তাহাদের শান্তিনিকেতন, তাহাদের কথা

 



“জীবনভর যে ভিড় ছিল সরে গেছে। আজ একা আমি জিৎভূমে। রাত্রিকাল। ঝড় উঠল। শুয়ে আছি। শুয়ে শুয়ে শুনছি হাওয়া ছুটল। এখানকার ঝড়ের ভাষা জানি। শুকনো হিজল পাতাগুলি খরখর করে উরে চলল। গলগলির সরু ডালগুলি ছিটকে পড়ল। শিমূলের কচি ডালটা ভাঙল বোধ হয় --- হালকা গাছ। না, এ ঝড় থাকবে না বেশিক্ষণ। বৃষ্টি নামল। এবারে শুকনো পাতাগুলি ভিজে উঠল। ভিজেপাতা সাড়া তোলা না। চুপ হয়ে যায়।”

      রাণী চন্দ। রবীন্দ্রনাথের ‘দ্বিতীয়া’। ‘প্রথমা’ হলেন মহলনাবীশ পত্নী – বিদুষী, শিক্ষিতা, বিদেশে রবীন্দ্রনাথের সাথে বহুবার গিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ তাকেই চিঠি লিখেছেন সবচেয়ে বেশি। আর এই ‘দ্বিতীয়া’ হলেন রাণী চন্দ। রবীন্দ্রনাথের সেক্রেটারি অমল চন্দের পত্নী, শিল্পী মুকুলচন্দ্র দে-র ভগ্নী, অবন ঠাকুর এবং নন্দলাল বোসের স্নেহধন্যা। নিজেও নামকরা আর্টিস্ট। প্রথম জীবনে রবীন্দ্রনাথের সাথে বহুবার ভ্রমণ করেছিলেন দেশে-বিদেশে। রবীন্দ্রনাথ যেখানে থাকতেন, শান্তিনিকেতনের সেই বাড়ীর একদম প্রতিবেশী ছিলেন বলা চলে। ফলে সকাল থেকে রাত্রি --- তাকে দেখেছেন --- অত্যন্ত কাছ থেকে।

      শান্তিনিকেতন তখন ছিল, এককথায় বলা যায় চাঁদের হাট। কে না ছিলেন সেখানে? শিক্ষক থেকে ছাত্র --- বর্তমান থেকে ভবিষ্যৎ। যারা শান্তিনিকেতনের জন্য প্রাণপাত করছেন, আর যাদের জন্য প্রাণপাত করা হচ্ছে। এই সক্কলদেরকে নিয়ে এক টুকরো স্মৃতিচুম্বন --- সব হতে আপন।

      সাধারন মানুষই তো ছিলাম আমরা সাধারণ সুখ-দুঃখ নিয়েই ছিলাম সাধারণ ঘরকন্না --- সবই ছিল আমাদের অন্য সবার মতো অসাধারণ ছিল শুধু আমাদের প্রাণের অফুরন্ত উল্লাস, আর মনের সুগভীর আনন্দ কখনো একটু এদিক ওদিক হত না কি? হত তবে তা আর কতটুকু সময় থাকত --- ঘুর্ণি হাওয়া মাটিতে দুপাক আছড়ে ঘুরে উপরে উঠে মিলিয়ে যেত

      এই আমরা কারা? অদ্ভুত সব নাম, অদ্ভুত সব মানুষ। কেউ ঘরের মানুষ, কেউ বাইরের মানুষ। অমূল্যকুমার বিশ্বাস। নেশায় ও পেশায় যন্ত্রবিদ। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বন্ধু। ঘুরতে এলেন শান্তিনিকেতনে। দেখলেন, কলের পাইপ ও বিদেশী যন্ত্রপাতি ডাঁই করে পড়ে রয়েছে। বিদেশী কোম্পানীও সেই কল ইন্সটল করতে পারে নি। জলের অভাবে শান্তিনিকেতন ধুঁকছে। অমূল্য বিশ্বাস এলেন, চেষ্টা করলেন এবং শান্তিনিকেতনে জলের সুবন্দোবস্থ করলেন। আমিও রাণীর সাথে তন্দ্রাবিলাসে দেখতে পাই, শান্তিনিকেতনে জলের অভাব অবশেষে ঘুচল।  

      ছিলেন নিশিকান্ত। কবি নিশিকান্ত। রবীন্দ্রনাথ তাকে বড়ো ভালবাসতেন। সহজকবি নিশিকান্তকে মাঝে মাঝেই ডাকতেন দুপুরে। খাওয়াতেন তাকে পেট ভরে। নিশিকান্ত একদিনেই প্রায় তিনদিনের খাওয়া খেয়ে নিতেন। রবীন্দ্রনাথ চাননি নিশিকান্ত শান্তিনিকেতন ত্যাগ করুণ। কিন্তু তার ডাক এসেছিল অন্য পথে। অরবিন্দ আশ্রমে নিশিকান্ত কাটান বাকি জীবন।

      ছিলেন অনিল চন্দ। রাণী চন্দের স্বামী। রবীন্দ্র নিজে তাদের বিবাহের পৌরহিত্য করেছিলেন। বিদেশে শিক্ষালাভ করেছিলেন। শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে। ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সচিব। আমৃত্যু এবং তারপরেও শান্তিনিকেতনের জন্য বলিপ্রদত্ত। রবীন্দ্রনাথের ছায়াসঙ্গী এই অনিল চন্দ রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত ‘পাগলা ফাইল’-এর রক্ষক এবং সংগ্রাহক।

ছিলেন তেজেশচন্দ্র সেন। শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তার ডাকনাম ‘বেঁটে’ নন্দলাল বসু এবং অক্ষয়কুমার রায়ের দেওয়া নামের অধিকারী মানুষটি বাড়িই হল বিখ্যাত ‘তালধ্বজ’। আজও শান্তিনিকেতন গেলে দেখতে পাওয়া যায়। বাড়িটার কথা মনে হলেই কতবার মনে হয়েছে, আহা! এমন একটি বাড়ি কি আমার থাকতে নেই?

ছিলেন হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের একেবারে সূচনাপর্বের শিক্ষক। তাকে সারা বাঙালী মনে রেখেছে ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এর প্রণেতা হিসাবে। একজন মানুষ তার সারাজীবনের অধ্যাবসায়ের এই একটি ফসল আজ নিঃশব্দে জনান্তরালে চলে গেছে --- “লাইব্রেরীর উপরে ছোট ছোট দু-তিনটি ঘর, আর একফালি খোলা ছাদ নিয়ে ছিল বিদ্যাভবন। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মশায় বছরের পর বছর ধরে মাটিতে বসে একটি ডেস্কের ওপরে খাতা রেখে লিখে চলেছেন বাংলা সাহিত্যের তাঁর মহৎ দান সুবৃহৎ ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’।” আমি দেখতে পাই ভেতরের চোখ দিয়ে --- তিনি লিখে চলেছেন।

      শুধু কি এদেশের লোক? বিদেশের লোকজনও এক-একটি এক-এক বিস্ময়কর প্রতিভা। ছিলেন এন্ড্রুজ। দীনবন্ধু তার উপাধি। তা তো আর এমনি এমনি নয়। রাণী লিখছেন, “অতি স্নেহভরা প্রাণ ছিল তাঁর। ছটফটে মানুষ ছিলেন, নানা দেশ ঘুরে বেড়াতেন। কোথাও যেন স্থির হয়ে বসতে জানতেন না। ... গুরুদেব ছিলেন প্রাণের অধিক, গুরুদেবের আশ্রম ছিল তাঁর প্রাণ। আশ্রমের পথঘাট বাড়িঘর গাছগাছড়া সবেতেই তাঁর স্নেহদৃষ্টি বুলিয়ে চলতেন। মোটা খদ্দরের ধুতি, খদ্দরের সার্ট --- এই ছিল তাঁর সাজ।”

      এসেছিলেন তাকাগাকি। জাপানের বিখ্যাত যুযুৎসু শিক্ষক। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন, ছেলেদের সাথে সাথে মেয়েরাও এ আর্ট শিখুক। এ নিজেকে বাঁচানোর শিল্প। কেন পিছিয়ে থাকবে মানুষ? তাকাগাকি শিখিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীদেরকে।

      এসেছিলেন সিভার ব্লুম। সুইডেন থেকে। শ্রীনিকেতনে। সুইডেনের বিখ্যাত তাঁতশিল্প শেখাতে। এসেছিলেন মিস বস্‌নেক। ফ্রান্স থেকে। এসেছিলেন দানিয়েলো বুরনি। সঙ্গীতজ্ঞ, ফটোগ্রাফার।

      রাণী চন্দের ‘সব হতে আপন’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ পর্দার আড়ালে, কিম্বা দূর আকাশের নীলিমায়। সূর্যের প্রভায় আলোকিত চরিত্রগুলো অনেকটা বুনোফুলের মতো। একটু একটু করে তারা ফুটে কখন যেন সবার অলক্ষ্যে। ফুলের গন্ধ-সৌন্দর্যে হঠাৎ করেই একদিন তাদের চোখে পড়ে। মনে হয়, কই, এদের তো আগে দেখি নি। রবীন্দ্রনাথ যে উদ্দেশ্যে শান্তিনিকেতন রচনা করলেন, তা পূর্ণ হয়েছিল কি? এই বই তাঁর যথার্থ উত্তর।

      “অতীত বুঝি বা শুধুই সুন্দর। যতই পিছিয়ে যাই দেখতে পাই কোথাও যেন অসুন্দর কিছু নেই। যে সকালের আলো মাখা সব-কিছু।”...

 

==========================

 

সব হতে আপন

রাণী চন্দ

বিশ্বভারতী প্রকাশনা বিভাগ

মুদ্রিত মূল্যঃ ১২০ টাকা

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা

     

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে