'আমাকে দেখুন' কিম্বা 'আমরা দেখি'
সম্প্রতি, একটি জনপ্রিয় দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি কলাম নিয়ে হুলুস্থুল বেঁধে গেছে। সঙ্গে এই কলামের স্বপক্ষে এবং বিপক্ষে বহু মানুষ কথা লিখে চলেছেন। ততোধিক মানুষ সেই লেখা কথাগুলোকে নিয়ে বাকবিতণ্ডা চালিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যে লেখক, প্রকাশক এবং পাঠক --- তিনপক্ষই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জুড়ে গেছেন। আমি লেখিকা নই, পাঠিকা। সাহিত্যের আঙ্গিনায় দর্শক হলেও কিছু কথা বলার প্রয়োজন বোধ করছি এ প্রসঙ্গে, সাহিত্যেরই খাতিরে।
বইমেলার কয়েকদিন আগে থেকেই, নব্যলেখকদেরকে নিয়ে, বিশেষত, যাদের একটা অংশ ফেসবুক প্ল্যাটফর্ম থেকে উঠে এসেছেন, রীতিমতো ব্যঙ্গ চলছে, মিম চলছে। এই নব্য লেখকেরা তাদের যাবতীয় সৃষ্টির বিজ্ঞাপন ফেসবুকেই করছেন। কিম্বা, অনেক ক্ষেত্রে, ব্যক্তিগত মেসেজ কিম্বা পোস্টের কমেন্টসে গিয়ে তাদের বইয়ের কথা জানাচ্ছেন। এদের অধিকাংশই তাদের বইয়ের বিজ্ঞাপন করার জন্য বছরের পর বছর ধরে ফেসবুককেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। এইভাবে আস্তে আস্তে তাদের পরিচিতমন্ডলী তৈরী হচ্ছে, ফ্যানবেস তৈরী হচ্ছে। তারা বইমেলাতে নির্দিষ্ট স্টলের সামনে (কেউ কেউ) তাদের বইপ্রকাশ উদযাপন করছেন। আর যারা এলিট এবং অভিজ্ঞ লেখক / লেখিকা, তাদের জন্য অডিটোরিয়াম আছে, বিভিন্ন জনবহুল মঞ্চ আছে, বিজ্ঞাপনের মাধ্যম হিসাবে জনপ্রিয় ম্যাগাজিন কিম্বা বৈদ্যুতিন মিডিয়া আছে, আর আছে বিপুল সংখ্যক ভক্তকূল, নিজেদের সৃষ্টি সকলের সামনে আনছেন।
কিন্তু দুই ধরণের লেখকদেরই লক্ষ্য পাঠককূল, যাদের কারণে এই বছর ২৯ কোটি টাকার বই বিক্রী হয়েছে। যদিও, নিন্দুকেরা বলছেন, সে হিসাবে, জনপ্রতি ১০০ টাকার বই কেনা হয়েছে। মজার ব্যাপার, বইমেলাতে লিটল ম্যাগাজিন কিম্বা কতিপয় বই বাদে ১০০ টাকার বই দুর্লভ। ফলে কারা কিনছে এবং কটা বই কেনা হচ্ছে, সেটাও বিতর্কের বিষয়।
আমার চোখে যেটা পীড়া দিচ্ছে, তা হল, এই দুই লেখক সম্প্রদায় ও তাদের পেছনের প্রকাশক ও পাঠক ভক্তসম্প্রদায়ের কোন্দল। বস্তুত, এটা পরিষ্কার, লেখকদের মধ্যেও এখন জাতিভেদপ্রথা তৈরী হয়েছে। 'উচ্চ সম্প্রদায়', অভিজ্ঞও বটে, 'নব্য সম্প্রদায়ের' লেখা নিয়ে নাক সিঁটকাচ্ছেন, এবং নব্য সম্প্রদায়ের লক্ষ্য উচ্চ সম্প্রদায়ের মতো সেলেব্রিটি হওয়া, নিদেনপক্ষে, তাদের পর্যায়ে পৌছানো। কিন্তু, দুটো সম্প্রদায়ই ভুলে যাচ্ছেন, তাদের মূল লক্ষ্য সৎ সাহিত্য সৃষ্টি করা, বাংলা সাহিত্যকে নতুন দিশা দেখানো, এবং নব্য পাঠককূলের নব্য চাহিদা পূরণ করা।
এই জাতিভেদ প্রথা'র সঙ্গে তবে কি এবার আমাদের লড়তে হবে? খোদায় মালুম। মনে তো হচ্ছে আমরা সেইদিকেই আস্তে আস্তে এগোচ্ছি।
মজার ব্যাপার, উচ্চ সম্প্রদায় এই নব্য সম্প্রদায়ের ফেসবুকীয় 'অসার' লেখা নিয়ে রীতিমতো নাক সিঁটকাচ্ছেন। প্রশ্ন হল, তারা কি এদের লেখা মন দিয়ে পড়ছেন? যদি পড়েন, তাহলে সুনীলের মতো, প্রকৃত অভিভাবক হিসাবে সৎ আলোচনা তাদের কাছ থেকে আমরা পাচ্ছি না কেন? শুধুমাত্রই এত এত বস্তাপচা লেখা হচ্ছে, এ পাগলেও মানবে না। আর ভালো লেখাকে সকলের সামনে তুলে ধরার, নিজে থেকে খুঁজে বের
করে নিয়ে তুলে ধরার (বন্ধু কিম্বা স্তোকবাক্যের লেখক ভক্তদের কথা বাদ দিচ্ছি) পরিশ্রম থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে আখেরে বাংলা সাহিত্যের কি লাভ হচ্ছে, বোঝা যাচ্ছে না।
মাঝখান থেকে
গালমন্দটা
আস্তে আস্তে কলতলার ঝগড়ার রূপ নিয়ে ফেলছে।
মজার ব্যাপার, আমরা, পাঠকেরা কিন্তু, দেখতে গেলে, একটা বড়ো কারণ। অনেক পাঠক বছরের শেষে দেড়শো-দুশো বই পড়ার লিস্ট দেন, কিন্তু তাদেরকে কোনরকম রিভিউ দিতে প্রায় দেখাই যায় না; 'নিরাপদ' পাঠকেরা সব বই 'ভাল' এবং মতামত ব্যক্তিগত বলে দায় সারেন; আর 'আপদ' পাঠকেরা বিশেষ লেখক / লেখিকার ভক্তকূল হয়ে যান এবং তাদের কোন কোন লেখা ভালো না লাগলেও চোখ বন্ধ করে থাকেন, ও অভক্তকূলের ওপর ঝাপিয়ে পড়েন। অবশ্য, অনেক পাঠকের বক্তব্য থাকে, তারা লিখতে পারেন না। তাদেরকে আমার সবচেয়ে বেশি হাস্যকর লাগে। চন্দন ঘষলে হাতে চন্দনের গন্ধ থাকে, শিশু আধো আধো কথাতেও নিজের ভাব স্পষ্ট প্রকাশ করতে পারে, আর এনারা এত এত সাহিত্য পড়েও সাহিত্যের ভালো-মন্দ লিখতে পারেন না! তাহলে এরা কি আদৌ মন দিয়ে পড়েন? না কি জাস্ট রিডিং দেন, এবং পরের বইটা রিডিং দেওয়ার জন্য আকুপাকু করেন। এনারাই কি তাহলে ‘হুজুগে পাঠক’? এই কারণেই
কি ‘এক্সপার্ট রিভিউ’কারের জায়গায় ‘সাধারণ’ পাঠকেরা আসতেই পারছে না?
পাঠকের 'কমফোর্ট জোন' লেখকের অতি-সাধারণ লেখার ব্রহ্মাস্ত্র। আর লেখকের ভক্তকূল অন্য লেখক ও
পাঠকদের সমালোচনা
ও আক্রমণ করার শক্তিশেল। বিশ্বের দরবারে বাঙালী পাঠক আতশ কাঁচ দিয়ে খুঁজলেও পাওয়া যাবে না। ফলে তারা কোনোভাবেই নিজেদের 'আপডেট' করতে সক্ষম নন। বর্তমান জেনারেশান ইংরাজী সাহিত্যের দিকে ঝুঁকে যাওয়াতে অবস্থা আরও করুণ হয়েছে। সার্থক অনুবাদ সাহিত্যের পর্যাপ্ত অ-পৃষ্ঠপোষকতায়
অবস্থা অতিকরুণ। আর, সবশেষে, কিছু নির্দিষ্ট জঁরের বইকে পাঠ্য করার দরুন, আমরা কূপমন্ডুকে পরিণত হচ্ছি। যার এক সার্থক পরিণতি আজকের এই তরজা।
পাঠকেরা সততার সঙ্গে, যথার্থ যুক্তিবুদ্ধি সহযোগে বইয়ের সমালোচনা করলে, লেখককেও যথাযথ গভীরে গিয়ে তার পরবর্তী লেখার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে বাধ্য হতে হয়। লজ্জা অতি বিষম বস্তু। লেখকেরা আজকাল লজ্জা পেতে ভুলে যাচ্ছেন। পাঠকেরাও লজ্জা দিতে ভুলে যাচ্ছেন। পাঠক কোন বই পড়ার সময় যদি লেখকের নাম ভুলে গিয়ে পড়েন এবং আবেগপ্রতুল হয়ে না পড়েন, তাহলে, আজ, হয়তো, এই তরজা লড়াই সম্ভবই হত না। আর বাংলা সাহিত্য আস্তে আস্তে ইংরাজী সাহিত্যের গ্রাসে কবলিত হত না।
হাজার হোক, দিনের শেষে পাঠকই যদি ভগবান হন, তাহলে পাঠকদেরই কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে বৈ কি।
========================
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ
ইন্টারনেট কিম্বা/এবং সমর্পিতা
Ratatouille সিনেমার এক বিশ্ববিখ্যাত রাঁধুনীর বক্তব্য ছিল "anybody can cook";যে কথাটার আসল মানে বুঝতে গিয়ে সেখানকার শ্রেষ্ঠ ক্রিটিককে শেষপর্যন্ত ইঁদুরদর্শন করতে হয়েছিল!
ReplyDeleteএই দুই শ্রেণীর ভক্তদের কোঁদল দেখে সেই থিমটা খুব মনে পড়ছে।