‘পাসকরা মাগ’ এবং একটি বিতর্ক

 



কিছু কিছু সময়ে একদম লিখতে ইচ্ছে করে না, মনে হয়, অহেতুক ঝামেলায় জড়ানোর কোন মানে হয় না। পাথরে কি আর পেরেক গাঁথে? আবার কিছু কিছু সময় না লিখেও পারা যায় না। মনে হয়, হোক পেরেক ভোঁতা, হাতুড়ির বাড়িটা যে মেরেছিলাম, তা নিজেরও যেমন মনে থাকবে, আর বাড়ি মারার শব্দটা, অন্তত কয়েকজনের কিছু সময়ের জন্য হলেও অস্বস্তিতে ফেলবে।

      অনেক অনেক আগের কথা। বটতলার বই প্রকাশিত হত। সস্তার বই। সস্তার বিষয়। সস্তার আমোদ। তারই একটা বই হল ‘পাশকরা মাগ’। নীচে ব্র্যাকেটে লেখা, “সামাজিক প্রহসন”। একজন এই বইটার প্রচ্ছদের একটা পোস্ট দিলেন ফেসবুকের একটি জনপ্রিয় বইয়ের গ্রুপে। তার কাজ পুরোনো বইয়ের প্রচ্ছদের ছবি শিল্পীর নামসমেত পোস্ট করা এবং জানানো, ওহে এমন সব বই আগে ছিল। তিনি আসলে দুগ্ধপোষ্য শিশু সেজে জনগনের প্রতি সাধারণ জ্ঞান জ্ঞাপন করছেন। কারণ, বেশরভাগ বইয়েরই কোন প্রাসঙ্গিকতাই নেই বর্তমান যুগে। আর থাকলেও তিনি জানানোর প্রয়োজন মনে করছেন না, তার একটাই কারণ, তিনি নিজেও সে ব্যাপারে জ্ঞাত নন। এই সমস্ত পোস্টের রেসপন্স প্রায় নেই বললেই চলে।

      এখন, এই বইটার প্রচ্ছদসমেত পোস্টটি জনপ্রিয় হয়ে পড়েছে। বইটার নাম, প্রচ্ছদে নগ্নিকার ছবি এবং নামের পেছনের রসালো বিষয়ের মধ্যে বেশ মুচুমুচু গন্ধ। পোস্টদাতা তার জীবনের প্রথম মেগাহিট পোস্ট দিয়ে ফেলেছেন বলে তাঁকে অভিনন্দন। আমি অবশ্য ঠেক খেয়ে গেলাম কমেন্টস দেখে। এবং সেখান থেকেই এই কলামের জন্ম।

      একজন জিজ্ঞাসা করেছেন, “বর্তমানে সাধারণ পাঠকের কাছে এই বইয়ের রেলিভ্যান্সিটা কোথায়?” প্রশ্নটা আমারও ছিল। তা দেখলাম ‘রেলিভ্যান্সি’। একজন পাঠিকা লিখেছেন, “পুরুষের দৃষ্টি ভঙ্গি যুগে যুগে একই রয়ে গেল তারা আর মানসিকভাবে শিক্ষিত হল না” আরেকজন পাঠিকা লিখেছেন, “পুরুষদের মানসিকতা কত যে নীচ, তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ, একাল হোক বা সেকাল...আরেকজন পাঠিকা লিখেছেন, “তৎকালীন সমাজে শিক্ষিতা নারীদের কী পরিমাণ ট্রোল করা হতো এই ছবি সম্ভবত তারই দলিল

      আমি একটু ভাবতে বসলাম। অনেকেই উক্ত সিদ্ধান্তের সমর্থন করছেন, অনেকে বিবাদ করছেন। সব মিলিয়ে প্রচন্ড উত্তেজনা। খাপ পঞ্চায়েত বসে গেছে। এখন আমার প্রশ্ন, যারা মনে করছেন, পরিস্থিতির কোনরকম কোন পরিবর্তন হয় নি, তারা ঠিক কোন জগতে বাস করেন? মোটামুটিভাবে ১৮৫০ সালের আশেপাশে প্রকাশিত হওয়া বই যদি সেই সময়ের দলিল হয়ে থাকে, এবং তা বর্তমানেও সমভাবে প্রযোজ্য হওয়ার দাবী এই বঙ্গমহিলারা করেন, তাহলে বলতে হবে, এটা আমাদের মেয়েদের লজ্জা। আমাদের জন্যে আইন আছে, আমরা তার সুবিধা ভোগ করছি। সামাজিক সুবিধা (যেমন: অনেক রকমের ‘শ্রী’) ভোগ করছি। বাসে-ট্রেনে আমাদের জন্যে সীট রিসার্ভ থাকে, আমরা অম্লানবদনে ভোগ করছি। আমরা ভোগ করি, নিজেদের ‘অবলা-দুর্বলা’ বিশ্বাস করি, নিজেদের দুর্গা-কালীর ক্ষমতাসম্পন্না কল্পনা করি, আর দুর্বলতার যাবতীয় দায় পুরুষদের ওপর চাপিয়ে সোশাল মিডিয়াতে মড়াকান্না কাঁদি, আহা গো, আমাদের অবস্থার কোন পরিবর্তন হল না।

      এই হিপোক্রেসী আর কতদিন?

      আমরা আর কিছু বুঝি না বুঝি, 498 কেস খুব ভালো বুঝি। তা নিয়ে ইদানীং অনেকেই ব্যবসাও করছেন, এমনও ঘটনা বিরল নয়। আমরা আর কিছু বুঝি না বুঝি, আমরা খুব ভাল বুঝি বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ীর অর্ধেক সম্পত্তি আমাদের, উল্টোটা অবশ্যই কখনই নয়। আমরা আর কিছু বুঝি না বুঝি, এটুকু বুঝি যে, মাছভাজার তেলের ছিটে গায়ে যে ফোস্কা ধরিয়ে দেয় তাঁকে অনায়াসে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স বলে চালিয়ে দিলে শ্বশুরবাড়ির পুরো পরিবারকে জেলের ঘানি টানিয়ে দেওয়া যাবে। আমরা আস্তে আস্তে সেয়ানা হচ্ছি বটে। এই কমেন্টসগুলো তার বড়ো প্রমাণ।

      74% of all rape cases filed in India are fake --- আমরা দেখছি। FALSE DOMESTIC VIOLENCE CASE NEWS – দিয়ে গুগল সার্চ করলে অনেক কিছুই দেখা যাবে। আমরা জানি, এই মস্ত বড়ো সুবিধাটা ছাড়াও ডোমেস্টিক্যালি অনেক সুবিধা মেয়েরা পায় এবং তা আদায় কিভাবে করতে হয় তা জানে। কেবল তারা জানে না, এই সুবিধাগুলি অসংখ্য পুরুষ এবং মহিলার লড়াইয়ের ফল। অনেক মহিলা আজও মেয়েদের জন্যে লড়ছেন, তাদের অধিকার আদায়ের জন্য জীবন বিপন্ন করছেন। এনারা আসলে তাদেরই অপমান করছেন এবং নিজের ব্যক্তিগত বিদ্বেষকে জেনারেলাইজেশান করে জান্তব আনন্দ পাওয়ার চেষ্টা করছেন।

      যদি আমাদের সমাজকে তিনটে স্তরে ভাগ করা হয় তাহলে, অবশ্যই, ‘লোয়ার ক্লাস’ স্তরের মেয়েদের অবস্থা এখনও খুব একটা সুবিধার নয়। গ্রামের মেয়েদের অবস্থা নিয়ে আলোচনা করতে বসলে অবশ্যই বিস্মিত হতে হবে যে, কিভাবে তারা এখনও নির্যাতনের শিকার হয়, অথচ, প্রতিবাদ করার ক্ষমতাটুকুও লুপ্ত। কিন্তু, ক্ষমতা হাতে পেয়েও এবং তার সার্থক প্রয়োগের সীমায় থাকা অপর দুই প্রজাতির মেয়েরা যখন নিজেদেরকে ‘দুখী আত্মা’ বলে ন্যাকাকান্না গায়, তখন তাদের জন্য একটাই কথা বলার আছে, বাংলা সিরিয়াল দেখা বন্ধ করুন। Watching Bengali serial is injurious to health, it causes social cancer.

      আর যারা ট্রোল করার কথা ভেবে আশ্চর্য হন, তাদের বলি, স্ত্রী-দের নিয়ে যে পরিমাণ ট্রোল কিম্বা চুটকি এখন প্রচলিত, তাতে করে বলতে হবে, স্ত্রীরত্নেরা বর্তমানে যে পরিমাণ নির্যাতন এবং শোষণ তাদের স্বামীদের করেন, তাতে করে খুব শীঘ্রই আরেকটা বিল পাস করানো উচিৎ, পুরুষদের জন্য কারণ, ট্রোল যদি একটা বড়ো সামাজিক দলিলের উদাহরন হয়, তাহলে এই ট্রোলগুলোও এই সময়ে পুরুষদের অবস্থার একটা বড়ো উদাহরণ হয়ে দাড়াচ্ছে, এবং তাও শিক্ষিতা নারীদের বিরুদ্ধে! অবশ্য এর মধ্যেও যারা পুরুষতান্ত্রিকতার গন্ধ পান, তাদেরকে আমার নমস্কার

      আমি অনেক পুরুষদের দেখেছি, উচ্চস্তরের সামাজিক পুরুষ হয়েও, তাদের মধ্যযুগীয় মানসিকতা। আমাকে তা আহত করে। তারা আসলেই মেয়েদের ‘মাগ’ মনে করে। তারা মনে করে, মেয়েরা ঘরকন্নার জন্যেই জন্মেছে। তারা মনে করে, যে মেয়ে পুত্রসন্তানের জন্ম দেয়, সে সংসারের লক্ষ্মী। তারা মনে করে, যে মেয়ে সাত চড়ে রা কাড়ে না, সে মেয়ে ভাল মেয়ে। তারা মনে করে, মেয়েদের দিয়ে যা খুশি করানো যায়, তাদেরকে যা খুশি বলা যায়, এবং তারা সব আদেশ মুখ বুজে মানতে বাধ্য থাকবে। এই মানসিকতার পুরুষদের আজকের যুগে আমরা বলি, মানসিকভাবে অসুস্থ, কিম্বা পার্ভার্ট, কিম্বা সেকেলে লোক। এই ধরনের লোককে সমাজই বর্জন করছে ধীরে ধীরে।

কিন্তু আমরা এও জানি, তারা তাদের সেই মানসিকতা দেখালে, আজ, অন্তত আমরা, দু-চার কথা শুনিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখি। প্রতিবাদ একটা বড়ো অস্ত্র। আজ আমরা প্রতিবাদ করার ক্ষমতা পেয়েছি। এ কিন্তু বটতলার যুগে ছিল না। আজ এই কথাটা লিখতে পারছি, কারণ, আমরা মেয়েরা, এই ক্ষমতাটা অর্জন করেছি। মজার ব্যাপার, যারা উক্ত ধরণের কথাগুলো বলে মড়াকান্না জুড়েছেন যে অবস্থার পরিবর্তন হয়নি, তাদের কথা মানতে হলে, এই স্মার্টফোনও তাদের হাতে বেমানান। যথাযথ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মেয়েদের বোরখার তলায় রেখেছে, স্মার্টফোন তো তাদের কাছে স্বপ্ন।

ফলে, এই পোস্টটার একটাই রেলিভ্যান্সি আছে, আর তা হল, একটা বিতর্ক সৃষ্টি করে প্রচারের আলোয় আসা। এর বাইরে আর তো কোন কারন খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে