এক দেশ, তিন জাতি, সারা বিশ্ব, এবং যুদ্ধ
“জাতি ছাড়া একটি দেশ আছে,
ঈশ্বর তার বিচক্ষণতা ও দয়া দিয়ে দেশবিহীন একটি জাতির দিকে আমাদের ধাবিত করছেন।” ~
লর্ড মেলবোর্ন
এই মুহূর্তে, সম্ভবত, সমগ্র বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে, একটাই বিষয় আর
আর সকল বিষয়কে ছাপিয়ে গিয়েছে। ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন যুদ্ধ। এই যুদ্ধ দুতরফা হচ্ছে
না। হচ্ছে একতরফা। অত্যধিক শক্তিশালী ইজরায়েল যেভাবে ঝাপিয়ে পড়েছে প্যালেস্তাইনের
ওপর, কোনভাবেই মনে হচ্ছে না যে, সামান্যতম লড়াই করার ক্ষমতাও তাদের আছে। গোদের ওপর
বিষফোঁড়া, ইউরোপ-আমেরিকার অধিকাংশ দেশ নীরবে ইজরায়েলকেই সমর্থন করছে।
প্যালেস্তাইনের ওপর, সম্ভবত, তামাম মুসলিম বিশ্বের দরদী সমর্থন থাকলেও, এই
মুহূর্তে যুদ্ধের ক্ষেত্রে, তাদের বজ্রনির্ঘোষণা তেমন কিছু নেই। মাঝখান থেকে অসংখ্য
সাধারণ মানুষের হীমশীতল দেহের কারণে কবরস্থান উপচে উঠছে।
যুদ্ধে, এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে, আমরা প্রত্যেকেই, হয়তো বা, কাউকে না
কাউকে সমর্থন জানাবো, কিম্বা জানাবো না, কিন্তু, যদি এই যুদ্ধের ওপর আমাদের কারো
কৌতুহল কিম্বা অনুভবী বেদনা থেকে থাকে, তাহলে, এই যুদ্ধের বেদনার্ত বিষয় থেকে সরে
এসে, যুদ্ধের গতিপ্রকৃতির পাশাপাশি, যুদ্ধের কারণসূত্রের দিকে তাকাতেই হবে, এবং
আমার বিশ্বাস, এই যুদ্ধ মাত্র কয়েক দশকের নয়। এই যুদ্ধ দুটো দেশের নয়। এই যুদ্ধ
শুরু হয়েছিল টিকে থাকার লড়াই থেকে, আজ চলছে অমানবিক বীভৎসতায়।
কিন্তু তারও ইতিহাস আছে। কোথাও না কোথাও তার শুরু আছে।
আমি সেই শুরু থেকে শুরু করেছিলাম। হাতে নিয়েছিলাম সাইমন সেবাগ
মন্টেফিওরি-র ‘জেরুজালেম ইতিহাস’।
কোন ইতিহাসই আনবায়াসড্ হয় না। আনবায়াসড্ লেখক হতে পারে কি? সারাজীবন যে
মানুষের ওপর অসংখ্য ভিন্ন ভিন্ন মত, চিন্তা বা অনুভুতির অকাল বর্ষণ হল, তার পক্ষে
কি সমস্ত কিছুর পারে গিয়ে শুধুমাত্র কয়েকটি বিচ্ছিন্ন তথ্যসূত্র, তাও আবার সেই
তথ্যসূত্রগুলোও ‘আনবায়াসড্’ এমনটা বলা যাবে না, সেগুলোকে আপন চেতনসূত্রে গেঁথে
গেঁথে একটা আস্ত আনবায়াসড্ মালা গাঁথা সম্ভব?
না, কখনই না।
কিন্তু তবুও, একটা না একটা সূত্র ধরে এগোতেই হয়। আমি
ইজরায়েল-প্যালেস্টাইনের ইতিহাস ঘাটতে গিয়ে দেখলাম, সে ইতিহাস এসে মিশল জেরুজালেমে,
যে জেরুজালেমের ইতিহাস মিশেছে ইহুদী-খ্রীষ্টান-মুসলমান ধর্মের এক ইতিহাসে।
সাতশো আটানব্বই পাতার সুবিশাল এই ইতিহাস শুরু হয়েছে সেই আদি সময়
থেকে, “খ্রীষ্টপূর্ব ৫ হাজার বছর আগেও এখানে মানুষের বাস ছিল। ব্রোঞ্জ যুগের
শুরুতে, খ্রীষ্টপূর্ব ৩২০০ সালের দিকে, প্রথম নগরী উরুক, যা এখন ইরাক, ছিল ৪০
হাজার মানুষের শহর। কাছাকাছি জেরিকো ছিল একটি দুর্ভেদ্য শহর। সে সময় মানুষ
জেরুজালেম পাহাড়ে সমাধি নির্মাণ করে মৃতদের কবর দিত। ছোট চারকোণা আকারের ঘর বানাতে
শুরু করে তারা। সম্ভবত এটা ছিল ঝরনার ওপর দিকের পাহাড়ে একটি প্রাচীরঘেরা গ্রাম।
এরপর বহু বছর এই গ্রামটি ছিল পরিত্যক্ত।”
তো এই পরিত্যক্ত জেরুজালেম, এক সময়ে পৃথিবীর কেন্দ্র হিসাবে
পরিগণিত হতে শুরু করে, ধর্মীয় আবেগে। কিন্তু এই পরিগণিত হওয়ার সময়ে এখনকার
ভুমিপুত্রেরা ছড়িয়ে পড়েছে রাশিয়ায়, ব্যাবিলনে, মিশরে, রোমে, গ্রীসে... যে যেখানে
পেরেছে উৎখাত হয়ে একটু ঠাঁই খুঁজেছে। ডেভিডের রাজ্যের অধিবাসীরা, যারা ‘কেনান’
সম্প্রদায়ের রেখে যাওয়া ভূখন্ডে হিব্রু নামে এক ঈশ্বরে বিশ্বাসী জাতি হিসাবে
আত্মপ্রকাশ করেছিল একসময়, সেই অধিবাসীরা অসংখ্যবার গণহত্যা, উৎখাত, ধর্ষণ,
ক্রীতদাসত্ব কিম্বা কঠিন রোগে উৎসন্নে যেতে যেতেও যায় নি। বরং তার মধ্যে থেকেই
আত্মপ্রকাশ করেছে, বারংবার ফিরে আসতে চেয়েছে তাদের আদি ভূমিখন্ডে। তাদের মূল
ভিত্তি ‘ফাইভ বুক অফ মোজেজ (পেন্টাটিউড)’, এবং ইহুদী জাতির আদি পিতা – আব্রাহাম
(ইব্রাহিম), যিনি কেনান সম্প্রদায়ের, যিনি ইরাক থেকে আসেন, এবং যিনি, টেম্পল অফ
মাউন্টের উৎস কাহিনী---
“ইব্রাহীমের দুষ্ট প্রকৃতির নাতি জ্যাকব কৌশলে উত্তরাধিকার
হাসিলের চেষ্টা করেন। তবে তাকে এক আগন্তুকের, যিনি পরে ঈশ্বরে পরিণত হয়েছিলেন,
সঙ্গে কুস্তি প্রতিযোগীতায় নামতে হয়, যে কারণে তার নতুন নাম হয় ইসরাইল, যার অর্থ
যিনি ঈশ্বরের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। এখান থেকেই কার্যত জন্ম হয় ইহুদী জনগোষ্ঠীর,
ঈশ্বরের সঙ্গে যাদের সম্পর্ক হয় অত্যন্ত আবেগময় এবং যন্ত্রণাদায়ক।”
এরপরের ইতিহাস ক্রমাগত জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে। মিশরের ক্রীতদাস
হিসাবে তাদের কথা জানতে পারার পাশাপাশি মোজসের কাহিনী ‘বুক অফ এক্সোডাস’-এ পাওয়া
যায় মুসার কথা। দশটি কমান্ডমেন্ট তৈরী হয়। আর্ক অফ দ্য কোভেন্যান্ট প্রতিষ্ঠা হয়।
তারপর যুদ্ধ যুদ্ধ আর যুদ্ধ। এক ক্ষতবিক্ষত ইতিহাস। সে ইতিহাসের সাথে,
পরবর্তীকালে, যুক্ত হয় একই সম্প্রদায় থেকে বেরিয়ে আসা খ্রীষ্টান সম্প্রদায় এবং
মুসলমান সম্প্রদায়ের ইতিহাস। ইহুদীরা আর মাথা তুলে দাড়ানো তো দূর, তাদের ইতিহাস ও
আত্মসন্মান মিশে যায় পথের ধূলোয়। যে সন্মানের থেকেও বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বড়ো সমস্যা
হয়ে দাঁড়ায় --- জাতি হিসাবে বেঁচে থাকার সুযোগ। অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম। সেই
সংগ্রামের শেষে দয়া করে পাওয়া এক টুকরো জমিই আজকের ইজরাইল। যার অস্তিত্বের ইতিহাস
জটিল এবং গহীন।
মন্টেফিওরির এই ইতিহাস বইটিতে লেখক ফেনিয়ে কোন কথা বলারই সুযোগ
পান নি। ইতিহাস এতটাই জটিল, গহীণ, ঘটনা পরম্পরার জটাজালে রীতিমতো প্যাঁচ লেগে যাওয়া
এক উলের গুটলি। এই উলের সুতোয় যে কে কার সাথে জটিল প্যাঁচে পেঁচিয়ে আছে, তার
উদ্ধারকার্য এই এক বইতে সম্ভব ছিল না। ফলে মন্টেফিওরি নিজের চিন্তাশক্তিকে খুব
একটা কাজে লাগাতে সক্ষম হন নি। ইতিহাসের সূত্রগুলো গাঁথতে গাঁথতেই কখন যে ‘ছ-দিনের
যুদ্ধ’ এসে পৌছলেন, নিজেই বোধহয় টের পান নি। মাঝখান থেকে আটশো পাতার এক বিশাল
বিস্ময় সৃষ্টি করে ফেললেন।
এই ইতিহাস এতটাই প্রশ্নময়, যে, প্রতিটা অধ্যায়ের প্রতিটা পর্বশেষে
এক-দেড় পাতার টীকা যোগ করতে করতে চলতে হয়েছে তাকে। শুধু তা নয়, আলাদা করে
তথ্যপঞ্জীও তৈরী করতে হয়েছে, যা শেষ পঞ্চাশেরও বেশি পাতা জুড়ে জ্বলজ্বল করছে ছাপার
অক্ষরে বইয়ের শেষে। ফলে চট্ করে এই যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কারো দোষ-গুণের বিচার
করা এককথায় অসম্ভব। এমনকি এমনকি দার্জিলিং চায়ের পেয়ালায় ঘন্টার পর ঘন্টা তুফান
তুলেও রফা করা অত সহজ নয়। যে পেয়ালার চায়ে ইউনাইটেড নেশন ডুবে গেছে। আমি চোদ্দটি
গভীর রাত পেরিয়েও বলতে পারছি না, আমি সম্যক ধারনা করতে পেরেছি।
তবে গোটা ইতিহাস মোটামুটিভাবে ধারণা করতে গেলে এই বই ভালো সহায়ক।
বাংলা অনুবাদটিও চমৎকার। কেবল মাঝে মাঝে বাক্যগঠনে গুগল ট্র্যান্সলেটারের আভাস
পাওয়া যায়।
বিঃ দ্রঃ –
আজকের যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতের সাথে এই ইতিহাসের যোগ খুবই ক্ষীণ, আমি যতদূর জেনেছি।
হয়তো, ১৯৪৮ সাল কিম্বা তৎপরবর্তী ছয় দিনের যুদ্ধেরও পরবর্তী ইতিহাসই আজকের গাজাপট্টিতে
যুদ্ধের মুল সমস্যা নীহিত। কিন্তু আমি ইতিহাসের আগের ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে এই বইতে
ডুবে গিয়েছিলাম। এই বইয়ের ভিত্তিতে আজকের যুদ্ধের পর্যালোচনা করা হয়তো খানিকটা,
খানিকটা কেন, অনেকটা, অনেকটা কেন, প্রায় পুরোপুরিই বোকামি। আমি তা করতেও চাই নি, এবং
চাই না। সে অন্য কোন সময়ে, অন্য কোন কালে... আজ এই কূটনৈতিক মৃত্যুর তথা
হত্যাকান্ডের সামনে আমি মূক এবং বোবা বিস্ময়ে অপেক্ষা করছি, কখন, কিভাবে এবং কত
মৃত্যুর বিনিময়ে এই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
=====================
জেরুজালেম ইতিহাস
সাইমন সেবাগ মন্টেফিওরি
অনুবাদকঃ মোহম্মদ হাসান শরীফ
ও মাসুম বিল্লাহ
চারদিক পাবলিশার
মুদ্রিত মূল্যঃ ৯০০ টাকা
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা
Comments
Post a Comment