রবীন্দ্রনাথঃ এক আদালতীয় টানাপোড়েনের সিদ্ধান্ত

 


যা কিছু অসাধারণ, তাকে ঘিরেই কিংবদন্তী গড়ে তোলার স্বভাব আমাদের। তা সে ঘটনাই হোক, কি কীর্তি। কখনও সেই কিংবদন্তী এমনই উচ্ছ্বসিত, যার প্রতাপে অসাধারণ হয়ে ওঠে অলৌকিক; কখনও আবার তা উৎসারিত এমনই ঈর্ষা-কুৎসা থেকে, যার প্রকোপে অসাধারণের প্রকৃত মহিমারও ঘটে যায় খর্বতা। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও বারবার এমন ঘটনা ঘটেছে।

সৌরীন্দ্র মিত্রের লেখা ‘খ্যাতি অখ্যাতির নেপথ্যে’-র ব্লার্বের শুরুই হচ্ছে এই কথাকটা দিয়ে। তার এই বইয়ের মূল বিষয়বস্তু একজনই --- রবীন্দ্রনাথ। তিনি রবীন্দ্রনাথের অখ্যাতির পেছনে যে সত্য তা উদ্‌ঘাটন করতে অনলস পরিশ্রম করেছেন, যার ফসলই হল এই বইটি। এই বইয়ের গরিষ্ঠ অংশই রয়েছে রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তি এবং তৎপরবর্তী ইউরোপ জনমানসে প্রতিক্রিয়া বিষয়ে। বিশেষত, যেখানে তাকে কালিমালিপ্ত করার প্রচেষ্টা হয়েছে বারংবার --- “দীর্ঘদিনের নিরলস প্রচেষ্টায় রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পুরো প্রেক্ষিতটিকেই নতুনভাবে আবিষ্কার করে এ-গ্রন্থে তুলে ধরেছেন।” এর সাথে রয়েছে রোম্যাঁ রোলাঁ ও পশ্চিমের চোখে রবীন্দ্রনাথ।

পড়তে গেলেই বোঝা যায় কি পরিমাণ খুঁটিয়ে রিসার্চটি উনি করেছেন, এবং তার ফলস্বরূপ এই বইটা স্বয়ং একটা গবেষণাপত্র হয়ে উঠেছে। এত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নোবেল পুরস্কারের আগে এবং পরে তিনি রবীন্দ্রনাথের সাথে পাশ্চাত্যের সংঘর্ষকে তুলে ধরেছেন যে, পড়তে পড়তে বিস্মিত হতে হয়, এমন লেখা আমি আর কোথাও পড়েছি কি? এমন খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ সহযোগে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর নিবন্ধ বাংলা ভাষায় অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য এবং দুষ্পাচ্য। পড়তে পড়তে আমার মনে হচ্ছিল, আমি পাঠিকা নই, আমি যেন আদালতে বসে বসে এক উকিলের কাউন্টার লজিক শুনছি, যার উদ্দেশ্য রবীন্দ্রনাথকে নির্দোষ প্রমাণিত করা।

 নোবেল প্রাপ্তির অব্যবহিত পরেই ভারতে (বিশেষত বঙ্গদেশে) শোনা যেতে লাগল, রবীন্দ্রনাথ ইংরেজ তোষণ করে নোবেল পুরস্কারটি হস্তগত করেছেন। ঠিক এইখান থেকেই শুরু হল রবীন্দ্রনিন্দা। আর এইখান থেকেই শুরু হল সৌরীন্দ্র মিত্রের গবেষণা। যে ‘গীতাঞ্জলী’ বইটিকে নিয়ে এত শোরগোল তার ইংরাজি তর্জমা থেকে শুরু করে অবশেষে নোবেল এবং তৎপরবর্তী কেচ্ছা-কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়লেন একে একে ডব্লু বি য়েট্‌স, এজরা পাউন্ড, রোটেন্‌স্টইন, রবার্ট ব্রিজেস সমেত একগুচ্ছ ইউরোপ মনীষী ও প্রধান সারির ব্যক্তিত্বরা। এই বইয়ের প্রথম দুটি খন্ড সেই সমস্ত কেচ্ছা কেলেঙ্কারি থেকে রবীন্দ্রনাথকে আতস কাঁচে দেখতে চাওয়ার প্রয়াস।

বইয়ের তৃতীয় খন্ড রোমাঁ রোল্যাঁ-কে নিয়ে। রবীন্দ্রনাথ এবং রোম্যাঁ রোলাঁ দুজনেই মনে করতেন, সমগ্র বিশ্বে যতজন মানুষ আছে চিন্তাস্তরের মধ্যে সবচেয়ে কাছাকাছি (রবীন্দ্রনাথের সাথে) এরা দুজন। দুজনেই দুজনকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত। রোমাঁ রোল্যাঁর ভারতপ্রীতি সর্বজনবিদিত। এই রোমাঁ রোল্যাঁর সাথে পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের মতান্তর এবং মনান্তর হয়। সে দূরত্ব সম্ভবত জোড়া লেগেও লাগে নি। সৌরীন্দ্র মিত্র সেই মতান্তরের কারণকেও খুঁড়ে বের করেছেন তার চিন্তনের আতশ কাচের মধ্যে দিয়ে এবং রবীন্দ্রনাথকে যেন জনতার আদালতে ক্লীনচিট দিয়ে কলঙ্কমুক্ত করেছেন। নির্দোষ প্রমাণ করছেন।

কিন্তু আদালতে নির্দোষ প্রমাণ হলেই কি আসলেই সে নির্দোষ হয়?

পাঠকদের মুশকিল হল, যেভাবে, এবং যে দীর্ঘপরিকরে সৌরীন্দ্র মিত্র ব্যবচ্ছেদ করেছেন ঘটনাগুলোকে, তা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পাঠ করে আপন বুদ্ধি-বিচারে সম্যক অধিগত হওয়া, বড়োই কঠিনসৌরীন্দ্র মিত্র আমাদেরকে আদালতেই টেনে আনছেন না, একই বিষয়, বলা যায়, কোন একটা চিঠি, কিম্বা লাইন, কিম্বা ঘটনার একটা ছোট্ট সূত্র ধরে এগিয়েছেন পাতার পর পাতা। এই নিখুঁত হতে চাওয়ার মধ্যে তার উদ্দেশ্য ছিল একটাই --- রবীন্দ্রনাথকে নিষ্কলঙ্ক প্রমাণ করা। কিন্তু সমস্যা এই, এক্ষেত্রে, যে পরিমাণ ধৈর্য পাঠকবর্গকে নিতে হবে, পাঠকবর্গ যদি সেই পরিমাণ ধৈর্য অবলম্বন না করেন, অধৈর্যের কারণে সিদ্ধান্তের দিকে তাড়াতাড়ি আসতে চান, উপসংহারটিকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে সেদিকেই তাড়াতাড়ি এগিয়ে যান, তাহলে রবীন্দ্রনাথকে শুধুমাত্র নির্দোষ মণীষীই মনে হবে না, তার ঠাকুর পদবীর সার্থক অনুকরণে তাকে কখনও কখনও অবতার বলেও মনে হবে, যিনি ঈশ্বরতুল্য পারফেক্ট, অথচ, আমরা জানি, কোন মানুষই পূর্ণরূপে সার্থক নয়।

যে সমস্ত তথ্যপ্রমাণাদি সহযোগে এই প্রচেষ্টা, সেই সমস্ত তথ্যপ্রমাণাদি আমাদের সাধারণ মানুষের হাতে নেই। এই ইন্টারনেটের যুগেও নেই। রবীন্দ্রনাথের সমগ্র চিঠিপত্র আমাদের হাতে এখনও আসে নি, বিশেষত, বিদেশি সমাজে সাধারণ থেকে শুরু করে অসাধারণ ব্যক্তিত্ববর্গ --- কোন মানুষের সাথেই তেমন সার্থক কথোপকথন এবং তার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস নিয়ে আধুনিক গবেষণার ক্ষেত্র প্রায় শূন্য। ফলে যে চিঠিপত্র এবং ইতিহাস সম্বলিত ঘটনা সহায়তায় সৌরিন্দ্র মিত্রের এই নিবন্ধগুলির অবতারণা, তার যথাযোগ্য যাচাই, তাও আপন যুক্তি-বুদ্ধি অনুসারে, সাধারণ পাঠক হয়ে, একরকম অসম্ভব এবং পরিশ্রমসাধ্য, ব্যয়সাধ্য এবং সময়সাধ্য

প্রথম খন্ড পড়তে গিয়ে আমি উচ্ছ্বাসে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। একজন মানুষ কতটা রবীন্দ্রনাথকে ভালোবাসলে এমন একটা প্রবন্ধের অবতারণা করতে পারেন! কি তার পড়াশোনা, কি তার সত্য অন্বেষণের আকাঙ্ক্ষা, কি তার পাণ্ডিত্য! দ্বিতীয় খন্ডটি পড়তে গিয়ে একটা খটকা লাগতে শুরু করল। মূলত, এই খন্ডটিই সবচেয়ে বড়ো এবং মূল বইয়ের ভারকেন্দ্র। তৃতীয় খন্ডটি পড়তে গিয়ে আমার একটা সুবিধা হল। সুবিধাটা এই যে, রোমাঁ রোল্যাঁ-র সাথে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক নিয়ে টানাপোড়েনের যখন কাটাছেড়া চলছে, তখন আমার কাছে, সৌভাগ্যক্রমে, তাদের চিঠিপত্রের সার্থক বাংলা সংকলন, রোমাঁ রোল্যাঁ-র বেশ কয়েকটি ভারতবর্ষীয় সম্পর্কিত লেখা, জার্নাল এবং রবীন্দ্র-সম্পর্কিত তৎকালীন কিছু ইতিহাস হাতে আছে। আমি যখন পাশাপাশি সেগুলোও পড়তে শুরু করলাম তখন আমার কাছে বিষয়টি স্পষ্ট হল। রবীন্দ্রনাথকে সার্থক করতে গিয়ে তিনি রবীন্দ্রনাথের ভ্রান্তিগুলোকেও সার্থক করে বসেছেন, রবীন্দ্রনাথের স্বীকারোক্তি স্বত্ত্বেও, এবং, তাই নয়, সেই ভ্রান্তিগুলোর সার্থক ভ্রান্ত অ্যানালিসিস করে, রোমাঁ রোল্যাঁ-র দুরদর্শিতাকে খাটো করেছেন, অবশেষে রবীন্দ্রনাথকে পারফেক্ট করে তুলেছেন। কেউ যদি রবীন্দ্রনাথ-মুসোলিনী-রোমাঁ রোল্যাঁ প্রসঙ্গটাকে খতিয়ে দেখেন, তাহলেই ব্যাপারটা পরিস্কার হয়ে যাবে।

রবীন্দ্রনাথকে পারফেক্ট প্রমাণ করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে সেইসব ব্যক্তিদেরও এতটাই খাটো করে ফেলেছেন, (বিশেষতডব্লু বি য়েট্‌স, এজরা পাউন্ড, রোটেন্‌স্টইন) যা তাদের প্রাপ্য ছিল না। তারা তেমনটা হয়তো ছিলেনও না। পড়তে পড়তে অনেক ক্ষেত্রেই বোঝা যায় যে, ব্যক্তি-আক্রমণটা রাগের আবেগে হয়ে পড়ছে, যার কারণে, তার এই বইটা সম্পূর্ণ ‘আনবায়াসড্‌’ বলা যাবে না।

তবুও রবীন্দ্রপ্রেমিক, রবীন্দ্রবিদ্বেষী কিম্বা বাঙালীর উচিৎ, সময় পেলে, গীতাঞ্জলী-র পাশাপাশি এই ধরণের কিছু বইও পড়া। কারন? হঠাৎ হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত যে বালখিল্য সিদ্ধান্ত আমরা বাঙালী সম্প্রদায়কে টানতে দেখি, তাদের অগাধ পাণ্ডিত্যের আত্মবিশ্বাসিত প্রচার ও প্রসার ঘটতে দেখি, তার কতটা ফাঁপা আর কতটাই বা সার্থক, তা প্রমাণ করে এই ধরণের নিখুঁত তথ্যসমৃদ্ধ বইগুলি। তৎসময়ে রবীন্দ্রসাহিত্যের ক্ষনিক অংশ ইউরোপ এবং আমেরিকার জনমানসে কি পরিমাণ প্রভাব ফেলেছিল, সার্থক প্রমাণ সহযোগে সৌরীন্দ্র মিত্রের এই পরিশ্রম যেন বৃথা না যায়, বাগদেবীর কাছে, ২৯শে ফেব্রুয়ারীতে, এই প্রার্থনাই রইল।

=====================================

খ্যাতি অখ্যাতির নেপথ্যে

সৌরীন্দ্র মিত্র

আনন্দ পালিকেশান

মুদ্রিত মূল্যঃ ২০০ টাকা

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে