ভারত সন্ধানে

 



Post Truth: Relating to or denoting circumstances in which objective facts are less influential in shaping public opinion than appeals to emotion and personal belief.

 

৬ এপ্রিল তারিখে একটি জনপ্রিয় বাংলা সংবাদপত্রে একটি ছোট্ট কলাম চোখে পড়েছিল। তারা আবার ইংরেজী সংবাদপত্র থেকে জেনেছেন, স্কুলের সিলেবাস, বিশেষত, ইতিহাসের সিলেবাসে বেশ কিছু বড়োসড়ো রদবদল হচ্ছে, যা সত্য অর্থে আপত্তিকর। ১১ এপ্রিল তারিখ উক্ত সংবাদপত্রে হিন্দোল ভট্টাচার্য মহাশয়ের একটা বড়ো কলাম বের হয়, যেখানে এই রদবদলের উদ্দেশ্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। আমাদের এদিকে এ নিয়ে তেমন হইচই হচ্ছে না। কারণ, ইতিহাস সত্য হোক কিম্বা মিথ্যা, বাবা-মায়েরা কেবল একটাই জিনিস চান, আর তা হল এই যে, এইসব ইতিহাসপাঠ অত্যাবশ্যকরূপে তার সন্তানকে ভালো রেসাল্ট তথা উন্নত ‘চাকর’ বানাতে সক্ষম কি না। কিন্তু দেশ জুড়ে যে এর একটা বড়োরকম বিবাদ হচ্ছে, তা সর্বভারতীয় সংবাদপত্র, ব্লগ, ভ্লগ, ম্যাগাজিন, ইন্টারনেট ইত্যাদি দেখলে বেশ টের পাওয়া যায়।

ইতিহাস বিকৃত হচ্ছে --- এই দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে একটাই প্রশ্ন, প্রকৃত ইতিহাসটি তাহলে কি? যদি ‘প্রকৃত’ জানতে সক্ষম হই, তাহলে বিকৃতিকরণ আপনি এসে ধরা দেবে। এখন, সময়ের সাথে সাথে ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত পরিবর্তন হয় বটে, কিন্তু ভাল করে স্টাডি করলে দেখা যাবে, তারও একটা ধারাবাহিকতা আছে, যা সত্যকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে গিরগিটি বানায় না, যাকে আমরা ‘পোস্ট ট্রুথ’ বলি। তাই আমি, প্রকৃত-র খোঁজে যে বইটি হাতে তুলে নিয়েছিলাম, তা হল টনি যোশেফের ‘আদি ভারতীয়’ বইটি, যা Early Indian নামে খ্যাত।

এখন প্রশ্ন এই যে, এই বইটিও প্রোপাগান্ডা নয় তা কে বলল? আসুন একটু খতিয়ে দেখা যাক্‌ ---

এই বইয়ের উদ্দেশ্য ভারতের উৎস সন্ধান করা। এখন এই উৎস সন্ধানের ভিত্তি কি? টনি যোসেফ তিনতে এভিডেন্স এনেছেন – ১) জেনেটিক এভিডেন্স, ২) আর্কিওলজিক্যাল এভিডেন্স এবং ৩) লিঙ্গুইস্টিক এভিডেন্স

জেনেটিক এভিডেন্সের দুটি মূল ভিত্তি --- ১) mtDNA, এবং ২) Y-DNA, প্রথমটি মা থেকে পরবর্তী প্রজন্মে, এবং দ্বিতীয়টি বাবা থেকে কেবলমাত্র ছেলের প্রজন্মে বংশানুক্রমে ধারারূপে এগিয়ে যায়। এখন আর্কিওলজিক্যাল এভিডেন্স থেকে প্রাপ্ত মানব-অবশেষের জিন থেকে আমরা পিছোতে পারব অতীতের দিকে, এবং এইভাবে আস্তে আস্তে প্রাগৈতিহাসিক ঘটনাক্রমকে জানতে পারব। বোঝাই যাচ্ছে, পুরো বিষয়টাই বিজ্ঞানসন্মত। এখানে কোনরকম কোন মহাকব্যিক কিম্বা শাস্ত্রোচিত দৃষ্টিভঙ্গি নেই। এখন এই জেনেটিক এভিডেন্সের ব্যাপারেও টনি যোসেফ ডিটেইলসে জানিয়েছেন বটে, কিন্তু তা আমি, এখানে আলোচনা করলাম না। বইটি পড়তে পারেন, অথবা ইউটিউবে এ ব্যাপারে অনেক ডকুমেন্টারি পাবেন। সেখান থেকে ব্যাপারটা আরও খোলসা হবে।

অন্যদিকে লিঙ্গুইস্টিক এভিডেন্স হল মূলত লিপি এবং ভাষার ওপর ভিত্তি করে ইতিহাসকে জানার চেষ্টা, সেই ভাষা আধুনিক যুগে কীভাবে এসেছে সেটা একটা বড়ো গবেষণার পর্যায়। সেখানে আমরা তিনটে তত্ত্ব পাই --- ১) ইন্দো-ইউরোপিয়ান মাইগ্রেশান, ২) দ্রাভিডিয়ান সাবস্টেট এবং ৩) অস্ট্রোএশিয়াটিক ইনফ্লুয়েন্স। মূলত এই তিনটি তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্টিত এই এভিডেন্স পূর্বোক্ত দুটো এভিডেন্সের সাথে সাজুয্য ঘটানোর চেষ্টা চলছে, অনেকাংশে সফলতা মিলেছে এবং আমরা একটা রূপরেখা আন্দাজ করতে পারছি।

এই পদ্ধতিগুলো থেকে ভারতের ক্ষেত্রে ঠিক কি ক্রোনোলজি পাওয়া যাচ্ছে? মোট নটা সময়কাল পাওয়া যাচ্ছে --- প্যালেওলিথিক যুগ (২০ কোটি ~ ১০,০০০ খ্রীঃপূঃ), মেসলিথিক যুগ (১০,০০০ ~ ৬,০০০ খ্রীঃপূঃ), নিওলিথিক যুগ (৬,০০০ ~ ২,০০০ খ্রীঃপূঃ), ইন্দাস ভ্যালি সিভিলাইজেশান (৩৩০০ ~ ১৩০০ খ্রীঃপূঃ), বৈদিক যুগ (১৫০০ ~ ৬০০ খ্রীঃপূঃ), মৌর্য ও গুপ্ত যুগ (৩২২ খ্রীঃপূঃ ~ ৫৫০ খ্রীষ্টাব্দ), মধ্যযুগ (৫৫০ ~ ১৫২৬ খ্রীষ্টাব্দ) এবং কলোনিয়াল যুগ (১৫২৬ ~ ১৯৪৭ খ্রীষ্টাব্দ)

মোটামুটি এই যুগগুলোকে এবং পদ্ধতিগুলোকে ধরে নিয়ে যদি এগোনো যায়, তাহলে দেখতে পাবো, টনি যোসেফ বলছেন, সূদূর আফ্রিকা থেকে মানুষের আগমন ঘটেছে এবং পরবর্তীকালে বেশ কতকগুলি মাইগ্রেশান ঘটেছে। সেগুলো হল ---

১) আউট অফ আফ্রিকা মাইগ্রেশান --- আধুনিক মানব অভিবাসী, ২) এনশিয়েন্ট মাইগ্রেশান --- জার্গোসের অভিবাসী, ৩) ইন্দো-আরিয়ান মাইগ্রেশান --- স্তেপভূমির অভিবাসী, ৪) দ্রাভিডিয়ান মাইগ্র্যান্টস --- হরপ্পার অভিবাসী, ৫) পরবর্তীকালে আগত বিভিন্ন অভিবাসী।

অর্থাৎ, এটা নিশ্চিত করছেন টনিভাই যে, আমাদের সভ্যতার সূচনা হরপ্পার হাত ধরে অন্তত নয়, কিম্বা মেহেরগড় থেকেও নয়। বরং হরপ্পা এবং মেহেরগড় নির্মাণে যাদের হাত ছিল, সেইসব অভিবাসীরা ধীরে ধীরে হাজার হাজার বছর ধরে এখানে আসে, ধীরে ধীরে বসতি স্থাপন হয়, ধীরে ধীরে নগর সভ্যতার পত্তন হয়, ধীরে ধীরে তার লয়-ও হয় এবং তারা সেখান থেকে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে জম্বুদ্বীপের আরও গভীরে। তিনি লিখছেন, “ভারতীয় সংস্কৃতিতে জোর করে কৃত্রিম অভিন্নতা আরোপ করার জন্য অব্যাহত ও সর্বনাশা প্রচেষ্টার একটি কারণ আমাদের ইতিহাস রচনার ধরন, যেখানে প্রায়শই যুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে আত্মপক্ষ সমর্থন করা হয়েছে। যবে থেকে তথ্যাদি উপলব্ধ হয়েছে, ইতিহাস বইগুলি ঠিক সেই সময় থেকেই শুরু হয়; তার পূর্ববর্তী অংশগুলি হয় উপেক্ষা করা হয় বা খুব বেশি হলে সামান্য কয়েকটি অনুচ্ছেদ বা পৃষ্ঠার মধ্যে সেসব কথা সেরে ফেলা হয়।”

এখন টনিভাইয়ের এই বইটির কতটা প্রোপাগান্ডা, কতটা পোস্ট ট্রুথ আর কতটাই বা সত্যতা আছে, সেটার বিচার করা দরকার। তবে তা অবশ্যই সনাতন পদ্ধতিতে নয়। বিজ্ঞাসন্মতভাবে। বিজ্ঞানের যুগে টেকনোলজিকে হাতিয়ার করে আমরা যদি সনাতন পদ্ধতির জয়গান করি, তাহলে সেটা বড়োই হাস্যকর। টনিভাই কিন্তু তা করেন নি। তিনি বিজ্ঞানসন্মত পদ্ধতিতেই এগিয়েছেন, তার বইটা পড়ে, অন্তত আমার, এইটুকুই মনে হল। মাঝখান থেকে ছোটবেলায় কাকাকে একটা ছড়া খুব বলতে শুনতাম, আমরা যখন জোরে জোরে ‘স্বরে অ’, ‘স্বরে আ’ পড়তাম তখন, সেইটাই বারবার করে আজ মনে পড়ছে, তবে তা আধুনিক পরিভাষায়, আর সেটা হল ---

“ইতিহাসে পাতিহাস, ভূগোলেতে গোল

পোস্ট ট্রুথে মাথা নেই, হয়েছি পাগোল।”

 

======================

Early Indians

Tony joseph

Juggernaut Publication

Price: 341/-

বাংলা অনুবাদঃ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী

মঞ্জুল প্রকাশন

মুদ্রিত মূল্যঃ ৩৯৯ টাকা

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা

 

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে