চীনা সংসারের একটুকরো রোজনামচা



লিউ ঝেনউয়ুন চীনদেশের হেনান প্রদেশের মানুষ। ২০১১ সালে পেয়েছেন মাও দুন সাহিত্য পুরস্কার, যা চীনা সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের সমতুল্য ধরা হয়। আচ্ছা, আমাদের দেশের কোন পুরস্কারটা ভারতীয় সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার হিসাবে ধরা হয়? সাহিত্য অকাদেমী? জ্ঞানপীঠ? জানি না। তো যাই হোক, বাঙলা ভাষায় এই প্রথম তার বই অনুবাদ করা হয়েছে। করেছেন আশিস দেব। চমৎকার অনুবাদ। কিছু কিছু শব্দ, এমনকি বাক্যবন্ধকেও বাংলা তর্জমা করেছেন, এমনকি কাঁচা খিস্তিও। অহোঃ! চমৎকার সাহসী অনুবাদ।

      শিয়াও লিন্‌, স্বামী, রোজ সকালে উঠে পনীর কেনার লাইনে দাঁড়ায়। বাড়ি ফেরে। ঘরে আয়া, খানিক ফাঁকিবাজ, খানিক বা কাজের। শিয়াও লিন্‌ তাকে বকাবকি করে। শিয়াও লি, স্ত্রী, ঘরের আয়াকে বকাবকি করে কাজে ফাঁকি দেওয়ার জন্য। তারপর স্বামীকে বকাবকি করে। অতঃপর দুজনে ঝগড়া করে। এই পর্যায়ে ব্যক্তিগত আক্রমণ খানিকটা হয়ে যায়। তারপর দুজনেই অফিসে চলে যায়। ঘরে রয়ে যায় আয়া এবং তাদের ছোট্ট বাচ্চা। তারা রোজ অফিসে যায়প্রতিবেশী ভারতীয় পরিবারটি দুই চক্ষের বিষ, যদিও, দুজনেরই দুজনকে প্রয়োজন। তারা জলের চুরি করে। ধরা পড়ে। লজ্জা পায়। আবার চুরি করে। তারা চাকরির উন্নতির, মেয়েকে নার্সারিতে ভর্তির জন্য তদ্বির করে। ঘুষ দেয়। লজ্জা পায়। আবার তদ্বির করে। ভাগ্য কখনও সুপ্রসন্ন, কখনও অপ্রসন্ন। স্বামী বন্ধুর দোকানে পার্ট টাইম কাজ করে। লজ্জা পায়। তবুও কিছু অর্থলাভের জন্য কাজটা করে। অতিথি এলে রুষ্ট হয়, স্বামী, স্ত্রী দুজনেই। লজ্জা পায়। কিন্তু অতিথি সেবাও করে। এইভাবে দিন ফুরিয়ে রাত আসে। রাতে দুজনেই ঝগড়া করে কিম্বা ভালবাসাবাসি করে। আনন্দ পায়। নাক ডাকিয়ে ঘুমায়। রাত ফুরিয়ে দিন আসে। স্বামী আবার পনীর কেনার লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ে। ফুলকপির মরশুমে গাড়ি ভর্তি করে বাড়ীতে ফুলকপি নিয়ে আসে।

      এই উপন্যাসটি প্রথম চীনে প্রকাশিত হয় ১৯৮৯ সালের জানুয়ারি মাসে। কোন আধুনিক লেখা নয়, প্রায় পঁচিশ বছর আগেকার একটা নভেলাকে আশিসবাবু বেছে নিয়েছেন অনুবাদের জন্য। এবং বিস্ময়করভাবে, চরিত্রগুলোর মানসিকতা বর্তমান যুগে দাঁড়িয়েও প্রাসঙ্গিক। তাহলে কি বঙ্গ মানসিকতা চীন মানসিকতার দিক থেকে কমপক্ষে পঁচিশ বছর পিছিয়ে আছে? এখনও কি আমরা নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতেই বিশ্বাস করছি না? এখনও শহুরে ঠাঁটবাটে অভ্যস্ত আমরা ‘দেশের বাড়ী’র আত্মীয় এমনকি নিজের বাপ-মা এলে বিরক্ত বোধ করি না? এখনও কি আমরা ছেলে-মেয়েদের ভালো স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য তদ্বির করি না? এখনও কি আমরা প্রতিবেশীদের প্রতি হিংসেয় জর্জরিত হই না? কাজের লোক নিয়ে নিত্য খিটিমিটি কি লেগেই থাকে না? রোজ সকালে বাজারে কিম্বা সপ্তাহে একবার ভোরবেলায় রেশনের দোকানে লাইন দিতে হয় না? হয় বৈ কি। কোথাও হয়তো, এ সমস্যা একটা সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে, চিরকালের। চীনের সমাজের সাথে অনেকাংশে, এশীয় এবং প্রতিবেশী হওয়ার সুবাদে, অনেক মিল আছে বৈ কি। ওয়াং কার ওয়াই-এর সিনেমাতেও এই মিল আমি লক্ষ্য করেছি।

      উপন্যাসের মধ্যে কোনরকম তলস্তয় মার্কা কোন ‘দর্শন’ নেই। আছে চিত্তরঞ্জন মাইতি টাইপ বেডরুম ড্রামা। যেখানে হাস্যরস এবং ব্যঙ্গরসের আবহে বেইজিং শহরের এক তথাকথিত দরিদ্র পরিবারের সুখ-দুঃখের কাহিনী লেখা আছে। “নাগরিক জীবনের সাধারণ মানুষ, তার অসঙ্গতি, কৌশলকে তিনি (লেখক) বলেন মৃদু কৌতুকে।” কথা সত্য। চড়া মাপের কষাঘাত করাটা তার পক্ষে সম্ভব নয় বলেই কি এমন মৃদু প্রতিবাদ? চীনা পাঠকরাই বলতে পারবেন। কিন্তু, এই মৃদু কতকগুলো ঠোনা’র মধ্যে যেটুকু উঠে আসে, তাতে করে আমাদের সমাজ ব্যবস্থার সাথে ওদেশের সমাজ ব্যবস্থার খুব একটা যেমন পার্থক্য দেখা যায় না, তেমনই, স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য কলহের মধ্যবর্তী টানাপোড়েনে যে সংলাপগুলো পাওয়া যায়, তা আমাদের আশেপাশে, এমনকি চার দেওয়ালের মধ্যে কান পাতলেই শুনতে পাওয়া যায়, এমনকি গ্রামে-মফস্বলেও। চরিত্র বদলে যায়, ভাব বদলায় না।

তো, সবমিলিয়ে এই নভেলা চট্‌ করে, ট্রেনে কিম্বা বাসে, বর্ষায় কিম্বা শীতে, সকালে কিম্বা রাত্রে দু-এক ঘন্টা অবহেলে সময় কাটানোর জন্য বেশ ভালো অপশন।

প্রশ্ন একটাই, নামকরণের সার্থকতাটা কি?

===========================

মাটিতে ছড়ানো মুরগীর পালক

লিন ঝেনইয়ুন

অনুবাদকঃ আশীস দেব

ব্রেইন ফিভার পাবলিকেশান

মুদ্রিত মূল্যঃ ১৫০ টাকা

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা


Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে