তাঁকে ছোঁয়া গেল কি?
এ যেন এক
বালিকা ঘরের এক কোনে সূঁচ-সুতো নিয়ে বসেছে। খেলাচ্ছলে গৌরী বালিকা মালা তৈরী করছে
শিব ঠাকুরের জন্য। পাশের ঝুড়িতে লাল-নীল-হলুদ হরেকরকমের ফুল। আপনমনে যে ফুল হাতের
কাছে উঠছে তাই সূত্রাকারে গাঁথা হচ্ছে। তার কোন নির্দিষ্ট ছন্দ নেই, তাল নেই, লয়
নেই। তবুও যে মালা গেঁথে সে শিব ঠাকুরের গলায় পরাল, তা অনিন্দ্যসুন্দর।
তেমনই, কখনও
সেকেন্ড পার্সন ন্যারেটিভে, কখনও ফার্স্ট পার্সন ন্যারেটিভে, কখনও থার্ড পার্সন
ন্যারেটিভে; কখনও চলিত ভাষায়, কখনও বা সাধু গদ্যে; কখনও কাব্যের রূপমায়, তো কখনও
গদ্যের আবেগে; কখনও বা কল্পিত সত্য, কখনও বা সত্যের কল্পনা অবলম্বন করে সিদ্ধার্থোপন্যাসের
এক ভাঙাচোরা স্থাপত্য রচনা করেছেন সন্মাত্রানন্দ।
“ইতিহাস ও ঐতিহ্যসম্মত তথ্যসমৃদ্ধ একটি বুদ্ধজীবনী নতুন করে লেখা আমার এ উপন্যাসের উদ্দেশ্য ছিল না। বুদ্ধচরিত্র অনুধ্যান করে নিজের মনকে শান্ত ও সুসমাহিত করার জন্যই আমি বইটি লিখেছি। অর্থাৎ এ উপন্যাস আমি লিখেছি প্রাথমিকভাবে আমার নিজের জন্যই নিতান্ত ব্যক্তিগত প্রয়োজনে।” লিখছেন লেখক সন্মাত্রানন্দ। এবং নিজের প্রয়োজনে বুদ্ধের ঠিক কোন অংশটিকে পছন্দ করলেন?
তার ‘সিদ্ধার্থ’ থেকে ‘বুদ্ধ’ হয়ে ওঠার ঘটনাটিকে। সার্থক তার সাহস, সার্থক তার
নির্মাণ প্রচেষ্টা। সিদ্ধার্থের বুদ্ধ হয়ে ওঠা নিয়ে কয়টা বাংলা সাহিত্য আছে এযাবৎ?
কোনো মানুষ যখন নিজগুণে মহান হয়ে ওঠেন, সেই মহান হয়ে ওঠার পর্যালোচনায় এক সাহিত্য
নির্মাণ সম্ভবপর করে উঠতে পারেন কতজন লেখক? কারণ, মানুষের সাধনপথের
দ্বন্দ্বনির্মান, ভাষার আখরে, কঠিন। ফলে, এই উপন্যাসে, একে একে উঠে আসে অনেকগুলো চরিত্র – মার,
পূরণ কশ্যপ, মক্খালি গোশাল, নিগন্থ নাথপুত্ত, সঞ্জয় বেলাঠিপুত্ত, নৈরঞ্জনা
নদীতীরের পাঁচ বন্ধু ইত্যাদিরা। সিদ্ধার্থের বুদ্ধ হয়ে ওঠার দ্বান্দ্বিক পরিকাঠামো
নির্মিত হয়।
কিন্তু গন্ডগোলটা বাঁধল পরের কথাকটায়। উনি বলছেন, “লিখবার পর মনে হল, এই পৃথিবীতে আমার মতন করে কেউ কেউ হয়তো চিন্তা করেন। তাঁরা আমার সমমনস্ক, সমভাবাপন্ন। তাঁদের সঙ্গে এই বইটির সূত্রে আমি যোগাযোগ করতে চাই। তাই,
এই উপন্যাস প্রকাশ করা হয়েছে।” এইখানেই শুরু হল পাঠকদের
কথা ভেবে লেখা। এখন কয়টা পাঠক মানবমনের চিরপরিচিত দ্বন্দ্বটাকে কাঁটাছেড়া করতে
চায়? বিশেষত, যারা বেডরুমীয় ঐতিহাসিক কাহিনী পড়তে পড়তে ঢুলতে থাকেন, যাদের সংখ্যা
স্বভাবতই বেশি, তাদের কথা ভাবতে গেলে একটু মিষ্টি-মধুর কিছু রাখা উচিৎ বৈ কি।
ফলে প্রথম ছটি পর্বে যে টানটান আন্তঃ
পর্যালোচনার মধ্যে দিয়ে কাহিনী এগোচ্ছিল, ‘একটি নামহীন অধ্যায়’ পর্বে এসে
সুজাতা-সৌদাস প্রেমকাহিনী ঢুকিয়ে, সেই সাথে লেখক তার নিজস্ব চিরপরিচিত টাইম লাইন
খেলা খেলতে গিয়ে প্রথমে সুবল-মল্লিকা এবং পরে ময়ুখ এবং জন্মান্তরবাদ নিয়ে এসে,
হরিণী-প্রেমে গদোগদো করে শেষে কাল্পনিক বুদ্ধচরিত রচনা করতে গিয়ে যে ছ্যাড়াব্যাড়া
করলেন, মন খারাপ হয়ে গেল। মনে হল, ন্যাঃ! বুদ্ধ অনুধ্যান করতে গিয়ে
সুজাতা-মল্লিকা-হরিণী অনুধ্যান হয়ে ব্যাপারটা না তো সিরিয়াস থাকল, না একটা মিষ্টি
মধুর কিছু হল। পায়েস দিয়ে সুক্তো খাওয়ার মতো মুখ করে বই শেষ করলাম। ‘জন্মান্তরবাদ’
বুদ্ধ প্রতিষ্ঠা করেছেন, সিদ্ধার্থ নন। ফলে বিষয়বস্তুটা কীরকম যেন একটা ‘সাহারায়
সীতাহরণ’ টাইপ হয়ে গেল।
পাঠিকা ঠিক বুঝতেই পারলেন না, যে, তিনি ঠিক
কি পড়লেন? সিদ্ধার্থের অন্তর্দ্বন্দ্ব’র চরম সীমার ধাপের ধাপে ধাপে আরোহণ, না কি,
হীনযানী মনোভাব থেকে সরে এসে মহাযানী মিষ্টি মধুরতা পাঠকদের পরিবেশন? ভাগ্যিস আপনি
এর পাশাপাশি বজ্রযানী বুদ্ধকে স্মরণ করেন নি!
অথচ, প্রথম ছয় এবং শেষ তিন (১৫, ১৬, ১৭
পর্ব) অধ্যায়ের গভীরে গিয়ে আপনি এমন একটা রচনা বানাতে পারতেন, যা, আপনার, হ্যাঁ
হ্যাঁ, আপনার বুদ্ধ অনুধ্যানের অমৃত বারিধারা আমরা পেতে পারতাম। অধিকাংশ পাঠকের
কাছে হয়তো এ বর্জিত হত, কিন্তু ভাবীকালের কাছে একটা সার্থক সিদ্ধার্থ চরিত নির্মাণ
--- বাংলায় হতে থাকতে পারত। আমি যখন বুদ্ধ চরিত পড়ব, তখন বুদ্ধচরিতই পড়ব। সেই
সিদ্ধার্থের কাছে বাকি সমস্ত চরিত্রই ম্লান হয়ে থাকবে। প্রসঙ্গত, আপনি এর বিরোধিতা
করতেই পারেন, কিন্তু, মনে রাখবেন, ‘চুয়া চন্দন’ লেখার সময়ে মহাপ্রভুকেও
রোমান্সের কারণে পার্শ্বচরিত্র হতে হয়েছিল, কারণ, সেটাই ছিল গল্পের দাবী। ‘মহাপ্রভু’
বেডরুম রোমান্স নন, ‘নিমাই’ এক রোমান্টিক হিরো। কিন্তু যখন ‘গোরা রায়’ লীলা করেন তখন
রচিত হয় ‘অমিয় নিমাই চরিত’। আপনি দুই নৌকায় পা দিলেন। আপনার মনে আশা, “আমি বিশ্বাস করি, অনাগত কালে তথাগতকৃপায় আমার সমমনস্ক একজন পাঠক-পাঠিকা অন্তত কখনও কোথাও নিশ্চয়ই জন্মাবেন, যিনি আমার এই ব্যক্তিগত সিদ্ধার্থকে ভালোবাসবেন— তখন আমি হয়তো থাকব না, ভবিষ্য যুগের সেই অদেখা পাঠক-পাঠিকার জন্য আমি এই চিত্রধর্মী কথাকাব্যটি লিখে রেখে গেলাম।” কিন্তু আপনার এ লেখায়
ব্যক্তিগত সিদ্ধার্থ কই? অর্ধেক অংশ জুড়ে যে সুজাতা-সৌগত প্রেমজর্জর আলেখ্য!
সিদ্ধার্থের কর্মবাদ, অক্রিয়বাদ, অদৃষ্টবাদ,
অজ্ঞেয়বাদ, জড়বাদ ইত্যাদি খন্ডন-কথোপকথন সেই গভীরতায় পৌছল না আপনার কলমে, যে
গভীরতায় গেলে আমাদের ‘সিদ্ধার্থ অনুধ্যান’ আরও গভীর এবং আন্তরিক হতে পারত। সেই
পর্যায় থেকে, আমার চোখে, আপনি, অনবদ্য নির্মাণ করেছেন ‘সিদ্ধার্থ-মার দ্বন্দ্ব’।
মার – যা সিদ্ধার্থেরই অন্ধকার দশা, যার অনুক্ষণ উপস্থিতি এবং নিরন্তর বাক্-বিতন্ডা,
যা সিদ্ধার্থ, সিদ্ধার্থ কেন, যে কোন মানুষমাত্রেই ব্যক্তিগতভাবে মুখোমুখি হয়, তার
এক সার্থক রূপায়ন আপনার এই লেখায় পাই। এবং তা বেশ কয়েকটি পর্ব জুড়ে।
সেইসাথে আপনার লেখনশৈলী। প্রথম উপন্যাসেই
আপনি মাত করে দিয়েছিলেন। এই পর্যায়েও তা অনুপম সৌন্দর্য নিয়ে প্রতিভাত হয়েছে। আর
তার সাথে বড়ো সুন্দর সুন্দর কিছু শব্দ, যার ব্যবহার ক্রমক্ষীয়মাণ, অন্তত,
শরদিন্দু’র পরে আমি খুব কম কারো লেখায়, ইতস্তত, দেখতে পাই।
সব মিলিয়ে এই ছোট্ট উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে
সিদ্ধার্থকে ভাবীকালের পাঠকেরাও কতটা ছুঁতে পারবেন, তা ভবিষ্যতের কাছেই রেখে দেওয়া
ঠিক বোধ করি, সন্ধিগ্ধতার সঙ্গে।
======================
তোমাকে
আমি ছুঁতে পারি নি
সন্মাত্রানন্দ
ধানসিঁড়ি
পাবলিকেশান
মুদ্রিত
মুল্যঃ ২২৫ টাকা
ছবি
কৃতজ্ঞতাঃ অমিত ভড়, সমর্পিতা
Comments
Post a Comment