প্রোজেক্ট কাদম্বরী দেবী



এখনকার সময়ে স্কুলের ছেলেমেয়েদের প্রায় প্রত্যেকটা বিষয়েই একটা অবধারিত টাস্ক করতে হয়। তাকে বলে ‘প্রোজেক্ট’। বেশ ভারী ভারী বিষয় নিয়ে হয় এই প্রোজেক্ট। খাতা বানাতে হয়। হাজারো রকমের বিষয়োদ্দিষ্ট তথ্য জুড়ে জুড়ে উক্ত বিষয়টাকে প্রতিষ্ঠা করার নামই হল ‘প্রোজেক্ট’। প্রোজেক্ট করার সময়টা, ছেলেমেয়েরা নাওয়া খাওয়া ভুলে যায়।

তবে, অনেক ছেলে-মেয়েকে, আমাদের এখানে, আমি দেখেছি, সাইবার ক্যাফেতে লাইন দিতে। ক্যাফের দাদারা বিষয়টার যতরকম তথ্য টুক্‌ করে ছবিতে ও লেখাতে এক জায়গায় জড়ো করে তাকে সাজিয়ে গুছিয়ে, একটু ভালো ভালো কথা জুড়ে প্রিন্ট আউট বের করে দেয়। ছেলে-মেয়েদের কাজ হল, খাতায় সেগুলোকে নিজের হাতের লিখে ফেলা এবং ছবিগুলোকে সাঁটিয়ে ফেলা। ব্যাস, হয়ে গেল প্রোজেক্ট। কিছু টাকা খরচ করলেই যেখানে আর চাপ নেই সেখানে বিষয়টার গভীরে গিয়ে দু-দশটা বই খোঁজার হ্যাঙ্গামা কে করে রে বাপু?

এত কথা কেন বলছি? সুব্রত রুদ্রের ‘কাদম্বরী’ নামক বইটির পাতা উলাটাতে গিয়ে আমার একই অবস্থা হল। লজ্জার মাথা খেয়েই বলছি, আমি বইটার ডিজিটাল ভার্সান পড়েছি। ভাগ্যিস পড়েছি। কারণ এই বই কিনলে আমার কোন উপকার হত না। কারণ, ইন্টারনেট এতটাই শক্তিশালী হয়ে গেছে, বর্তমানে, যে এই বইয়ের অধিকাংশ তথ্যাই আমি কোন না কোনভাবে পেয়েই যেতাম। কিম্বা আমার কাছে রবীন্দ্র-কাদম্বরী বিষয়ক যে সমস্ত বই আছে, সেখান থেকেও জোগাড় করা খুব একটা সমস্যা হত না। পরিশ্রমের কথাটা বাদ দিলে। অবশ্য, বইটায় চোখ বোলাতে গিয়ে দেখলাম, আমি মোটামুটো পঞ্চাশ শতাংশ তথ্য সম্পর্কে জ্ঞাত আছি অলরেডী।

আমার ভার্সানটা আশা প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছে। ১৯৬০ সালের বই। সেই সময়ে এত তথ্যসম্ভার ছিল না, ফলে, হয়তো সেই সময়ে বইটার একটা তথ্যমূল্য ছিল। বর্তমানে রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কাদম্বরী দেবীর সুইসাইড নোট’ শীর্ষক একটি বই প্রকাশিত হওয়ার পর, মল্লিকা ও সুনীলের কল্পবাস্তবতা সমৃদ্ধ উপন্যাসের পর, হইচই সিরিজে দুপুর ঠাকুরপো-র দুটো সিজন মারমার কাটকাট হিট হওয়ার পর, এত লোক সম্পর্কটাকে নিয়ে মেতেছে যে, বাজারে বেশ কয়েকটি তথ্য ও তত্ত্বসমৃদ্ধ বই চলে এসেছে। পাবলিক ডিমান্ড বলা যেতে পারে। সেই দিক থেকে সুব্রত রুদ্র’র বইটার মূল্য আজকের সময়ে কতটা, এ প্রশ্ন উঠতেই পারে। বইটা বর্তমানে প্যাপিরাস পাবলিকেশান থেকে পাওয়া যায়, সুলভে।

সুব্রত রুদ্র তার বইটায় অধুনা প্রোজেক্ট করা বালক বালিকাদের মতো করেই বানিয়েছেনবইটা মূলত তিনতে অংশে বিভক্ত --- ১। কাদম্বরী দেবীর অতি সংক্ষিপ্ত জীবনী, ২। তাকে উদ্দেশ্য করে রবীন্দ্রনাথের লেখা বিভিন্ন রচনা (কবিতা, উৎসর্গপত্র, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, গদ্য কবিতা, আলাপ, চিঠি ইত্যাদি), এবং ৩। তাকে নিয়ে লেখা তার পরিচিত অন্যান্যদের লেখা কিম্বা স্মৃতিচারণ। এ সমস্তই তিনি রচনা করেছেন তৎকালীন প্রকাশিত বইগুলোর সাহায্যেতিনি লেখাটা তথ্য দিয়ে নির্মাণ করেছেন। তার সত্যতা বিচারে যান নি, কিম্বা, বলা ভালো, কোন ঘটনার পেছনে কতটা সত্য-মিথ্যা থাকতে পারে, তা নিয়ে মাথা ঘামান নি। ফলে সুব্রত রুদ্রের বইটার আত্মা নেই, তত্ত্ব নেই, তথ্য আছে, কাদম্বরী দেবী নেই। অস্তিত্ব আছে, ব্যক্তিত্ব নেই।

সুব্রত রুদ্রের লেখা কাদম্বরী দেবীর জীবনী থেকে কাদম্বরী দেবী সম্পর্কে ঠিক কি কি ব্যাপার আমরা জানতে পারি? ---

শিক্ষিতা ছিলেন তৎকালীন পত্রিকা সম্পর্কে তার ভালো ধারণা ছিল এমনকি সেই সময়ে মেয়েদের জন্য বরাদ্দ বইগুলো (ঠাকুরবাড়ী থেকে আর কি) বেশ মন দিয়েই পড়তেন

গাছপালা, পশুপাখী ভালোবাসতেন তেতলার ছাদে তার নিজস্ব বাগান ছিল চীনদেশীয় শ্যামাপাখী এবং খরগোশ পর্যন্ত পুষেছিলেন

রান্নায় অসাধারণ রবীন্দ্রনাথ এবং ঠাকুরবাড়ীর অনেকেই তার রান্না সম্পর্কে প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন

ভালো রিভিউ করতে পারতেন তখনকার দিনের জনপ্রিয় লেখক বিহারীলাল চক্রবর্তীর লেখা পছন্দ করতেন এক্ষেত্রে অবশ্য সবচেয়ে বড়ো এবং অমোঘ প্রমাণ, রবীন্দ্রনাথের প্রেরণাদাত্রী ছিলেন

ভারতী পত্রিকার নেপথ্য চালিকা ছিলেন ভারতী পত্রিকার প্রাণ এবং পত্রিকাগোষ্ঠীর মধ্যমণি ছিলেন তিনি।

নাটকে অভিনয় করতে জানতেন এমন কর্ম আর করব না, মানময়ী ইত্যাদি নাটকের অভিনয় করেছিলেন।

ছোটদের প্রচন্ড ভালোবাসতেন ঊর্মিলার মৃত্যু, কিম্বা ছোটদের কারো অসুখ করলেই তিনি সেবা করতেন প্রাণপণে।

দেখতে সুন্দর ছিলেন শ্যমলা, বড় চোখ আর দীর্ঘ চুল --- তার সৌন্দর্যের বৈশিষ্ট্য

সঙ্গীতেও তার দখল ছিল সঙ্গীতবোদ্ধা ছিলেন

১০ Woman Empowerment - ঘোড়ায় চড়তে পারতেন, স্বামী সমভিব্যাহারে কলকাতার রাজপথে ঘোড়ায় চরে বেড়াতে বেরোতেন নিয়মিত

      মোটামুটি চোদ্দ পৃষ্ঠার মধ্যে এই জীবনী শেষ। সুব্রত রুদ্র এর বেশি ভেতরে ঢুকতে পারেন নি। আমরা যেমন ক্লাস টুয়েলভে কারো জীবনী রচনা লিখতাম, সেই ভঙ্গীতেই তিনি সেটা লিখে ফেলেছেন এবং পাদটীকা দিয়েছেন।

      দ্বিতীয় পর্যায়ের কথায় আসিসেগুলো যোগাড় এবং সজ্জাবিন্যাসে খুব পরিশ্রম হয়েছিল কি? রবীন্দ্র রচনাবলী থেকে বেশিরভাগ রবীন্দ্ররচনা নিয়েছেন। সময়ানুসারে জড়ো করেছেন। কিন্তু ঘটনার অনেক দশক পরে রবীন্দ্রনাথ যখন সেই সময়টাকে নিয়ে লিখছেন বা বলছেন, তার স্মৃতি তাকে নিয়ে মায়াজাল রচনা করেছেন কি না সেটা নিয়ে ভাবেন নি। ধরেই নিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ যাহা বলিতেছেন বা লিখিতেছেন, সত্য লিখিতেছেন। এমনকি এক্ষেত্রে যেন ঠাকুরবাড়ীর সন্মান রক্ষার দায়ও তার নেই। লেখক রবীন্দ্রনাথ আর মানুষ রবীন্দ্রনাথে কিন্তু ফারাক আছে। তার বড়ো প্রমাণ তার রচনাবলী বনাম চিঠিপত্র। আর ঠিক এই জায়গাতেই রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু তার চিন্তাধারা এমন এক অদ্ভুত কামনাজগতের পথ ধরেছে, যেটাও মেনে নেওয়া যায় না।

১৯৬০ সালে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় সহ অনেকেই রবীন্দ্রনাথের জীবনী ও প্রবন্ধগুচ্ছ লিখে ফেলেছিলেন। লেখা হয়েছে ঠাকুরবাড়ী থেকে একগুচ্ছ স্মৃতিচারণ এবং জানা-অজানা অনেক মানুষ অনেক বই লিখে ফেলেছেন। স্মরণীয় মানুষ থেকে সাধারণ লেখক-লেখিকা। তার থেকেই কয়েকটা বই বেছে নিয়েছেন, আপাতদৃষ্টিতে যারা বিশ্বাসযোগ্য। খুব কমই তথ্য মেলে। যতটুকু পেয়েছেন তাই নিয়ে ডালি সাজিয়েছেন।

এই বইয়ের কি তবে কোন মূল্যই বর্তমানে নেই? সত্যি কথা বলতে, আমার বিশ্বাস, পরবর্তীকালে এমন বেশ কিছু তথ্যসমৃদ্ধ বইয়ের নাম আমি পেয়েছি, যা এই বইয়ের প্রয়োজনীয়তাকে অনেকাংশেই ক্ষীণ করে দিয়েছে। একটা-দুটো তথ্য ছাড়া দ্বিতীয় পর্যায়ের অধিকাংশই প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রজীবনীর প্রথমাংশেই মেলে, তার পর্যালোচনা এবং ইতিহাস সহযোগে। কেউ যদি বিস্তারিত পড়তে না চান, তাহলে এই বইটা অবশ্যই ভালো তথ্য সহায়ক। আর যেহেতু, বইটা তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখা হয় নি, ফলে এর মূল্যায়ণ একটা নির্দিষ্ট অংশেই প্রাথমিকভাবে সীমাবদ্ধ থাকবে।

 

====================

কাদম্বরী দেবী

সুব্রত রুদ্র

প্যাপিরাস

মুদ্রিত মূল্যঃ ১৫০/-

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে