প্রধন্যারামায়ণ – ২
বেশ কয়েক বছর ধরে ভারতবর্ষে ‘রামরাজ্য’ আনার চেষ্টা
হচ্ছে। এই যে
রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা বলা হচ্ছে, তার মূল ভিত্তি কি? চ্যাটজিপিটি বলছে, "Ramrajya" represents good
governance, development, and the preservation of cultural and religious values.
They often portray themselves as working towards establishing a modern-day
equivalent of Ramrajya, emphasizing principles such as good governance, social
harmony, and economic progress.
সাধু
উদ্দেশ্য, সন্দেহ নেই, কিন্তু প্রশ্ন অনেক। একটা বড়ো প্রশ্ন, রামরাজ্যে রাম রাজা
হন। অর্থাৎ, একজন মানুষের হাতে গোটা রাজত্ব। যার বর্তমান অর্থ, অটোক্রেসি --- it is a system of
government in which absolute power is held by the ruler, known as an autocrat, এখানে সেরকম হবার সম্ভবনা থেকেই যায়, রামরাজ্যের প্যাটার্ন অনুযায়ী,
আধুনিক ভারতে শীর্ষে কে থাকছেন? সেই অনুযায়ী, তার কথাই কি শেষ কথা? এক্কেবারে শেষ...!!!???
এসব
নিয়ে মাথা ঘামাবার লোক অনেক আছে। আমি অন্য বিষয় নিয়ে ভাবছি। আমি ভাবছি এর প্রায়োগিক
বিষয়গুলো নিয়ে। এবং সেখান থেকে, আমরা যদি বিষয়গুলির উৎস সন্ধানে যাই, তাহলে,
অবশ্যই বাল্মীকী রামায়ণে গিয়ে পৌছব এবং সেখানে রামরাজ্যের বিষয়টি নিয়ে অবশ্যই
অনুসন্ধান করব।
আদিরামায়ণে যুদ্ধকান্ডের একেবারে অন্তিম পর্বে
রামরাজ্যের বর্ণনা পাই। রামচন্দ্র রাজা হলেন এবং লক্ষণকে সাথে নিয়ে রাজ্যশাষন করতে
লাগলেন --- লক্ষণানুচরো রামঃ শশাস পৃথিবীমিমাম্ --- রাজা হয়ে রামচন্দ্র কি কি
করলেন?
১।
অনেক প্রকার যজ্ঞের অনুষ্ঠান করলেন --- বহুবিধৈর্যজ্ঞৈঃ সমুহৃজ্জ্জতিবান্ধবঃ ---
বন্ধু, আত্মীয় সমভিব্যাহারে। এখানে যজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে, বহুদিন ধরেই, বহুরকম যজ্ঞ।
২। তার
রাজত্বকালে বিধবাদের আর্তনাদ শোনা যায় নি, সাপ-শ্বাপদের ভয় ছিল না। আমি মেনেই
নিচ্ছি, আধুনিক রামরাজত্বে এ সম্ভব নয়। এ কবিকল্পনামাত্র।
৩।
নির্দস্যুভবল্লোকো --- রাজ্যের কোথাও চোর-ডাকাতের নাম পর্যন্ত শোনা যেত না।
ব্যাপারটার গুঢ়ার্থে না ঢোকাটাই ভালো, যেখানে, ধরেই নেওয়া হচ্ছে, রামের বন্ধুরা
কেউ চোর নয়।
৪। সর্বং
মুদিতমেবাসীৎ --- সবাই আনন্দে থাকত। সর্বো ধর্মপরোহভবৎ --- সব্বাই ধর্মাচরণ করত। নাভ্যহিংসম পরস্পরম ---
কেউ কাউকে হিংসা করত না। বেশ কথা যা হোক। আজকের যুগে হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটি,
সোশাল মিডিয়াতে যে ভিডিও-র টুকরোগুলো পাই, যাকে আমরা রিলস্ বলি, তাতে তো দেখি,
সবাই খুব সুখেই আছে। নয় কি? আর নিন্দুক তো কেউই নেই। থাকার কথাও না। রবীন্দ্রনাথের
তোতাকাহিনী অনুসারে, “আয়োজনের ত্রুটি নাই। খাঁচায় দানা নাই, পানি নাই;
কেবল রাশি রাশি পুঁথি হইতে রাশি রাশি পাতা ছিঁড়িয়া কলমের ডগা দিয়া
পাখির মুখের মধ্যে ঠাসা হইতেছে। গান তো বন্ধই, চীৎকার করিবার
ফাঁকটুকু পর্যন্ত বোজা। দেখিলে শরীরে রোমাঞ্চ হয়।” এখন পুঁথিটা কি, তা নিয়ে আপনারা
চিন্তা করতে হয় করুন, আমি করব না। না না ন্যাঃ... আমার রোমাঞ্চ হচ্ছে।
৫।
বৃক্ষ ফল দিত, মেঘ বৃষ্টি দিত, হাওয়া সর্বদা সুখকর হত --- অর্থাৎ, পরিবেশ সচেতনতায়
রামরাজ্য ফার্স্টক্লাস। আমাদের এখানে World Earth Day কিম্বা World
Environment Day–তে যে পরিমাণে পোস্ট দেখতে পাই, তাতে করে বিশ্বাস
করা কঠিন, যে, এ রাজত্বে ‘নিত্যফলাস্তরবস্তত্র পুষ্পিতাঃ’।
৬। যে
যে বর্ণের মানুষ তারা প্রত্যেকেই স্ব স্ব কাজে ব্যাপৃত থাকত --- স্বকর্মসু
প্রবর্তন্তে তুষ্টাঃ স্বৈরেব কর্মভিঃ --- কিছু কিছু রাজ্যে এর প্রয়োগ নিয়ে বহুদিন
ধরেই আলোচনার শিরোনামে আছে। বাকি রাজ্যগুলোতে সেরকম কিছু শুরু হলেই আমরা বলতে
পারবো, “পাখিটার শিক্ষা পুরা হইয়াছে।”
৭। কেউ
মিথ্যা কথা বলতেন না শ্রীরামচন্দ্রের রাজত্বে --- আসন্ প্রজা ধর্মপরা রামে শাসতি
নানৃতাঃ --- ব্যাপারটা একটু ভজোকটো। রামরাজত্বে ক্যামেরা ছিল না। এই রাজত্বে
ক্যামেরা শুধু আছেই না, তার চোখকে ঠেকানো আরও দুরূহ।
৮।
দশবর্ষসহস্রানি দশবর্ষশতানি চ --- এগারো হাজার বছর রাজত্বকাল ছিল প্রভু শ্রীরামের।
এই রাজত্বে চারশো সীটের বাধা যদি একবার টপকানো যায়, তাহলে যে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা
হব্বেই, এ নিয়ে সংশয় নেই।
রামচন্দ্রকে
মোটামুটিভাবে লাইম লাইটে যদি কেউ এনে থাকেন, তিনি তুলসীদাস। তার মতেও রামরাজ্য মোটামুটি
একই। এক আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা থেকে তিনিও সরে আসতে পারেন নি। সব নর করহিঁ পরস্পর
প্রীতি --- লোকেরা পরস্পর প্রেম-প্রীতি রাখে। তুলসীদাসের ভাবের জগতে বোধহয় মোগল-পাঠান
আসে নি। আসলেও তিনি আদর্শটাকেই সামনে রেখেছেন, এবং এক পর্যায়ে বলেই ফেলছেন --- রাম
রাজ কর সুখ সম্পদা / বরনি ন সকই ফনীস সারদা --- এই রাজত্বের বর্ণনা করতে সরস্বতীও
অক্ষম।
উত্তরকান্ডের
পাতার পর পাতা জুড়ে যে রামরাজত্বের কথা বলা আছে, তা বড়ো সুখকর --- যামিমাং পুষ্পিতাং বাচং প্রবদন্ত্যবিপশ্চিতঃ (গীতা ২ । ৪২) --- দেখেশুনে এটাই যেন হয়ে দাড়াচ্ছে মোদ্দা কথা।
রামরাজ্যকে কাগজে কলমে প্রতিষ্ঠা
করা এবং বাস্তবে প্রতিষ্ঠা করার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। এই পার্থক্যে প্রজাদের
ওপর কি প্রভাব পড়েছে তুলসীদাস তা বলেন নি। ধরেই নেওয়া হচ্ছে, প্রজারা সবাই সুখী।
প্রজারা সবাই ধার্মিক। প্রজারা সবাই অহিংসক।
এতএব আলোচনা
করার একটাই ব্যাপার, ভাবের ঘরের কথাকে যদি বাস্তবের মাটিতে আনা যায়, তাহলে তার কোন
অস্তিত্বই থাকে না। আর কল্পনাকে যদি বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করা হয়, তাহলে তা
যথাযথ সম্পন্ন হয় না। এখন ভাব কিম্বা কল্পনা, দুটো দুই প্রান্তের বাসিন্দা। আমরা
ভাবে আছি, না কল্পনায় আছি, না বাস্তবতায় আছি? কোথায় এর তফাত? তফাত শুধু
শিরদাঁড়ায়...
Comments
Post a Comment