কশেরুকার মালার বাঁধনে এক নাস্তিক পণ্ডিত

 



ইংরাজীতে ‘COMPACT’ বলে একটা শব্দ আছে। ‘নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা’ সেই অর্থেই কমপ্যাক্ট লেখা। ঝরঝরে, নির্মেদ এক উপন্যাস, যার জন্যে পড়াশোনা করতে হয়।

‘নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা’ গত চার বছরের অন্যতম জনপ্রিয় এবং আলোচনাপ্রিয় উপন্যাস। মাথা চটকিয়ে দেওয়া এমন আর কোন উপন্যাস এযাবৎ মনে পড়ে কি? না। অন্তত এতদিন ধরে সাধারণ পাঠকসমাজে এতটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে নি আর কোনও উপন্যাস। বর্তমানে এর ২৩-তম মুদ্রণ প্রকাশিত হয়েছে।

উপন্যাসটির রহস্যময়তা, বিশেষত থ্রিলার উপাদান এবং রোমান্স উপাদান একে এক মহতী জায়গায় নিয়ে গেছে। আমার মতে, মাঝখান থেকে দর্শনের উপাদান মার খেয়ে গেছে। এর কারণ লেখক নন। পাঠক সমাজ। দর্শনের জায়গাগুলি নিয়ে সুগভীর আলোচনা তেমন করে আমার অন্ততঃ চোখে পড়ে নি। অধিকাংশ পাঠক সেই জায়গায় চোখ উলটে দিয়েছেন, অর্থাৎ, “শিশি-বোতলের জায়গাটা শক্ত ঠেকেছে”। পরিবর্তে এর রোম্যান্টিক আখ্যান এবং থ্রিলার উপাদান একে জনপ্রিয় করে তুলেছে। সাথে যুক্ত হয়েছে তিন সময়কালের ওভারল্যাপিং, যা বাংলা সাহিত্যে এযাবৎ কেউ করেন নি। এই ওভারল্যাপিং-এর জায়গাটাকে অনেকে রিলেটিভিটি, বিগ ব্যাং, ফিজিক্স ইত্যাদি শব্দ দিয়ে পুরণ করতে গিয়ে কৌতুহলে উপন্যাস না পড়া পাঠকদেরকে ফাটিয়ে দিয়েছেন। বলা বাহুল্য, এর মধ্যে ফিজিক্সের P-ও নেই। সব মিলিয়ে, উপন্যাসের গল্প নিয়ে যত আলোচনা হয়েছে কিম্বা কবিতাটা, ততটা অতীশের দর্শন নিয়ে নয়। লেখক এই জায়গায় ব্যর্থ হয়েছেন, তবে তার দায় কি লেখকের?

সব মিলিয়ে এই জটিল ও বহুমুখী বইটিকে নিজেরই খেয়ালে ছকবদ্ধ করার ইচ্ছা জাগল। খেলাচ্ছলে কিম্বা নিজের প্রয়োজনে ছকটা তৈরী করলেও মনে হল, পাঠকদের কাছে এটা পেশ করলে তাদের বুঝতে সুবিধা হলেও হতে পারে।

এ বই পরিশ্রমসাধ্য বই। মোদ্দা কথা, পাঠকের একটু আলাদা করে পড়াশোনা করা দরকার বৈ কি। এতএব, এ বই পড়তে গিয়ে আমার, এবারের রিভিউ, একটু অন্যধারার হবে। এমন একটা বহুমাত্রিক উপন্যাসকে যদি লজিক্যালি কাঁটাছেড়া করতে হয়, তাহলে তার প্রেসেন্টেশান তো অন্যরকম হতেই হয় ---

এতএব, শুরু করা যাক ---

১। উপন্যাসটি অতীশের জীবনী নয় – অতীশ দীপংকরের পৃথিবী। তার পৃথিবী আর তিনি কি আলাদা? না। কিন্তু এই উপন্যাসে অতীশ, অন্তত পূর্বপীঠিকা-র পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় চরিত্র নয়পশ্চিমপীঠিকা-তে অবশ্য তিনি স্বমহিমায় বিদ্যামান। তাহলে কেন্দ্রীয় চরিত্র কে? সময়? উঁহু। শাশ্বত নারীত্ব – Universal Womanhood, আমার মনে হয়, যার কাছে অতীশ, চাগ্‌ লোচাবা এমনকি অমিতায়ুধ নিজেকে বিলীন করে দিতে বাধ্য হন। দর্শক রয়ে যান, শাওন বসু --- “এইসব পটপরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে মানুষ তবু নিজেকেই খুঁজছে। তার এই অন্বেষণ ফুরায় না। এই অবিরত অন্বেষাই মানুষের জীবন, মানুষের ইতিহাস। খুঁজতে খুঁজতে সে হয়তো পায় কখনো একটি স্নেহকাতর হৃদয়।”

২। তিনটে সময়ের কাহিনী। দশম-একাদশ শতক, ত্রয়োদশ শতক, একবিংশ শতক। সময়ের সাথে সাথে অতীশের দর্শনের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে, তাই নয়, চলে গেছেন বিস্মৃতির অন্তরালে। ভারতে, নেপালে, তিব্বতেও। তার ব্যক্তিত্ব, তার কাজ, সমস্ত কিছুই আজ সময়ের আড়ালে চলে গেছে। এই কারণেই কি তিন সময়ের সমাবেশ? --- “এখন তুমি ধাতু হয়েছ, আর পৃথিবীতে মাটি হয়ে মাটির সঙ্গে মিশে যেতে পারবে না। এবার তোমার ধাতুর মূর্তি নির্মিত হবে, তুমি পূজা পাবে। ধাতুমুর্তিতে পরিপূর্ণ এ তিব্বতে তুমি হবে আরেকটি ধাতুমুর্তি --- পূজিত, সজ্জিত, ভূষিত কিন্তু অনালোচিত, বিস্মৃত। তুমি মানুষের কোন কাজে লাগবে না, এখন থেকে তুমি শুধু একটি ধূপগন্ধে সুবাসিত পবিত্র দ্রব্য, একটি অবসিত যুগের স্মৃতি --- আর কিছু নয়।”

৩। তিন ধরনের বাংলা ভাষার ব্যবহার। অতীশের সময়ের বাংলা তুলনামূলক সহজ হলেও, চাগ্‌ লোচাবার সময়ের বাংলাটা কিন্তু আমার কঠিন ঠেকেছে। প্রচুর তৎসম শব্দের ব্যবহার। ফলে সরল-কঠিন-অতিসরল --- এইভাবে ভাষার বিস্তার হয়েছে। এটা কি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত? সাধারণত, কঠিন-সরল-অতিসরল পথে এগোয়, এক্ষেত্রে কিন্তু তা হয় নি। হতে পারে, ভাষার কাঠিন্য দিয়ে সমাজে চিন্তাধারার যে জটিলতা ও পরিবর্তন ঘটেছে, সেটাকে দেখাতে চেয়েছিলেন। হাজার হোক, ত্রয়োদশ শতককে একপ্রকার অন্ধকার যুগই বলা চলে। এই সময়েই মুসলিম আক্রমণের ফলে সমস্ত প্রধান প্রধান মহাবিহারগুলো ধ্বংস হয়ে যায়।

৪। অতীশের দর্শন – আমাকে সবচেয়ে বেশি ভাবিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, আমি দুটো জায়গার কথা বলব ---

এক, নাস্তিকের তর্কযুদ্ধ --- অতীশের শূন্যবাদ। অতীশ বলছেন --- “আমি কোন মতবিশেষকেই নিরঙ্কুশ মনে করি না। এই বিশ্বজগতের কোনও বস্তুর স্বতন্ত্র সত্তা নাই। সকলই পরস্পর নির্ভরশীল, সকলই পরতন্ত্র। ... বন্ধন নাই, নির্বাণ নাই। নির্বাণ যদি প্রাপনীয় বস্তু হয়, তবে তার আরম্ভ থাকবে। ... পরমার্থত সংঘ নাই, ধর্ম নাই, বুদ্ধ নাই। এমনকি তথাগতও পরমার্থত সত্য নন। ... এই সমস্ত জগৎ স্বতন্ত্রসত্তারহিত, শূন্য।” আমার প্রশ্ন জাগে, নাগার্জুনের শূন্যবাদ থেকে অতীশের এই শূন্যবাদের কতটা ফারাক? কর্মবাদের শূন্যতা বনাম জ্ঞানবাদের শূন্যতা? না কি নাস্তি-র শূন্যতা থেকে অস্তি-র শূন্যতা? অর্থাৎ, মহাযান মতাবলম্বী শূন্যতাবাদের যে চিন্তনের পরিবর্তন তার খবর এ বইতে নেই।

দুই, ‘বোধিপথপ্রদীপ’ --- যেখানে আছে অতীশ-বিনয়ধর সংবাদ। ‘ত্রিপুরুষ তত্ত্ব’ এবং ‘কর্মফলবাদ’পড়তে পড়তে আমার কোথাও মনে হচ্ছিল, বুদ্ধের ‘মধ্যম পন্থা’র থেকে এর পার্থক্যটা ঠিক কোথায়? তিব্বতের সমাজকে ‘ব্যলান্স’ করার উদ্দেশ্যে অতীশের এই ত্রিপুরুষ তত্ত্বে কিন্তু অনেকটাই গীতার ভাব ঢুকে বসে আছে। বিশেষত, ‘ধ্যানযোগ’-কে যদি যোগী-র জায়গায় সাধারণ মানুষকে ভেবে পড়া যায়, তাহলে মতবাদের মধ্যে পার্থক্য অনেক কমে যায়। তন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে হিন্দুদের দ্বৈত-অদ্বৈতবাদ এবং বুদ্ধের নির্বাণবাদ কোথাও যেন মিলেমিশে যায়।

৫। অতীশের দ্বৈতসত্ত্বা --- পারিবারিক সূত্রে তিনি তন্ত্রমতের পথিক। অথচ জীবন তাকে বানিয়ে তোলে মহাযান মতাবলম্বী ‘জেবোজে’, তন্ত্রমতাবলম্বীদেরকে ধ্বংস করার হাতিয়ার। যে মানুষ অন্তরে তারাদেবীর সাধক, তিনিই বাইরে শূন্যবাদের প্রচারক! পুরো উপন্যাস জুড়েই তাকে এই দুই ভাবের টানাপোড়েনে চুর্ণ-বিচূর্ণ হতে দেখা যায়। এটা কি উপন্যাসের কথক লিখছেন, না কি ইতিহাস সাক্ষী?

৬। শাওন বসু --- প্রস্তাবনা-য় শাওন বসু-র পরিচয় --- “আমি, আপনি কিম্বা একা অন্য কেউ...”। কিন্তু আদৌ উপন্যাসে সেই সাধারণ phenomenon না হয়ে শাওন বসু ‘সন্মাত্রানন্দ’ হয়ে গেছেন। যার কোন প্রয়োজন ছিল না। শাওনের নিজের কথাপ্রসঙ্গে, কোথাও যেন মনে হয়, শোভন, জোর করে ঢুকে গেছেন। শোভনেরও কি তবে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করার তাগিদ ছিল, কিম্বা কৈফিয়ৎ দেওয়ার দায়? কিম্বা দেড় বছর ধরে উপন্যাস সৃষ্টির পেছনের পরিশ্রম ও সামাজিক যন্ত্রণাকে বলতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা? ‘শাওন শুভব্রত’ কিম্বা ‘শাওনের উপন্যাস’ অধ্যায়গুলি কতটা মূল উপন্যাসের সাথে প্রাসঙ্গিক? তেমনই হয়তো প্রয়োজন ছিল না ‘উইলিয়াম জোনস্‌ - ডিরোজিও সংবাদ’ কিম্বা ‘চাগ্‌ লোচাবা – আল্‌ মোয়াজ্জিম সংবাদ’। এ যেন প্রক্ষিপ্তর দোষে খানিকটা দুষ্ট হয়ে গেল।

তেমনই প্রয়োজন ছিল না, একই ঘটনাকে পুণরাবৃত্তি করা, তা সংক্ষেপে হলেও। যেন মনে হচ্ছিল, তিনি পাঠকের স্মৃতিশক্তির ওপর ঠিক ভরসা রাখতে পারছেন না।

জানি না, এ লেখা লেখকের চোখে পড়বে কি না। অনেক প্রশ্ন এ উপন্যাস পাঠের সময় জন্ম নিয়েছে আমার মনে। বিশেষত অতীশের দর্শন পর্যায়ে। আমি স্কলার নই। অতীশকে নিয়ে কোনদিন সেই গভীরে পড়াশোনা করব কি না জানি না। কিন্তু পাঠকের মনে কৌতুহল এবং সেখান থেকে জীবনের অজ্ঞাত সব অনুভূতির সামনে অসহায়ভাবে দাড় করিয়ে দেওয়ার নাম যদি ‘নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা’ হয়, তাহলে তিনি, অন্তত আমার ক্ষেত্রে, সক্ষম। তিনি স্বয়ং যদি উত্তর দেন তো ভাল। নচেৎ, গতে, গতে, পারগতে, পারসংগতে বোধি স্বাহা! --- এই আপ্তমন্ত্র হৃদয়ে ধারণ করেই আমাকে এগোতে হবে।




=========================

নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা

সন্মাত্রানন্দ

ধানসিঁড়ি

মুদ্রিত মূল্যঃ ৫৫০/-

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ ধানসিঁড়ি এবং সমর্পিতা

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে