একই চরিত্র – ছায়ায় মায়ায় – অনেক চরিত্র
“’অদ্বৈতসিদ্ধি’
গ্রন্থটি সে সমাপ্ত করিয়াছে। ইহার কঠোর যুক্তিজাল সে আজিকালি অধ্যাপনা করে। এইসব
অন্ধকার রাত্রির গর্ভের ভিতর বসিয়া সংশয় আসে, কে তাহার গ্রন্থ মনে রাখিবে? শতাব্দী
অতিক্রান্ত হইবার পর কেহ ইহা পড়িবে কি? অথবা, ইহা একটা নামমাত্র বাঁচিয়া রহিবে? এত
কঠিন বিতর্কবিন্যাস ভাবীকালের মানবকের উপযোগীতাবাদী মস্তিষ্কে প্রবেশ করিতে
পারিবে? অথবা, সে শুধু একটা কিংবদন্তী হইয়া বাঁচিয়া রহিবে? ইহার বেশি কিছু নয়! কেহ
বলিতে পারে না। কত মহামহোপাধ্যায়ের গ্রন্থ কালের বিবরে হারাইয়া গিয়াছে, এ গ্রন্থও
সেইসব লুপ্তচিহ্ন গ্রন্থরাজির পন্থা অনুসরণ করিবে কি না, কোন্ ক্রান্তদর্শী তাহা
বলিয়া দিতে পারে?”
সন্মাত্রানন্দের
‘ছায়াচরাচর’ উপন্যাসের প্রোটাগনিস্ট চরিত্র মধুসূদন সরস্বতী এক পর্যায়ে এসে এমন
একটা ভাবনা ভাবছেন। তিনি জীবদ্দশায় কিংবদন্তী হয়ে পড়েছিলেন, এতটাই যে, জ্ঞানী
অদ্বৈতবাদী এই সন্ন্যাসী সম্পর্কে প্রচলিত ছিল,
বেত্তি পারং সরস্বত্যাঃ
মধুসূদনসরস্বতী।
মধুসূদনসরস্বত্যাঃ পারং
বেত্তি সরস্বতী।।
মধুসূদন
সরস্বতীর জ্ঞানের সীমানা যে কোথায়, তাহা একমাত্র বিদ্যার দেবী সরস্বতী জানেন। আর
সরস্বতীর সীমা কোথায়, তাহা মধুসূদন সরস্বতীই জানেন।
কিন্তু,
লেখকের ভাবনাকে ছাপিয়ে যদি বলতে হয়, সময়ের কয়েকশো বছর পার হয়ে এসে, তাহলে, মধুসূদন
সরস্বতী তার নিজের কার্য সম্পর্কিত ভাবনাটি যে অমূলক নয়, তা প্রমাণিত। সাধারণ
মানুষ যদি তার সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে জানতে চায়, তাহলে বলা যেতে পারে যে ---
মধুসূদন
সরস্বতী (১৫২৫ — ১৬৩২) ঊনসিয়া-ফরিদপুরে থাকতেন। চন্দ্ৰদ্বীপের রাজা কন্দর্পনারায়ণের সভাসদ
কবি প্রমোদন পুরন্দরাচার্য। শৈশবে পিতার কাছে শিক্ষালাভ করেন। মথুরানাথের কাছে
ন্যায়শাস্ত্ৰ, বারাণসীর বিখ্যাত পণ্ডিতদের কাছে দ্বৈত ও
অদ্বৈতবাদ ও আচার্য রামতীর্থের কাছে বেদান্ত শেখেন। এইখানেই মহাপ্ৰভু-প্রবর্তিত
দ্বৈতবাদ থেকে শঙ্কারাচার্যের অদ্বৈতবাদে তাঁর বিশ্বাস ও উপলব্ধি হয়। দীর্ঘ
পরিশ্রমে তাঁর শ্রেষ্ঠ গ্ৰন্থ ‘অদ্বৈতসিদ্ধি’ রচনা করেন। এরপর বিশ্বেশ্বর সরস্বতীর কাছে সন্ন্যাসে দীক্ষা নিয়ে ‘সরস্বতী’ উপাধি পান ও গীতার টীকা প্ৰণয়ন করেন।
বারাণসীতে বাসকালে বহু ছাত্রকে শিক্ষাদান করেন। দিল্লীর রাজসভায় যথেষ্ট প্রতিপত্তি
থাকার ফলে আত্মরক্ষার্থে সন্ন্যাসীদের অস্ত্ৰ ব্যবহারের অনুমতিলাভে সমর্থ হন।
শঙ্করাচার্যসৃষ্ট সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের সংস্কার সাধন করেন। শেষ-জীবনে নবদ্বীপে
প্ৰত্যাগমন করলে অদ্বৈতবাদের অদ্বিতীয় পণ্ডিত হিসাবে নবদ্বীপের বিশিষ্ট বিদ্বজ্জন
দ্বারা সংবর্ধিত হন। মায়াপুরীতে যোগ-সমাধিস্থ অবস্থায় মারা যান। তাঁর রচিত ‘ভক্তি রসায়ন’, ‘সিদ্ধান্ত বিন্দু’, ‘মহিমঃস্তোত্র’ টীকা উল্লেখযোগ্য।
উইকিপিডিয়া যা জানাচ্ছে, তাতে
মাত্র তিন প্যারাতেই তার পরিচয় শেষ। অর্থাৎ, মধুসূদন সরস্বতীর লেখা হয়তো,
বর্তমানে, স্কলারি আর্টিকেল হিসাবে কলেজের অধ্যাপকেরা, কিম্বা অদ্বৈত সন্ন্যাসী ছাত্রেরা,
অথবা সংস্কৃত ভাষাচর্চাকারী কৃতি ছাত্রছাত্রীরা, তাদের মধ্যে কতিপয়, পড়ে থাকতে
পারেন। কিন্তু মোদ্দা কথা হল এই, তিনি লোকবিস্মৃতির অন্তরালে চলে গেছেন। তার একটাই
কারণ, আমার মনে হয়, সাধারণ জনসমাজে তার চিন্তার কোন প্রভাব বিস্তার হতে পারে নি,
যেমনটা হয়েছেন শঙ্করাচার্য, যেমনটা হয়েছেন গোস্বামী তুলসীদাস।
তাকে আবার জনসমক্ষে আনার চেষ্টা
করেছেন সন্মাত্রানন্দ। এখন সন্মাত্রানন্দের এই উপন্যাস সম্পর্কে কিছু বলার আগে আরও
দু-চার কথা বলতে ইচ্ছে করছে। তর্জমাকার আশিস দেব একটি বইয়ের মুখবন্ধে লিখেছেন, “ধ্রুপদী
চীনা বা ভারতীয় সাহিত্য অনেক সময়েই পশ্চিমের আরিস্ততলীয় সাহিত্যতত্ত্ব মেনে চলে
না। চীনা সাহিত্যে একটি ধারা আছে, যেখানে অনেকগুলো কাহিনী পুঁতির মালার মতো গাঁথা
হয়েছে একের সঙ্গে অন্যের যোগ আছে, আবার প্রত্যেকে আলাদাও বটে।” এর একটা উদাহরণ
সম্প্রতি আমি পেয়েছি জাপানী সাহিত্যিক কিয়েগি হিগাশিনো’র ‘দ্য জেনারেল নামিয়া
স্টোর’ উপন্যাসে। সন্মাত্রানন্দ, ঠিক এই প্যাটার্নটাকেই এখানে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
পার্থক্য এই যে, এখানে একই চরিত্র বিভিন্ন রূপে-রূপান্তরে এসেছে। অর্থাৎ, একই
মধুসূদন সরস্বতী বিভিন্ন মধুসূদন সরস্বতী হয়ে কালচক্রের সমান্তরালে এক-এক চরিত্রে
যেন অভিনয় করে গেছেন, এবং, মাঝে মাঝে তাদের মধ্যে ‘ক্রস’ হচ্ছে, তারা মুখোমুখি
হচ্ছেন। এইভাবে
তিনি এই চরিত্রটিকে অনেকটাই সার্থকভাবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন, এবং আমার
মতে, সফলও হয়েছেন।
এছাড়া আর কি-ই বা করার ছিল তার?
এমন কৃতবিদ্য এক মহান পন্ডিত সম্পর্কে উইকি-তে যেখানে তিন প্যারার বেশি নেই,
সেখানে তিনি উপন্যাসটাকে আড়াইশো পৃষ্ঠা পর্যন্ত টানতেন কি করে? তাও সম্ভবপর হত,
যদি মধুসূদন সরস্বতী’র লেখাগুলোর সূত্র ধরে অদ্বৈত বেদান্তবাদের সাথে দ্বৈতবাদের
নির্মম দ্বন্দ্বের কূটতর্কের আরও গভীরে যেতেন।
হয়তো ওনার সে ক্ষমতাও ছিল। যতটুকু
এই অদ্বৈতবাদ ও মায়াবাদ নিয়ে লিখলেন, তাতে আমার অন্তত তাই মনে হল। কিন্তু অত
গুরুপাক বাংলা সাহিত্যের সরলমতি পাঠক-পাঠিকাদের সহ্য হত না। ফলে, তাকে একটু ‘কম্প্রোমাইজ’
করতে হল। এক চরিত্রকে চার ভাগ করে চারটে গল্প ফাঁদতে হল। বেচারা মধুসূদন
সন্ন্যাসীর এক চরিত্রকে লুতুপুতু প্রেম করতে হল; আর এক চরিত্র মহাপ্রভুর শিষ্য হয়ে
মায়াবাদী হয়ে গেল; অন্য এক চরিত্র অদ্বৈতবাদ ও নাগা সন্ন্যাসী সহযোগে সমাজে
ধুন্ধুমার বাঁধিয়ে দিল, এবং আরেক চরিত্র বাঁশির সুরে সুরে এক অপার্থিবকে স্পর্শ
করার জন্য পাগলপারা শিল্পী হয়ে গেল। পদ্মাক্ষ, রাজীবলোচন, কমলনয়ন, উৎপলদৃষ্টি ---
চার পাগলে মিলে ছায়াচরাচরে দাপাতে লাগল। দুর্ভাগ্য, পাঠকদের সেটা বোঝানোর জন্যে,
তাকে এক ‘যোগিনী’ এবং ‘যোগবশিষ্ঠ’-র স্মরণাপন্ন হতে হল। গল্পের জটিলতার মাধুর্যকেও সরলমতি পাঠকদের খাতিরে সরল
হতে হল। নিজের প্রতি আশঙ্কা, না কি পাঠকদের ওপর আত্মবিশ্বাসের অভাব? না কি এটাই
বাস্তব অবস্থা!
তবুও, সন্মাত্রানন্দকে কেয়াবাৎ।
আলাদা গল্প নয়। এক চরিত্রে চার সমান্তরাল গল্পকে একসূত্রে বলার চেষ্টা, তাও
‘শরদিন্দুক’ সাধুভাষায়। তার লক্ষ্য যদি বর্তমান জেনারেশানে যুবক-যুবতীরা হত, তাহলে
এই সাধুভাষার কূটভাষ্যে যেতেন না। মাঝখান থেকে তাকে একটা জেনারেশান হারাতে হল।
সাধুভাষাটা সবার যে আসে না, বিশেষত, যাদের বাংলাটা ঠিক আসে না, তাদের তো আরও।
সন্মাত্রানন্দের মধ্যে ভাবের
গভীরতা পাই; সন্মাত্রানন্দের মধ্যে অতীতকে খুঁজে বের করার তাগিদ পাই;
সন্মাত্রানন্দের মধ্যে একটু অন্যরকম স্টাইলে লেখার প্রচেষ্টা পাই। কেবল তাকে আমার
একটাই অনুরোধ, প্রকাশকদের ‘শারদীয়া’ বায়না থেকে সরে গিয়ে একটা, বছরে একটা এরকম
লেখা লিখুন। গভীরে গিয়ে, যতটা গভীরে গিয়ে লিখলে আপনার আত্মা প্রসন্ন হয়, ততটা
গভীরে গিয়ে লিখুন। আপনি অলরেডী একজন সেলিব্রিটি হয়েই গেছেন, আপনার আর ভয় কি?
অদ্বৈততত্ব এবং দ্বৈততত্ত্বের আরও গভীর আলোচনা, সুচিন্তিত আলোচনা, তৎকালীন সমাজে
তার আরোও গূঢ় প্রভাব আপনার লেখায় আমি আশা করেছিলাম, যাতে করে ভাষা ভাষা ধারনা থেকে
এগিয়ে গিয়ে পাঠকের দিক থেকে একটা চিন্তার উৎকর্ষের দিকে ঠেলে দেওয়া যায়। সেখানে
হয়তো পাতার পর পাতা জুড়ে আপনি এ আলোচনা দিয়ে আমাদের সমৃদ্ধ করতে পারতেন। বইয়ের বপু
বাড়ত, কিন্তু তা সার্থক হত। তেমন হলে নারায়ণ সান্যালের মতো (নক্ষত্রলোকের দেবতাত্মা,
মনে পড়ে আপনার?), আপনি লিখতেই পারতেন যে, পাঠকেরা যদি গল্প পড়তে এসে থাকেন, তাহলে,
তারা এই অংশটা বাদ দিয়ে পরের পর্বে চলে যান। এ অংশটা কৌতুহলী পাঠকদের জন্য।
============================
ছায়াচরাচর
সন্মাত্রানন্দ
ধানসিঁড়ি
মুদ্রিত মূল্যঃ ৪০০ টাকা
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ ধানসিঁড়ি, সমর্পিতা
Comments
Post a Comment