পরস্পরকে ভালোবাসো
“Love One
Another”
এই একটি
কথাই হয়তো আজ গোটা বিশ্ব-বিভীষিকার মোড় ফেরাতে পারে। এই একটি কথার নীল-প্রয়োজনীয়তা
এখন ভেসে বেড়াচ্ছে প্যালেস্তাইনের অলিতে গলিতে। এই একটি বাক্যের বাকরুদ্ধ ধুসর
জীবন আলেখ্য ইউক্রেনের রাস্তায় রাস্তায়। এই তিনটি শব্দের যথাযথ মর্মার্থবোধ
মণিপুরের ঘরে ঘরে কালো বিষাদে ঢেকে আছে। এই একটি কথার মর্মার্থ পাশ্চাত্য বুঝেছিল
১৯৪৫-এর পর। তারও প্রায় উনিশশো বছর আগে, চুনাপাথরের তৈরী চার দেওয়ালের ঘরে জনা
কয়েক আকাট গন্ডমুর্খকে বলেছিলেন যিনি, তিনি রক্তাক্ত হয়েছিলেন কাঠের ক্রুশে।
একটানা সাত
বছর ধরে চলা বিশ্বযুদ্ধে তখন গোটা ইউরোপ ধুঁকছে। ১৯৫০ সালে, যুদ্ধ পরবর্তী
বিদ্ধস্ত এবং লোভাতুর দেশগুলোর মধ্যে যখন এক ঠান্ডা যুদ্ধের অশনি সংকেত প্রোথিত
হচ্ছে, তখনি একটা উপন্যাস, বারাব্বাস, জনচেতনার মাঝে স্থান করে নিতে চাইল। পরের
বছরেই, বিশেষত, উক্ত উপন্যাসের জন্য, সুইডিশ এই লেখক সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার
পেয়েছিলেন। লেখকের নাম Pär Lagerkvist, রোমান হরফেই লিখলাম, কারন,
ইদানীং, বানান পুলিশের দৌরাত্ম্যে ভাববস্তু নির্মমভাবে ঢেকে যাচ্ছে।
আমরা কি বারাব্বাসকে চিনি? যীশুখ্রীষ্টকে যার বদলে ক্রুশবিদ্ধ করা
হয়েছিল, সেই খুনে ডাকাতের নাম বারাব্বাস? বাইবেলে, ম্যাথুর গসপেলে পাই, “সেই সময় বারাব্বানামে
এক কুখ্যাত (notorious prisoner) আসামী কারাগারে ছিল।”(২৭/১৬) মার্কের মতে, “সেই সময় বারাব্বা নামে একটি
লোক বিদ্রোহীদের সাথে কারাগারে ছিল, যাঁরা বিদ্রোহের সময় অনেক খুন জখম করেছিল।” (১৫/৭) লুকের বক্তব্য, “শহরের মধ্যে গণ্ডগোল বানানো ও হত্যার অপরাধে
বারাব্বাকে কারাবন্দী করা হয়েছিল।” (২৩/১৯) আর জন লিখেছেন, “তারা
আবার চিত্কার করে বলল, ‘একে নয়! বারাব্বাকে!’ এই বারাব্বা ছিল একজন বিদ্রোহী।” (১৮/৪০)
মোট
কথা, Pär Lagerkvist-এর কাছে বারাব্বাস কি হয়ে দাঁড়াল অবশেষে? সভ্যতার
সংকট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সত্যিই কি আর কোন বিশ্বাস অবশিষ্ট ছিল? আইনস্টাইন পর্যন্ত
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কায় বলেছিলেন, “I know not with what weapons World War
III will be fought, but World War IV will be fought with sticks and stones.” সেই আশঙ্কার অমোঘ প্রতিরূপ বারাব্বাস। বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টের পাতা
থেকে উঠে আসা বারাব্বাস মানুষের ধ্বংসলীলার ওপর বিশ্বাসের এক দুর্বিষহ প্রতিরপ।
এই প্রতিরূপের একটাই অস্ত্র। বারাব্বাসরূপী মনটাকে আমরা যদি
যীশুরূপী মনের দিকে ফিরিয়ে আনতে পারি। বাইবেলের পাতা থেকে, শুধু বাইবেল কেন, সমস্ত
ধর্মগ্রন্থের পাতা থেকে বোধহয় একটাই বাণী উঠে আসে, Do unto others as you would
have them do unto you. – অপরের সাথে তেমন ব্যবহারই করো, অপরের কাছে
যেমন ব্যবহার আশা করো। Pär Lagerkvist তাকেই
রূপ দিলেন তিনটি শব্দবন্ধনের বাক্যে - Love One Another.
এই উপন্যাসটার কাঠামো বাইবেল থেকে উঠে আসা বারাব্বাস চরিত্রটাকে নিয়ে,
উপন্যাসের শুরুতেই যে যীশুখ্রীষ্টের মৃত্যু প্রত্যক্ষ করছে। এবং তার পর থেকেই শুরু
হচ্ছে তার অন্তর্দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্ব তাকে আস্তে আস্তে খোকলা করে ফেলছে। তাকে
অস্তিত্ববাদ আর নাস্তিত্ববাদের মাঝে পিষে ফেলছে। জীবনের এক-একটা পর্বে সে কখনও
ভালো, কখনও মন্দের মধ্যে দিয়ে একটাই বোধকে উপলব্ধি করার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, Love
One Another
তা সত্ত্বেও, যদি এই আপ্তবাক্যে বিশ্বাস না থাকে, তাহলে? ধর্মের নামে পড়ে
থাকা মোহ অবশেষে হন্তার কারণ হয়। নিজেকে, অপরকেও। এই বইয়ের শেষ পর্বে দেখি, যে
বিশ্বাস করার জন্য সে প্রাণপনে সারা জীবন ধরে লড়ল, সেই বিশ্বাসে অটল না থাকার
কারণেই সেই বিশ্বাস তার বুদ্ধিভ্রংশের কারণ হল। বারাব্বাস তার শেষ মুহূর্তে একা। নরকের
অতল গুহায় কোটি কোটি কালো কালো অন্ধকারের মতো সে একা। মোহান্ধ ধর্মবিশ্বাস অবশেষে সমাপ্তি
টেনে দেয় – “স্বার্থের সমাপ্তি অপঘাতে। অকস্মাৎ / পরিপূর্ণ স্ফীতি-মাঝে দারুণ আঘাত
/ বিদীর্ণ বিকীর্ণ করি চূর্ণ করে তারে / কালঝঞ্ঝাঝংকারিত দুর্যোগ-আঁধারে।”
এই উপন্যাসের অনুবাদ করেছেন Alan Blair, সহজ সরল
ঝরঝরে অনুবাদ। ততোধিক সুন্দর অনুবাদ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর। আমি ওনার অনুবাদটা
যখন পড়ছি, মনেই হচ্ছে না অনুবাদ পড়ছি। একটা সার্থক অনুবাদ কি হতে পারে, তার যথার্থ
উদাহরণ নীরেন্দ্রনাথের ‘বারাব্বাস’। বুলবুল সারওয়ারের অনুবাদও মন্দ নয়। যদিও তিনি
স্বীকার করেছেন, “শ্রী নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বারাব্বাস অনুবাদ করেছিলেন বহু আগে।
তার সুকর্ম থেকে সাহায্য না নিয়ে পারিনি।” তিনটের মধ্যে তুলনা করলে নীরেন্দ্রনাথের
অনুবাদ আমার সবচেয়ে বেশি কাছের মনে হয়েছে।
তবে এই উপন্যাস প্রসঙ্গে André Gide -এর একটা চিঠি পড়লাম। সেখানে তিলি লিখছেন, “It is the measure of Lagerkvist’s
success that he has managed to admirably to maintain his balance on a tightrope
which stretches across the dark abyss that lies between the world of reality
and the world of faith.”
তিনি
যথার্থই লিখেছেন।
======================
Barabbas
Pär Lagerkvist
Translated By: Alan Blair
Vintage International
Price: 850/-
অনুবাদকঃ নীরেন্দ্রনাথ
চক্রবর্তী
পরম্পরা প্রকাশন
মুদ্রিত মূল্যঃ ১৫০ টাকা
অনুবাদকঃ বুলবুল সারওয়ার
ঐতিহ্য প্রকাশন
মুদ্রিত মূল্যঃ ১৮০ টাকা
আইনস্টাইন পর্যন্ত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কায় বলেছিলেন, “I know not with what weapons World War III will be fought, but World War IV will be fought with sticks and stones.” আইনস্টাইনের পক্ষে এই কথা বলা কতটা মানায়, সেটা কিন্তু প্রশ্নের উর্ধে নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, নাৎসী জার্মানি ত্যাগ করে আমেরিকায় চলে যাওয়া পদার্থাবিদ বিজ্ঞানীরা মার্কীন পদার্থবিদদের সাথে মিলে এটোম বোমা আবিষ্কারের উদ্যোগ নেয়। তাঁদের এই উদ্যোগে মার্কীন প্রশাসনের সরাসরি যোগদান জরুরী ছিল। কারণ বিপুর অর্থলগ্নী ছাড়া এটোম বোমা তৈরী সম্ভব ছিল না। তার জন্য বিশাল পরিকাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন। বিজ্ঞানীদের নিজেদের উদ্যোগে যা সম্ভব নয়। কিন্তু বিজ্ঞানীদের সেই আবেদনে মার্কীন প্রশাসন সাড়া দিচ্ছিল না। একদিকে সম্পূর্ণ অজানা একটি বিষয়ের সাফল্যের বিষয়ে অনিশ্চিয়তা। আর একদিকে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সেই বিষয়ে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ। তখন সেই সকল বিজ্ঞানীদের অনুরোধে, স্বয়ং আইনস্টাইন তৎকালীন মার্কীন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে একটি চিঠি লেখেন। তিনি তাঁকে আশ্বস্ত করেন এই বলে যে, এটোম বোমা বানানো শুধুমাত্র সম্ভবই নয়। একটি এটোম বোমার ধ্বংসশক্তিও বিপুল। রুজভেল্ট, সেই পত্র পাঠ করেই এটোম বোমার ধ্বংসশক্তি সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে তবেই প্রজেক্ট ম্যানহাটনে বিপুল অর্থ বিনিয়োগের নির্দেশ দেন। এর পরের ঘটনা গোটা বিশ্বের দিশা বদলিয়ে দেয়। খুন হতে হয় কোটি কোটি জাপানিকে। যাঁদের প্রত্যেকের মৃত্যুর পিছনে রয়ে গিয়েছে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের হাত। তিনি যদি এইরূপ বিদ্ধংসী অস্ত্রের পক্ষে রুজভেল্টের কাছে ওকালতি না করতেন। হিরোশিমা নাগাসাকির নাগরিকরা সেদিন প্রাণে বেঁচে যেতেন। বিশ্বের দিশাও ভিন্ন পথে এগোতে পারতো। ফলে আইনস্টাইন পরবর্তী বিশ্বযুদ্ধের যে ভয়াবহতার ছবি এঁকেছেন। সেই ভয়াবহতার পথ সকলের আগে তিনিই কেটে গিয়েছিলেন। তাঁর মতো মানুষের কাছে একটা বড়ো সুযোগ এসেছিল। প্রথমেই সেই পথকে রুদ্ধ করে দেওয়ার। কিন্তু তিনি তা করেন নি।
ReplyDelete