প্রেমের খোঁজে

 



সময়ের সমস্ত চিহ্ন ইতিহাস তার পেটিকায় তুলে রাখে না। অনেক বাদ দিয়ে সামান্য কিছু সঞ্চয় ক’রে রাখে মাত্র। ইতিহাসের সেই সামান্য সঞ্চয় থেকে শুধু অস্পষ্ট একটা আদল ধরা পড়ে। শূন্যস্থানগুলি ভরাট করে নিয়ে সময়ের নবনির্মাণ ক’রে নেয় ইতিহাসাশ্রয়ী সাহিত্য। সেই নবনির্মানে সৃজনশীল কল্পনার মুক্ত পক্ষবিস্তার।

লিখছেন সন্মাত্রানন্দ। কথা সত্য। তবু কি এইটাই শেষ কথা? না। আসল কথাটা এবার তিনি লিখছেন, “তবু কালের বিনির্মাণই ইতিহাসাশ্রয়ী সাহিত্যের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। কালের মুকুরে আমাদের সমকালকে প্রতিবিম্বিত ক’রে মানব অস্তিত্ব ও সম্পর্কের শাশ্বত কেন্দ্রটিকে আবিস্কার করা এসব রচনার মুখ্য অভিলক্ষ্য।”

খাঁটি কথা। আরেকটা কথা কিন্তু উনি উল্লেখ করলেন না, যেটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, তা হল, ‘বিকৃতি’। কল্পনার উড়ানে ইতিহাসকে কতটা বিকৃত করছি, সেটা একটা বড়ো বিষয়। এতে করে পাঠক হয়তো কল্পনার ডানা মেলে অনেক কিছু চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখতে পারে। কিন্তু কোন ইতিহাসবিদকে ডাকিয়ে ঐতিহাসিক লেখাগুলোকে ভালো করে স্ক্রুটিনি করলে বোঝা যাবে কল্পনার ডানার দৈর্ঘ্যটি কতটাই বা বর্তমানের নিরিখে রচিত হচ্ছে; আর কতটাই বা অতীত ইতিহাসের সাথে সামঞ্জস্য রেখে নির্মিত হচ্ছে। বর্তমানে অনেক অনেক ঐতিহাসিক গল্প-উপন্যাসের রিভিউ চোখে পড়ে, যেখানে অতি সাধারণ পাঠক-পাঠিকাও এই অমার্জনীয় বিকৃতি নিয়ে আলোচনা করছেন। অর্থাৎ, ত্রুটিটা এতটাই বাড়াবাড়ি রকমের যে, কোলের খোকাও হেসে ফেলছে, অথচ লেখকপুঙ্গব তা নিয়ে উদাসীন।

সন্মাত্রানন্দকে ঠিক এই জায়গাতেই আমার বেশ ভাল লাগে। অতিরিক্ত রকমের কিছু তিনি তার উপন্যাসে যোগ করেন না। তার সঙ্গে যেটা আরও সুন্দর হয়ে ওঠে তা হল, ঐতিহাসিক চরিত্রটি নির্মাণের কারণসহ ব্যাখ্যা।

উদাহরণস্বরূপ, এই বইয়ের ‘অশ্রুমতী’ উপন্যাসের কথাই ধরুন না, দুই বৌদ্ধ দার্শনিক অসঙ্গ এবং বসুবন্ধুর গল্প বলছেন উনি। সঙ্গে তাদের মা প্রসন্নশীলা। যদি দার্শনিকদ্বয়ের মধ্যেই আলোচনাটা নিয়ে আসি, তাহলে দেখতে পাই, বসুবন্ধু তক্ষশীলা মহাবিহারে গিয়ে ঠিক কি শিখছেন? সৌত্রান্ত্রিক মত এবং বৈভাষিক মতের পার্থক্য। দুটি মত বুদ্ধের নয়, বুদ্ধ পরবর্তী ভক্তকূলের। তো সেখানে বৈভাষিক মতের আলোচনা করতে এসে ‘ক্ষণ-ভঙ্গ-বাদ’ প্রতিপাদের নির্মাণ, এবং তৎপরবর্তী তার বিরুদ্ধমতের প্রতিষ্ঠার এক সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আমাকে ঋদ্ধ করে। অর্থাৎ, ‘বাহ্যপ্রত্যক্ষবাদ’ এবং ‘বাহ্যনুমেয়বাদ’-এর তুলনামূলক যে আলোচনা সপ্তম পর্ব জুড়ে লেখক করলেন, তা বেশ কয়েকবার পড়ার পর খানিকটা হৃদয়ঙ্গম হল। এই পড়াশোনার দিকটা খুলে দেওয়াও কিন্তু ঐতিহাসিক লেখকের কাজ হওয়া উচিৎ বলে আমি মনে করি, নচেৎ ঐতিহাসিক সাহিত্যের মূল্য থাকে না।

‘ভামতী’ এবং ‘অশ্রুমতী’ দুটো নভেলা বলা চলে। দুই সময়ের দুই কাহিনী। একটি, নবম শতাব্দীর পন্ডিত বাচষ্পতি মিশ্র’র জীবনালেখ্য। অপরটি খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকের ‘অনঙ্গ’ এবং ‘বসুবন্ধু’-র জীবন কাহিনী। এখন এই দুটি ক্ষেত্রেই তিন চরিত্রের উত্তোরণ পৃথকভাবে হয়েছে, যদিও তার মূল কেন্দ্র একটাই – প্রেম।

ঠিক এই কারণে প্রেমের যে রূপ, তাকে নারীতে কল্পনা করার চেষ্টা করা হয়েছে। বাচস্পতি মিশ্র শাস্ত্রনিমগ্ন। একে একে বিভিন্ন শাস্ত্রের টীকা রচনা করে গিয়েছেন আজীবনভর। সে টীকা সমসাময়িক কালে কেমন আদর পেয়েছিল? “যুক্তির প্রাখর্যে, চিন্তার সাবলীলতায়, ভাবের গাম্ভীর্যে, ভাষার সুচারুতায়, বিচারশক্তির অসামান্য নিপুণতায় বাচস্পতির টীকাগুলি দেবী সরস্বতীর কৃপাকরুণার কিরণধারায় সুস্নাত।” এই একটি বাক্যই যথেষ্ট বাচস্পতি মিশ্রের জ্ঞানের ক্ষেত্রটিকে চিনিয়ে দিতে।

মুশকিল শুরু হল ঠিক এইখান থেকেই। আমার মনে হয়, যারা জ্ঞানের পূজারী, তারা চিরকালই জ্ঞানের পূজারীই থেকে যান। জ্ঞানেই জ্ঞানের শেষঅর্থাৎ, জ্ঞানের প্রতি প্রেম তাকে এমন পর্যায়ে উপনীত করে যে, রাজা নত হয়। জ্ঞানের অসারতার দিকে তখনই চোখ পড়ে, যখন জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার প্রতি চোখ পড়ে। বাচস্পতি মিশ্রের পড়েছিল। জ্ঞানজ্যোতি তাকে কখন যে করুণাঘন করে তুলেছিল, তা তিনি নিজেও টের পান নি। সেখান থেকেই এক একাকীত্বতা, এক হাহাকার তার মনকে বিকল করে তুলল। “তিনি অবশ্য এ কথাও জানেন, এই জীবন থেকে রিক্ত হস্তে তাঁকে বিদায় নিতে হবে। আর আর প্রাকৃত জনের মতো জীবনের কোন দায়িত্ব তিনি পালন করেননি।... তাঁর জীবন কৃতকৃতার্থ হয়নি, আনন্দময় পরমপদে অধিষ্ঠিত হয়ে ভূমানন্দ লাভও করেননি। তাঁর নিজ জীবন শূন্য, অকৃতার্থ। তাঁর হৃদয় সংবেদনাহীনআবাল্য তিনি শুধু এইমাত্র করতে সক্ষম ছিলেন --- তিনি গভীর চিন্তা করতে পারতেন, বিপুল পরিশ্রম ক’রে কঠিন তত্ত্বকে বুদ্ধিগম্য করতে পারতেন, নিজভাব প্রাঞ্জল ভাষায় লিপিবদ্ধ করতে পারতেন। এতদ্ব্যাতীত তিনি আর কিছুই করেননি।” পড়তে পড়তে মনে হল, হায় স্কলারেরা... হায় প্রধন্যা... হায় সন্মাত্রানন্দ দাদা...

মজার ব্যপারটা ঠিক এর পরেই ঘটল। বাচস্পতির চোখ পড়ল তার স্ত্রী’র প্রতি। তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কে তুমি, নারী?” তার উত্তরে নারী যা বলল, রাজ চক্রবর্তীর সিনেমাতেও এমন নাটকীয়তা দেখা যায় না। পুরো উপন্যাসটা যে বাস্তবের লয়ে চলছিল, সেখান থেকে এক ধাক্কায় যেন অঞ্জন চৌধুরীর যাত্রাপালায় ঢুকে পড়ল। যেন ভামতী গোটা একটা যুগের অভিমান নিয়ে বসেছিল, যে কবে তাকে তার স্বামী জিজ্ঞাসা করবে, ওগো তুমি ক্যাডা? আর তিনি টিপিকাল বাঙালি পত্নীসুলভ কথাগুলো শুনিয়ে দেবেন, সিরিয়ালের মতো করে। গোটা দুগ্ধসম উপন্যাসে এই একটুই যা চোনা ঠেকল, তা-ও একেবারে শেষে এসে।

অন্যদিকে প্রসন্নশীলা মা। তার জীবনের দুই সময়ে জন্ম দুই পুত্রের – অসঙ্গ, বসুবন্ধু। বৌদ্ধ দার্শনিক। --- “এই দুই দার্শনিক ভ্রাতার জননী প্রসন্নশীলা প্রথমবার পতিবিয়োগের পর জীবনকে অস্বীকার করেছিলেন এবং তার ফলে বঞ্চিত হয়েছিলেন ‘সত্য’ থেকে, ‘আনন্দ’ থেকে। প্রসন্নশীলার প্রথম পুত্র অসঙ্গ প্রবল তপস্যার দ্বারা শরীর ক্ষয় করেছিলেন, কিন্তু তার ফলে বঞ্চিত হয়েছিলেন জীবনের চরম লক্ষ্য থেকে। প্রসন্নশীলার দ্বিতীয় পুত্র বসুবন্ধু হারিয়ে গিয়েছিলেন কূট দার্শনিক সমস্যার আলোচনার ভিতর, হারিয়েছিলেন নিজেকে। এ কাহিনী এঁদের তিনজনের ফিরে আসার কাহিনী। প্রেমের ভিতর দিয়ে প্রসন্নশীলা, করুণার ভিতর দিয়ে অসঙ্গ, একাত্মতার ভিতর দিয়ে বসুবন্ধু মুক্তি পেয়েছিলেন। আমাদের ‘আধুনিক’ জীবনের আত্মবিস্মৃতির বিপরীতে সুপ্রাচীনকালের মানুষের আত্ম-আবিস্কারের এই কাহিনী তাই মুক্তির জানালা খোলার অভিজ্ঞান।” আমি বলি, অসঙ্গ কিম্বা বসবন্ধুও কি সারা জীবন জুড়ে আত্মবিস্মৃতিতেই থেকে গেল না। তারা নিজেকে জানল কখন? শেষ জীবনে। প্রসন্নশীলাও তাই। জীবন তাদেরকে যে অভিজ্ঞতালব্ধজ্ঞান দিল, তা-ই কি আত্মোপলব্ধি নয়? সে জ্ঞান কি আধুনিক জীবনেও বইছে না? শেষ জীবনে কত মানুষ ঘুরছে আত্ম-অভিজ্ঞানে, কজন তার খোঁজ রাখে? সেই সময়ের সাধারণ মানব জীবনেও কি একইরকম প্রভাব ছিল না? সময়ের সাথে সাথে জীবনধারনের মান পরিবর্তন হয়, জীবনের মূল ভিত্তি কি পরিবর্তন হয়?

‘অশ্রুমতী’ নামটাই যেন জোর করে দেওয়া। যে নদীটিকে প্রসন্নশীলা’র প্রতীকী অর্থে ব্যবহার করা হল, সেই নদীটিকে বাদ দিলেও গোটা ঔপন্যাসিকাটির কোন ক্ষতি হত না। নদীর অংশটিকে বাদ দিয়ে দিব্যি পড়া যায়। “প্রেমের ভিতর দিয়ে প্রসন্নশীলা, করুণার ভিতর দিয়ে অসঙ্গ, একাত্মতার ভিতর দিয়ে বসুবন্ধু মুক্তি পেয়েছিল।” এর মধ্যে অশ্রুমতী যেন ভামতী’র ছন্দের খাতিরে এসে পড়ল।

অথচ গোটা ঔপন্যাসিকাটি এক অসাধারণ প্রেক্ষাপটে তৈরী করেছে। অসঙ্গ’র শেষ পর্যায়ে মৈত্রেয় বুদ্ধের সাথে কথোপকথন রীতিমতো মনে দাগ কাটে। আমার অভিজ্ঞতায়, প্রেমিক সন্মাত্রানন্দকে ততটা দড় লাগে না, যতটা পন্ডিত সন্মাত্রানন্দ। মুশকিলের বিষয়, সাধারণ পাঠক ইতিহাস খোঁজে, গল্প খোঁজে। ফলে জীবনের খোঁজে মতপার্থক্য এবং তার সুগভীর এষণা’র ইতিহাস নিয়ে কেউ আলোচনা করতে চায় নাসন্মাত্রানন্দ ঠিক এইখানেই ব্যর্থ, আর আর কুশলী লেখকদের মতোই।

আর আমি, প্রধন্যা, আপনার পরের লেখার অপেক্ষায় থাকি।

======================

ভামতী অশ্রুমতী

সন্মাত্রানন্দ

ধানসিঁড়ি প্রকাশন

মুদ্রিত মূল্যঃ ১৫০/-

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা


Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে