ছিন্ন শিকল পায়ে নিয়ে...



অক্টোবর ১: গতকাল, ৩০শে সেপ্টেম্বর ১৮৭৬, সকাল এগারোটার কয়েক মিনিট বাদে মস্কো থেকে আগত মারিয়া বরিসভা নামে এক দরজি বিশ নম্বর গালেরনায়া স্ট্রীটের ছয়তলা উঁচু অভ্‌সিয়ান্নিকভ হাউসের চিলেকোঠার জানলা থেকে নিচে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। ... আত্মহত্যার সময়ে বরিসভার দু-হাতে মেরি-মাতার আইকন ধরা ছিল। (জনৈক সংবাদপত্রে প্রকাশিত কলামের অংশবিশেষ)

     

      দস্তয়েভস্কির মতে, এটি ‘বিনীত, বিনম্র আত্মহননের এক অভূতপূর্ব নিদর্শন’। তিনি লিখছেন, “এখানে দেখাই যাচ্ছে, কোনও কাতরোক্তি বা কারও বিরুদ্ধে কোনও অনুযোগ --- এসবের কিছু নেই। স্রেফ বেঁচে থাকাটাই তার পক্ষে দুর্বিসহ হয়ে উঠেছিল। ‘ঈশ্বর তা চানও নি’ --- তাই সে মারা গেল, প্রার্থনা করতে করতেই মারা গেল। কিন্তু কিছু ব্যাপার আছে যেগুলি দেখতে যত সাধারণ-ই হোক-না-কেন, তা নিয়ে দীর্ঘক্ষণ চিন্তা না করে পারা যায় না। সেগুলি আপনার চোখের সামনে এমনভবে দাঁড়িয়ে থাকবে যেন আপনি নিজেও তার জন্যে দায়ী। এই বিনম্র মেয়েটি যে নিজেকে এমনভাবে ধ্বংস করে দিল এটা কিন্তু আপনি চান-না-চান আপনার মনকে পীড়া দেবেই দেবে।” দস্তয়েভস্কি লিখছেন, তার ‘লেখকের দিনলিপি’তে।

      অতঃপর জন্ম নিচ্ছে এমন এক নভেলা, যার মূল ঘটনা এই আত্মহত্যা, কিন্তু তার পেছনে এক জ্বলন্ত বিষয়, একটা প্রশ্ন, যে প্রশ্নের মুখোমুখি আমরা সবাই, কমবেশি, বিশেষত, আমরা মেয়েরা, যে সমস্যার অগ্নিপরীক্ষা থেকে আজও বেরিয়ে আসতে পারি নি।

      “স্বাধীনতা অথবা ভালোবাসার অধীনতা” --- কোনটা কাম্য?

      দস্তয়েভস্কি তার আখ্যানে যে পরিসর তৈরী করলেন, তা হল, এক স্বামীর তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্ব, তার স্ত্রী’র আত্মহত্যার পর, সেই রাত্রে, তার স্ত্রীরই মরদেহের সামনে। সাধারণত, আমি দেখেছি, আত্মহত্যা নিকটপ্রিয়জনকে আত্মধিক্কারে মগ্ন করিয়ে দেয়, তা সে যতই নির্দোষ হন না তিনি। কিন্তু দস্তয়েভস্কি, এই পর্যায়ে, ব্যাপারটাকে এক জটিল মনোবিকলনের দিকে নিয়ে গেছেন।

      সম্পর্ক’, যে-কোনরকমেরই হোক না কেন, শব্দটার পেছনে যে প্রবহমান জীবনধারা বয়ে চলে বছরের পর বছর ধরে, তা আমার কাছে খুবই জটিল এবং গহীন লাগে। আমি দেখেছি ‘পিতা পুত্রকে নাহি দেয় স্থান / হেথা সুখ ইচ্ছ মতিমান?’ এ কোন কবিকল্পনা নয়। কোথাও যেন, একটা পর্যায়ে এসে, সম্পর্ক একতরফা হয়েই যায়। একপক্ষ অপরপক্ষকে Dominate করবে, এবং করেই চলবে; এর নাম আমরা দিই ‘ভালোবাসা’। আমাদের শাস্ত্র রাধা’র কথা বলে, সীতা’র কথা বলে। চিরজনমদুখিনী এই দুই ভারতীয় ‘রোল মডেল’ বরাবরই ‘submissive’, এবং আমরা তাকে দেবীরূপে পূজা করি। মজার ব্যাপার, দ্রৌপদী দেবী নন। অর্থাৎ, সম্পর্কে একজন চিরকাল নিপীড়িত হবে, আরেকজন নিপীড়ন করবে; একজন TOP তো আরেকজন BOTTOM; একজন সুবিধা নিয়েই যাবে, তো অপরজন সুবিধা দিতে বাধ্য থাকবে; একজন শোষক, তো আরেকজন শোষিত; একজন নিজেকে নিঃশেষ করে, উজাড় করে নিঃস্ব হয়ে যাবে, মুখে তবু রা কাড়বে না, তো অপরজন শুধুমাত্র নির্লজ্জের মতো সেই উজাড়িত ত্যাগ গ্রহণ করে করে নিজেকে পূর্ণ করে যাবে। সম্পর্কে দুই তরফের Responsibility কেবলমাত্র একপক্ষের আহুতির খাতে বয়ে যাবে, তার স্থান পরিবর্তন করবে নাএটাই, মোটামুটিভাবে ভারতীয়দের ধর্মীয় নিদান। বাস্তবে, হয়তো, কখনও কখনও বার্ধক্য কিম্বা পীড়ার বেশে প্রতিশোধ তার স্থান নেবে, কিন্তু সেটা কি সম্পর্কের পূর্ণতা? সে তো দীর্ঘদিনের বঞ্চনার নিষ্ঠুর জঘন্য প্রতিবাদ তা সম্পর্ককে সুস্থ করে না, সম্পর্ককে ক্যান্সারের মতো এক রোগের হাতে সঁপে দেওয়ার মতো হয়

প্রসঙ্গত, মেয়েরাই যে একমাত্র এর শিকার, এ আমি বিশ্বাস করি না, পুরুষরাও, এই ধ্বংসযজ্ঞে নিজেদের আহুতি দিয়ে এসেছেন যুগের পর যুগ ধরে। দাঁড়িপাল্লায় দুজনেই সমান সমান, যে কারণে, হয়তো, কোন সম্পর্কই, কোনদিন সমান খাতে বয়ে যেতে পারে নি। পারফেক্ট পারস্পরিক বোঝাপড়া এক আদর্শ কাব্যকথার উদাহরণ, যা কোনদিন কেউ archive করতে পারবে বলে মনে হয় না।

      মজার ব্যাপার, যিনি সুবিধা নিয়েই চলেন, অর্থাৎ, শোষক, কিম্বা শাষক, তিনি কিন্তু কোনভাবেই বিশ্বাসই করতে পারেন না যে, তিনি কোন অন্যায় করছেন! ‘ভালবাসা’ শব্দটা এতটাই ভ্রমাত্মক, যে পরাধীন করে রাখার মধ্যে, possessiveness-এর মধ্যে তিনি এক মঙ্গলময়তা দেখেন কিম্বা শাসনের অমোঘ প্রকাশ যে অন্যের গলায় ফাঁসের দড়ি হয়ে পড়ছে তা টেরই পান না, কিম্বা পেলেও, ‘প্রেম’ কিম্বা ‘concern’ শব্দটার মধ্যে দিয়েই নিজের মহানুভবতার আত্মপ্রসাদ লাভ করে চলেন। চুড়ান্ত কিছু একটা হয়ে যাওয়ার পর, যখন, আত্মবিশ্লেষণ অবধারিত হয়ে পড়ে, তখনও, নিজের দায়, বুঝতে পেরেও, অপরের ঘাড়ে সেটি চাপানোর মধ্যে দিয়ে অবচেতনে থাকা অপরাধের বোঝা সরিয়ে পুনরায় মূলস্রোতে ফিরে আসতে চান।

      এর সমাধান? অধিকাংশ মানুষই তো এর সমাধান করেই জীবনধারণ করেসেটা কি? একজনকে নত হতেই হয়। সে অধীনতা স্বীকার করে, বাকি জীবন চলে তার নীরব ক্ষয়যারা তা চায় না, ছিন্ন শিকল পায়ে নিয়ে যে পাখীর ওড়ার সাধ জাগে, সেই পাখী ‘ডিভোর্স’ করে, কিম্বা ‘আত্মহত্যা’। দস্তয়েভস্কি এর মধ্যে থেকে আত্মহত্যাকে তুলে নিয়ে আসলেন। যিনি শোষণ করছিলেন, তার Narrative –এ উঠে আসা এই সম্পর্কের সংকট আমাকে শিহরিত করে কেন সে নিজের দোষ দেখতে পায় না? দস্তয়েভস্কি তার ডায়রিতে লিখেছিলেন ---

      “… -কে টেবিলের ওপর শুইয়ে রাখা হয়েছে আর কি কখনও ওকে দেখতে পাব? খ্রীষ্ট যে আমাদের শিখিয়েছিলেন, ‘তোমার প্রতিবেশীকে আপনার মতো প্রেম করিবে’--- সেটা অসম্ভব মানুষের বাধা তার অহং, তাই মানুষ এমন একটা আদর্শের সন্ধান করে, যা তার নিজের প্রকৃতির বিপরীত…”

      এই অহং-এর মুখোমুখি আরও একবার আমি মুখোমুখি হই কোনটা আমি বাছব? আমার সম্পর্কগুলো আমাকে কোন দিকনির্দেশ করছে? স্বাধীনতা, অথবা ভালোবাসার অধীনতা? তার লেখনীর আয়না আবার আমার সামনে তিনি তুলে ধরছেন কালো কালো ছায়ার মধ্যে থেকে আমি নিজেকে কেমন যেন ধুসর পান্ডুলিপি-র মতো দেখতে পাই চিনতে পারি না নিজেকে আমি অহংপূর্ণ, না অহংবর্জিত, না কি ছায়ায়-মায়ায় মেশানো এক রহস্যময় বিষদময়তা?

      ক্রোত্কায়া, তথা বিনতাআমাকে কোন মায়াময় প্রশ্নের সাদা-কালো অরণ্যাণীর মধ্যে ঠেলে দেয়! দস্তয়েভস্কি, আরও একবার, আমার কাছে নিদারুন অসহনীয় হয়ে ওঠে, ছোট্ট নভেলাটি দেখতে দেখতে শেষ হয়ে যায়

 

======================

 

বিনতা

ফিয়োদর দস্তইয়েভস্কি

অনুবাদকঃ অরুণ সোম

প্রতিক্ষণ

মুদ্রিত মূল্যঃ ২০০ টাকা

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে