সময়কালের উজানে কতকগুলি ঢেউয়ের জল

 



একটি গাছ, একটি পাখি, একটি যন্ত্রণা, একটি রুমাল, একটি ছবি, একটি ঘড়ি, একটি চিঠি, একটি চিত্রলিপি, একটি সম্পর্ক এবং একটি ঘুমপুতুল।

এই হল সাদিয়া সুলতানার কতকগুলি জিয়নকাঠি। দেশভাগ, দাঙ্গা, মুক্তিযুদ্ধের যন্ত্রনাকাতর ক্যালাইডোস্কোপ। এই দিয়েই হয়েছে ‘উজানজল’-এর নির্মাণ।

সাদিয়া সুলতানার মুন্সিয়ানা ঠিক কোথায়? কতকগুলি চিহ্ন, কতকগুলি আখর, কতকগুলি ইঙ্গিতের মধ্যে দিয়ে গল্পের ঠাস বুনোট। মেদবর্জিত গল্পগুলি তোমার, আমার এবং তাদের পুর্বপুরুষের, এসে পৌছচ্ছে আমাদের কাছে, আখরকথায়, উত্তরপুরুষের কাছে।

আমাদেরকে, এখনও, চিহ্নিত করা হয় ‘ওপার বাংলার’ বলে, বাঙাল বলে, রিফিউজি’র জেনারেশান বলে। আমরা কি সম্পূর্ণ ভুলতে পেরেছি ওপার বাংলাকে? আমাদের বাবা কিম্বা ঠাকুর্দা-ঠাকুমার রক্তের মধ্যে থাকা ঘাসফুল-হিজলের গন্ধের ঢেউ কি আমার রক্তের মধ্যেও নেই? --- “নিজের দেশ ছেড়ে অন্যের দেশে রিফিউজি পরিচয়ে নতুন করে জীবন-জীবিকা শুরু করার দিনগুলোর স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে ভুবন মিত্র শাফায়েতকে মিহি গলায় কত কী বলছেন, মানুষটার অস্ফুট কণ্ঠস্বর ভেদ করে শাফায়েত সব শব্দ বুঝতে না পারলেও তার কন্ঠের অকৃত্রিম আবেগ ধরতে পারে।” আর শুধু কি আমরা। ওই ‘ওরা’? ওদেরকেও তো চলে যেতে হয়েছিল একদিন, আমাদের মতো। ওদেরকেও কি হাতছানি দিয়ে ডাকে না নাখোদা মসজিদের উড়ন্ত পায়রার ঝাঁক? --- “মোতি নম্রপায়ে খাঁচার সামনে এসে দাঁড়ায়। পবন তার প্রিয় দাদাভাইকে দেখে ছটফট করতে করতে বলতে থাকে, ‘বাপের ভিটে... বাপের ভিটে’।” ‘আমরা’ আর ‘ওরা’ কোথাও যেন এক হয়ে যায় ইছামতীর তীরে। --- “বাবা মারা যাওয়ার পর প্রতিদিনই যাদব কুশিয়ারার কাছে আসে। স্বচ্ছ জলে পা ডুবিয়ে দুই দেশের মধ্যকার বিয়োগরেখা দ্যাখে। কুশিয়ারা নদী চঞ্চল, রহস্যের আধার।”

সাতচল্লিশ এসে থামে একাত্তরে। এখন আর ওরা দাঙ্গাবিধ্বস্ত অঞ্চলের অধিবাসী নয়। ওরা মুক্তিযুদ্ধকামী। --- “যুদ্ধে যাবে বলে দুই বাক্যের একটা চিঠি লিখে চুপিসারে ঘর ছেড়েছিল তারা।” তারা যায়, অনেক ফিরে আসে, অনেকে ফিরে আসে না। --- “যুদ্ধের কালে ঐখানে চোখ বেঁধে দাঁড় করিয়ে মানুষ মেরেছে পাকিস্তানি মিলিটারিরা। রাতের আঁধারে মানুষের লাশ কবরে নামিয়ে মাটিতে চারা বুনেছে আহসনুল্লাহর নানা মোকাররম।” কিম্বা “এই কুয়ো এমনি এমনি বন্ধ হয় নি। হাত-পা বাঁধা অর্ধগলিত লাশে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কুয়োর মুখ। তিন-চার হাত নীচ থেকে পানির বদলে লাশে ভরেছিল। কোনটার মাথা ছিল। কোনটার মাথা ছিল না। নাক-মুখ কাপড়ে জড়ানো ছিল। নিচের দিকে ছিল হাড়গোড় আর মাথার খুলি।” যারা আসে না, তাদের অনেকের কোন কবরচিহ্ন থাকে না, থাকে স্মৃতিচিহ্ন। --- “একাত্তর সালের তেরো ডিসেম্বর রাত নটা বেজে পনেরো মিনিটে বাবাকে যখন ওরা ধরে নিয়ে যায় তখন বাবার হাতে এই ঘড়িটা ছিল। পরের দিন শান্তি কমিটির সদস্য বাবার ছাত্র কচি ঘড়িটা মায়ের হাতে দিয়ে গিয়েছিল। বাবার ঘড়িটা সেদিন ফিরে পাওয়া গেলেও লাশটা খুঁজে পাওয়া যায় নি।”

কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ কি শুধুই আবেগের? হতাশারও তো বটে! কত মানুষের ঘর প্রমানের অভাবে বাজেয়াপ্ত হয়ে গেছে। কত মানুষ সাক্ষীর অভাবে এক ঝটকায় হয়ে গেছে শহীদ থেকে রাজাকার। আবার কত তৎকালীন রাজার পেয়াদারা আজ বর্তমান রাজার বিদূষক হয়ে মাথা উঁচু করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। --- “দেশের চিহ্নিত একজন যুদ্ধাপরাধীর সঙ্গে আজ আপনার হাসি হাসি মুখের ছবিটি যখন দেখেছি তখন থেকেই যেন স্মৃতিরা সজোরে পেছনে টানছে।” সাদিয়া সুলতানার চোখ এ-ও এড়ায়নি।

এই সমস্ত ঘটনার মধ্যে মধ্যে মনুষ্যত্বের ফল্গুধারা। মানুষ বাঁচে, মানুষই তাকে মারে, আবার মানুষই তাকে বাঁচায়। সেই সময়ে কত মানুষের অকৃপণ উদারতায় কত পরিবার রক্ষা পেয়েছে, তার খবর রাখে কয়জন? তারা নিজেরাও কি কখনও বুক ফুলিয়ে এই কথা বলে বেড়ায়? মনুষ্যত্বই যেখানে স্বাভাবিক সোপান, তাকে অযথা সোনা দিয়ে বাঁধানোর প্রয়োজন মনে করেন নি বহু মানুষ --- ওপারেও, এপারেও। বনান্তরালে আত্মগোপন করা হিন্দু সন্তান আব্বার কোলে মানুষ হয়, কিম্বা একটা রুমাল রয়ে যায় আদি অকৃত্রিম ভালোবাসার চিহ্নরূপে।

সাদিয়া সুলতানার ছোটগল্প আমাকে স্তব্ধ করে দিল। একই উজানজলের এতরকম ঢেউ! ঢেউয়ের মধ্যে মধ্যে কতরকম কলতান। কতরকম বিয়োগব্যাথার চোরাঘুর্ণি। কতরকম আনন্দের উত্থান পতন। কিন্তু এর সাথে সাথে গল্প হঠাৎ হঠাৎ করে অদ্ভুত পথে বাঁক নেয়, এবং শেষ হয়। আমাকে চমকে দেয়। যেমন ‘বিরিক্ষ’, যেমন ‘দাগমোচন’। যেমন ‘জলের বিপরীতে’। যেমন ‘যার নাম রেনুবালা’।

আবার ফ্ল্যাট, ম্যাড়ম্যাড়ে লেখা কি নেই? আছে। যেমন ‘ভিটে’। যেমন ‘রূপসার জল’। যেমন ‘স্মৃতিলেখা’। যেমন ‘চৌহদ্দি’।

তবে, আমার মতে ওনার সুন্দরতম গল্পগুলো অ্যাবস্ট্রাক্ট ফর্মের হাত ধরেই এসেছে। কিছুটা সুররিয়েল, কিছুটা ম্যাজিক রিয়েলিজম। সেগুলো আমাকে ভাবিয়েছে বেশি। আমাকে চমকে দিয়েছে। আমাকে কিছুক্ষণ বই বন্ধ করে চুপ করে বসে থাকতে বাধ্য করেছে। প্রত্যেকটা বাক্যের চয়নে অসম্ভব গভীরতা এবং মুন্সীয়ানা। যেমন ‘বিরিক্ষ’। যেমন ‘লাশটা খুঁজে পাওয়া যায়নি’। যেমন ‘ঘুমপুতুলের মৃত্যু’।

সাদিয়া সুলতানা। আপনার আরও লেখা পড়ার ইচ্ছা রইল। আপনি আরও লিখুন। আমাদের দুর্ভাগ্য, আপনার বই এপার বাংলায় সুলভ নয়।

==================================

উজানজল

সাদিয়া সুলতানা

ঐতিহ্য প্রকাশনী

মূল্যঃ ২০০ টাকা

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা

==================================



Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে