প্রধন্যারামায়ণ – ১

 



আয়ুষ্যমারোগ্যকরং যশস্যং সৌভ্রাতৃকং বুদ্ধিকরং শুভং চ।

শ্রোতব্যমেতন্নিয়মেন সদ্ভিরাখ্যান্মোজস্করমৃদ্ধিকামৈঃ।। ১২৮ । ১২৫ ।। (যুদ্ধকান্ড)

 

      একটি বিখ্যাত মহাকাব্য বাল্মীকী রামায়ণের ষষ্ঠকান্ড, যার নাম ‘যুদ্ধকান্ড’, আমরা আদর করে ডাকি ‘লঙ্কাকান্ড’, সেই লঙ্কাকান্ডই শেষ হচ্ছে এই শ্লোকটি দিয়ে। এর বঙ্গার্থ হল --- এই কাব্য আয়ু, আরোগ্য, যশ এবং সৌভাতৃত্বের বিবর্ধনকারী, উত্তম বুদ্ধিবৃত্তির জনক ও মঙ্গলকর। এতএব, সুখসমৃদ্ধির কামনায় সৎপুরুষগণের এই উৎসাহব্যঞ্জক ইতিহাস যথানিয়মে শ্রবণ করা কর্তব্য। এর পূর্ববর্তী ১৮ শ্লোক জুড়ে (১০৭ ~ ১২৪) রামায়ণের মাহাত্ম্যের কথা বলা হচ্ছে। পূর্বাপর অন্যান্য কান্ডের শেষে এমন কোন মাহাত্ম্য নেই যখন, তখন বোঝা যাচ্ছে বাল্মীকী মুনি এই কান্ডের পরেই রামায়ণ সমাপন করতে চাইছেন।

১০৭ এর ঠিক আগের শ্লোকগুলোর বিষয়বস্তুগুলো মূলত কি কি?

১। যুদ্ধে রাবণের পরাজয় ও সীতার অগ্নিপরীক্ষা

২। অযোধ্যায় রামের আগমন, ভরত কর্তৃক রাজ্যলাভ এবং শ্রীরামের রাজ্যাভিষেক

৩। রামরাজ্যের বর্ননা এবং রামের রাজত্বকালের সময় বর্ননা

      এর ঠিক পরেই আসে গ্রন্থমাহাত্ম্য বর্ণন। অর্থাৎ, এটুকু পরিস্কার, রামায়ণ সাতকান্ড নয়, মূলত ছয়কান্ডেই সমাপন হওয়াটাই বাঞ্ছনীয় ছিল।

এবার যদি উত্তরকান্ড-কে দেখা যায় তাহলে দেখা যাবে, এই কান্ডটিকে কেমন যেন টেনে বাড়ানো হয়েছে। রামের ওপর বিষ্ণুত্ব আরোপন, কিম্বা রাবণের কথা ইত্যাদি যুক্ত করা হচ্ছে। যুক্ত করা হচ্ছে হনুমানের কথা। যুক্ত করা হচ্ছে সীতার বনবাস এবং লব-কুশের কথা। যুক্ত করা হচ্ছে বাল্মীকী মুনির আশ্রমে তাদের বড়ো হওয়া, তাদের রামায়ন গান গাওয়া এবং অবশেষে সীতার পাতালপ্রবেশ ও রামের দেহত্যাগ সরযূর পুতসলিলে। সবশেষে আবার রামায়ণ কাব্যপাঠের মাহাত্ম্য বর্নন। শেষ শ্লোকটি নিম্নরূপ---

এবমেতৎ পুরাবৃত্তমাখ্যানং ভদ্রমস্তু বঃ। / প্রব্যাহরত বিস্রব্ধং বলং বিষ্ণোঃ প্রবর্ধতাম্‌ ।। ১১১ । ২৫ ।।” --- বলা হচ্ছে এই পুরাতন উপাখ্যান বিশ্বাসপূর্বক পাঠ করতে। এবং শ্রীবিষ্ণুর জয় হোক।

মজার ব্যপার, উত্তরকান্ডের একটা বড় ঘটনা হলেন লব-কুশ। রামায়ণের ‘বালকাণ্ডে’ আমরা দেখতে পাই যে, লব-কুশ নামক দুই আশ্রমিকের পরিচয় খুব একটা স্পষ্ট নয়। এক জায়গায় বলা হচ্ছে বটে ‘ধর্মজ্ঞৌ রাজপুত্রৌ যশস্বিনৌ’ --- আরেক জায়গায় বলা হচ্ছে তারা যেন শ্রীরামের দেহ থেকে জাত শ্রীরামেরই দুটি প্রতিবিম্ব --- ‘বিম্বদিবোত্থিতৌ বিম্বৌ রামদেহাৎ তথাপরৌ।’ কিন্তু কোথাও তারা যুদ্ধকুশলী বা কিম্বা অযোধ্যার রাজপুত্র এমন বলা হয় নি। এখন উক্ত শ্লোক থেকে আমরা যদি সিদ্ধান্ত নিই তারা রামের পুত্র, সেই কারণেই বলা হচ্ছে, এমনটা না-ও হতে পারে। শ্রীরাম এবং শ্রীকৃষ্ণ কি একই রকম দেখতে নয়? বিষ্ণুর এই দুটি অবতারকে আমরা ‘সম’ মানি না? যদিও তাদের কার্যপ্রণালী এবং প্রকৃতি সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হয়েছে। ফলে আমরা বলতে পারি না যে, লব-কুশ দুজনেই আসলে রামপুত্র।

মজার কথা, রামের এই জীবনী বাল্মীকী মুনিকে শুনিয়েছেন নারদ, যিনি বাল্মীকীর আশ্রমে এসেছিলেন একদিন। বালকান্ডে সেই অমোঘ প্রশ্নটি আছে একদম শুরুর ২,৩ এবং ৪ নম্বর শ্লোকে --- “মুনে! বর্তমানে এই পৃথিবীতে কোন্‌ এমন মহাত্মা আছেন, যিনি সর্বগুণান্বিত মহাবীর, ধর্মজ্ঞ, কৃতজ্ঞ, সত্যভাষী, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, সচ্চরিত্র, সকল প্রাণীর হিতসাধনকারী, বিদ্বান, কর্মদক্ষ, প্রিয়দর্শন, সংযতাত্মা, কান্তিমান, অদোষদর্শী এবং যুদ্ধে ক্রুদ্ধ হলে দেবতারাও ভীত হন?

উত্তরে নারদমুনি তার কাছে রামচরিত্র বর্ননা করেন --- মুনে বক্ষ্যাম্যহং বুদ্ধ্বা তৈর্যুক্তঃ শ্রূয়তাং নরঃ --- অতঃপর, ক্রৌঞ্চমিথুন বধ, বাল্মীকীর শ্লোক উচ্চারণ, এবং বুঝতে পারা যে তিনি আসলে মহাকব্যের কবি। এরপর ব্রহ্মার আগমন ও আদেশ --- রামস্য চরিতং কৃৎস্নং কুরু ত্বমৃষিত্তম --- আপনি রামচন্দ্রের সমগ্র চরিত্র বর্ননা করুন, নারদের কাছে যেমনটি শুনেছেন --- বৃত্তং কথয় ধীরস্য যথা তে নারদাচ্ছ্রুতম্‌

নারদ তাকে কত পর্যন্ত বলেছেন? রামের রাজ্যাভিষেক পর্যন্ত। আর তিনি কতটা লিখছেন? রাজ্যাভিষেক অবধি। আর কাকে এই গান প্র্যাকটিশ করাচ্ছেন? লব-কুশ। অর্থাৎ, গোটা রামায়ণটি লেখার সময়ের অনেকটাই, হিসেবমতো, সীতাদেবীর বাল্মীকীর আশ্রমে থাকার কথা, কারণ উত্তরকান্ডের দাবী সীতার পুত্র লব-কুশ। কিন্তু গোটা রামায়ণে এর কোন উল্লেখ নেই। এ কি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য? পাছে রাজা রাম কর্তৃক সীতা বা লব-কুশের কোন ক্ষতি হয়? যিনি সীতাকে বনবাসে পাঠাচ্ছেন, তিনি কিম্বা তার রাজ্যের অধিবাসীরা কি না করতে পারেন ধর্মের খাতিরে, এমন শঙ্কা তো হতেই পারে। এতএব লব-কুশের পরিচয়, এমনকি সীতার কথা, অন্ততঃ, ছয়কান্ডে বিন্দুমাত্র জানা যায় না। কিন্তু তা বলে এটাও নিশ্চিতকরণ করা যায় না যে, বাল্মীকী মুণি নারদজী ছাড়াও সীতাদেবীর কাছে রামায়ণের বিস্তারিত বর্ননা শুনেছেন।

রাম যখন লঙ্কা জয় করে আযোধ্যায় ফিরে এলেন, তখন তিনি সাধারণ মানবই ছিলেন। কিন্তু তার ব্যক্তিত্বই এমন বিরল ছিল, সেই সাথে তার দক্ষিণাত্য জয় ও সমগ্র আর্যাবত্যের দাক্ষিণাত্যের ওপর প্রভাব বিস্তার এতটাই পরবর্তীকালের ইতিহাসকে পালটে দিয়েছিল যে, তাকে দেবতার আসনে বসানো হয়। রাম মানুষ থেকে দেবতা হয়েছেন। অনার্যের ওপর আর্যের বিজয়াভিযানের প্রথম প্রতিভূ রামের জন্য রামায়ণ লেখা যেতেই পারে।

উত্তরকান্ডের প্রক্ষিপ্ততা সম্পর্কে অনেক প্রমাণ আছে। বিতর্ক আছে। আমি সে কারণে যাব না, সেটা বলার উদ্দেশ্যও আমার নয়। আমি একটা কথাই বলতে পারি যে, রামগানের সার্থক রূপায়ণ পরবর্তীকালে যিনি করেছেন সেই গোস্বামী তুলসীদাসও তার রামচরিতমানস থেকে উত্তরকান্ডটি বাদ দিয়েছেন। ফলে তার প্রক্ষিপ্ততা নিয়ে নিয়ে আমার কিছু বলার নেই।

রামায়ণের জনপ্রিয়তাই পরবর্তীকালে অনেক আঞ্চলিক রামায়নের জন্ম দেয় এবং সেখান থেকে, পরবর্তীকালে এই উত্তরকান্ডের জন্ম হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

উত্তরকান্ডের বেদনা আমার কাছে অন্য দিকে। যদি উত্তরকান্ড প্রক্ষিপ্ত না হত, সমগ্র উত্তরকান্ড বাদ যেত, তাহলে কিন্তু, বালীহত্যা বাদে রামের চরিত্র সেই অর্থে নিষ্কলঙ্কই ছিল। উত্তরকান্ড আধুনিক নারীবাদীদের কাছে এক অমোঘ অস্ত্র হয়ে উঠল। সীতার অগ্নিপরীক্ষা নিয়ে কিম্বা তার বনবাস নিয়ে যে অর্থে আলোচনা করা হয়, যা আমার কাছে বৈধ, উত্তরকান্ড প্রক্ষিপ্ত প্রমানিত হলে, তার কোন মূল্যই থাকে না। লঙ্কায় অগ্নিপরীক্ষা নিয়ে কোন নারীবাদী বিদ্রোহ করেছেন কি? জানার ইচ্ছা রইল। অযোধ্যায় দ্বিতীয় অগ্নিপরীক্ষার যে পরিপ্রেক্ষিত, তা কিন্তু যথেষ্ট পীড়াদায়ক। তেমনই পীড়াদায়ক ‘শম্বুকবধ’। যা দলিতদের হাতের আরেক মহাস্ত্র। এবং এই কান্ডেই, আসলেই, রামের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়, রামের ব্যক্তিত্ব নিয়ে কাঁটাছেড়া করা হয়, রামের কৃতিত্ব নিয়ে সন্দেহ হয়।

বাল্মীকী মুনি কি এতটাই বোকা ছিলেন, যে এমন একটা পারফেক্ট চরিত্র নির্মান করতে গিয়ে এত ইম্পার্ফেক্টনেস জুড়ে দেবেন? বা সমগ্র রামায়ণে রামের চরিত্রের সাথে কি উত্তরকান্ডের রামের চরিত্র খাপ খায়?

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে