুকরোও হয়েছেন। অনেক সময় যেমন রাণীর মতামতের গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ হয় নি, তেমন, অনেক সময়, আবার, তাকে ছাড়া চলেও নি। সব মিলিয়ে জিতভূমের এই বাসিন্দা রবীন্দ্রপাদপ্রদীপের আলোয় আপনাকে তুলে ধরেছেন অন্যরকমভাবে।

রাণীর লেখা প্রথম বই আমি পড়েছি ‘সব হতে আপন’। তারপর পড়লাম ‘গুরুদেব’। পূর্বের বইয়ের অনেক ঘটনাই এই বইটিতে অন্যভাবে এসেছে, স্বাভাবিকভাবেই। এই বইটার কেন্দ্রে শান্তিনিকেতন নয়। এই বইটার কেন্দ্র রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যদি শুধুমাত্র প্রশংসাগুচ্ছ তিনি লিখতেন, মেয়ে মানুষের মায়া বলে আমি এড়িয়ে যেতাম, এত কথা বলার প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু যেখানে একজন শিল্পী স্বাধীনভাবে ঘটনাপ্রবাহকে বলে চলেছেন, এবং তিনি জানেন, কোথাও কয়েকটি ঘটনা রবীন্দ্রভাবমুর্তিকে দারুনভাবে আঘাত করতে পারে, তা স্বত্ত্বেও তিনি সত্য থেকে বিচ্যুত হন নি। কারণটিও রবীন্দ্রনাথ। তিনি যে কিছুতেই চান নি সত্য হতে বিচ্যুত হতে। ফলে রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাছে বারোমাসের রবীন্দ্রনাথ। আর বারোমাসের রবীন্দ্রনাথের বারোমাস্যা নিয়েই তাঁর নিবেদন ‘গুরুদেব’।

===============================

গুরুদেব

রাণী চন্দ

বিশ্বভারতী প্রকাশন বিভাগ

মুদ্রিত মূল্যঃ ১৬০টাকা

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে