সময়রেখার পথ ধরে ছায়ামানবেরা



সাহিত্য অকাদেমী পুরস্কারপ্রাপ্ত ইংরাজী উপন্যাস ‘The Shadow Lines’ ওরফে ‘ছায়ারেখা’ অমিতাভ ঘোষের দ্বিতীয় উপন্যাসও বটে। এটি আনন্দ পুরস্কারও পেয়েছিল। বোদ্ধাজনেরা আমায় মাফ করবেন, আমি যখন উপন্যাসটির পঁচিশ শতাংশ পড়ে ফেলেছি, তখন মনে হচ্ছিল, উপন্যাসটা লেখার উদ্দেশ্য কি, আর আমি কেনই বা পড়ছি! পঞ্চাশ শতাংশ পড়ার পর, আমার মনে হল, গল্পের প্লটটা তো পরিস্কার হয়েছে বটে, কিন্তু এই ড্রয়িং ড্রামা’র জন্যে সাহিত্য অকাদেমী পাওয়ার কারণ কি? তৃতীয় পর্যায়ে এসে মনে হল, এ বই এই পর্যায়ে ছেড়ে দেওয়াটা অনুচিৎ, এবং, শেষ পর্যায়ে এসে যখন পৌছেছি, তখন, এক সময়ে আমার দম আটকে আসছিল ঘটনা পরম্পরায়। শেষ পর্যায়ে এসে, যে বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে উপন্যাসের জালটির শেষ বুনোট দিলেন, সেই বিষয়বস্তুটি ঝটকা দেওয়ার মতো, কারণ, ওই সময়টাকে নিয়ে, আমার, এযাবৎ কোন প্রবন্ধ, কবিতা বা উপন্যাস বা গল্প চোখে পড়ে নি।

শেষে আসার আগে আগের কথা বলে নিই।

উপন্যাসটি তিন প্রজন্মের। ঠাকুমা-কাকা-নাতি, ঠাম্মা-ত্রিদিব-বক্তা। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ঠাম্মার বোন মায়াদেবীর পরিবার, যিনি প্রবাসী, এবং যখন তারা ইংলন্ডে থাকতেন, সেই সময়ে যে বাড়ীতে থাকতেন সেই প্রাইস ফ্যামিলির সন্তানেরা – মে এবং নিক। মায়াদেবীর আরেক সন্তান ইলার সাথে নিকের বিয়ে হয়। মে-র পছন্দ ছিল ত্রিদিব, যে ছোটবেলাতেই চলে আসে কলকাতায়। ফলে উপন্যাসের প্রথমার্ধের একটা বড়ো অংশ প্রবাসী এবং কলকাত্তাই বাঙাল পরিবারের একটা মানসিক টানাপোড়েনের পাশাপাশি প্রবাসী ভারতীয় এবং সেখানকার অধিবাসীদের সাথেও যে একটা মানসিক চাপান উতোর ছিল, তার খানিকটাও মূল বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

এবং ঘটনা শুরু হয়েছে ১৯৪০-এর পর থেকে।

আজও কি আমরা, বিদেশে যাওয়াকে ‘এচিভমেন্ট’ বলে মনে করি না? সে যেমন চাকরীই হোক না কেন, একটা গ্রীণ কার্ড যে আমাদের স্ট্যাটাস কতটা উঁচুতে নিয়ে যেতে পারে, তা আজকের যুগের আইটি-র ছেলেমেয়েদের দেখলে অনেকটাই মালুম পাওয়া যায়। বাংলা থেকে ব্যাঙ্গালোর একটা বড়ো এচিভমেন্ট। আর তার কিছুদিন পরে যদি আমেরিকা পাড়ি দেওয়া যায়, তাহলে আমরা মনে করি ডলারের পাহাড়ে থাকা এই মানুষটি আমাদের রূপকথার কল্পলোকে থাকা মানুষ। প্রতি দু-তিন বছর অন্তর বেশ কিছু সস্তার উপহার দেখে আমাদের মন যেমন ভরে যায়, তেমনি তাদের ক্ষেত্রে সম্ভ্রমও আদায় করা যায়। বিদেশের প্রতি আমাদের মোহ তখনও যায় নি, আজও যাচ্ছে না।

আর আমরা সম্ভ্রম করলেও, কিন্তু, মনে মনে কিছুটা হলেও, বিদ্বেষ পোষণ করি। “সব যায় দাদা তোমাদের পোড়া হিংসেটা যায় না” লিখেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ একটা চিঠিতে। সেই পোড়া হিংসে নিয়েই আমরা দেঁতো হাসি হেসে ওয়েলকাম জানাই, আর পেছনে চলে নানা ধরনের কল্পচর্চা, যাকে বলা হয় পরনিন্দা পরচর্চা। অদ্ভুত এই মানসিক বৈপরিত্যের ফলে আমরাও কিন্তু খুব একটা আপন করে নিতে পারি না এই প্রবাসীদের। একবার দেশছাড়া হলে সে কি আর এদেশের থাকে? না মনে হয়। বহু বছর পর ফিরে এলেও নয়।

তারা না তো এদেশের হয়, না ওদেশের। তারা ত্রিশঙ্কুর মতো একধরনের এলিয়েন হয়ে থেকে যায়, যেখানেই থাকুক না কেন।

অমিতাভ ঘোষের লেখায় এই টানাপোড়েনের আভাস খানিকটা অনুভব করতে পারি। আস্তে আস্তে সময় চলে আসে ১৯৬৪-তে। এবং উপন্যাস শেষের দিকে এগোতে থাকে।

হজরত মহম্মদের ‘চুল’ এই সময়েই চুরি যায় জম্মু-কাশ্মীরের হজরতবাল মসজিদ থেকে। ১৯৬৩ সালের ২৭শে ডিসেম্বর। ১৯৬৪ সালের ৪ঠা জানুয়ারী তা পুণরুদ্ধার হয়। কিন্তু এই কয়েকদিনের মধ্যে ছোটখাটো দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্থ হয় দুই বাংলার মানুষ। ধর্মের উচ্ছ্বাস, শোক এবং উষ্মা বেশ কিছু প্রাণের বলি নেয়। এই সময় দুই তরফেই কার্ফু ইত্যাদির মাধ্যমে চটপট পরিস্থিতি শান্ত হয় বটে, কিন্তু এই ‘চটপট’-এর মধ্যেও যে ক্ষণটুকু থাকে, সেই ক্ষণটুকুতেই প্রাণ যায়, উচ্ছেদ হয় অনেক মানুষ।

দাঙ্গা আজও চলে। দুই ধর্মের মধ্যেকার পরিস্থিতি এখনও ব্যালান্সড নয়। হবে কবে? জানি না। কিন্তু আমি দেখেছি, স্থানীয় মানুষদের মধ্যে, সাধারণ কিম্বা অতি সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্মের আঁচ তাদের দৈনন্দিন জীবনের মধ্যে পড়ে না। পেটের দায় বড়ো দায়। সে জাতি-কূল মানে না। সে চায় তাদের ‘সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’। আর তাই ‘উদ্দেশ্য’ শব্দটার সাথে দাঙ্গা একটা বড়ো বিষয় হয়ে পড়ে। ধর্মের সাথে নয়। ধর্ম একটা মাধ্যম হয় মাত্র।

অমিতাভ ঘোষ একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে তার লেখনির টানে যে মর্মস্পর্শী পরিসমাপ্তি ঘটালেন, তা মনে দাগ কেটে যায় যথেষ্ট। এইখানেই তার লেখনীর মুন্সীয়ানা। যে প্রশ্ন একটা সমাজকে, দুটো দেশকে, এবং তার থেকেও বড়ো, কয়েকটা সম্পর্ককে চিরদিনের জন্য অন্য খাতে বইয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, ‘দাঙ্গা’ সংক্রান্ত সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা বড্ড জরুরী হয়ে দাড়াচ্ছে দিনের পর দিন। নয়তো, ইজরায়েল-প্যালেস্তাইনেও, আমরা দেখছি একই বিষয়ের টানাপোড়েন।

মৌসুমী বসু-র অনুবাদ যথাযথ। পড়তে কোথাও সমস্যা হয় না।

=========================

ছায়ারেখা

অমিতাভ ঘোষ

অনুবাদিকাঃ মৌসুমী বসু

সাহিত্য অকাদেমী

মুদ্রিত মুল্যঃ ১৪০ টাকা

 

 

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে