রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রমাঁ রল্যাঁ চিঠিপত্র ও অন্যান্য রচনা

 


চিন্ময় গুহের বইগুলি এযাবৎ পরপর পাঠের ফলে ফরাসী সাহিত্যের দিকপালদের প্রতি আমায় আকর্ষিত করেছে সন্দেহ নেই। ‘ঘুমের দরজা ঠেলে’ নামক বইটিতে চারটি (১০, ১১, ৫০, ৫১); ‘চিলেকোঠার উন্মাদিনী’ বইটিতে পরিশিষ্টসমেত দুটি; এবং রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আলাদা করে লিখিত প্রবন্ধগুচ্ছ ‘সুরের বাঁধ : রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে’–তে সবচেয়ে বড়ো প্রবন্ধ ইত্যাদি মন দিয়ে পাঠ করলে বোঝা যায়, মূলত রমাঁ রল্যাঁ-র সাথে তার প্রীতি অত্যন্ত গভীর। এর সাথে আমরা দেখতে পাই দুটি ইংরাজী বই ‘Bridging East and West’ হল মূলত রবীন্দ্রনাথ-রমাঁ রল্যাঁ চিঠিপত্র; এবং ‘The Tower and The Sea’, যা কি না রমাঁ রল্যাঁ এবং কালিদাস নাগের মধ্যেকার পত্রধারার এক সংকলন। এই দুটি বইয়েরই মূল কেন্দ্রবিন্দু রমাঁ রল্যাঁ।

অর্থাৎ, রমাঁ রল্যাঁ চিন্ময় গুহের মরমীয়া আবেদনের সাথে মিশ খেয়ে গেছেন। এর সাথে যুক্ত হয়েছে, রমাঁ রল্যাঁ-র ভারতপ্রীতি, বিশেষত রবীন্দ্রনাথ-গান্ধী-রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ পরিমন্ডলের মধ্যে তিনি বারংবার ফিরে এসেছেন। শেষ তিনজনের জীবনী বহুল বিখ্যাত, এবং রবীন্দ্রনাথের সাথে এক পর্যায়ে তার সম্পর্ক কোথাও যেন মান-অভিমানের পর্যায়ে গিয়ে পৌছায়। ফ্যাসিবাদ নিয়ে এবং রবীন্দ্রনাথের ইতালী ভ্রমণ নিয়ে রমাঁ রল্যাঁ-র উদ্বেগ কিম্বা রবীন্দ্রনাথের অসুস্থতা নিয়ে তার উদ্বিগ্নতা তাকে লেখা চিঠিপত্রের মধ্যে বেশ দেখা যায়। বোঝা যায়, মানসিকভাবে, তিনি অনেকটাই কবির প্রতি নৈকট্য বোধ করেন এবং তার সাথে আরও অনেক সময় কাটাতে চান। এবং এক পর্যায়ে শান্তিনিকেতনে আসার জন্যে উতলাও হয়েছিলেন।

চিন্ময় গুহের প্রবন্ধগুলোর মধ্যে থেকে রমাঁ রল্যাঁ-র যে পরিচয় পাওয়া যায়, তা যেন কোথাও শুধুই মুগ্ধতাবোধের প্রতিলিপিমাত্র। কিন্তু সত্য অর্থেই কি এমন ব্যাপারই ছিল? এমনকি, মুসসোলিনীর সাথে আলাপ ও সেই সূত্রে যে বিশ্বের সাথে বিবাদমান যুযুধানের মাঝখানে তার দৌত্যতা, সেখানেও কি বুদ্ধিমত্তার ছাপ পাওয়া যায়? চিন্ময় গুহের মুগ্ধতাবোধ কিম্বা সেই জটিলতার প্রাসঙ্গিকীর অপ্রয়োজনীয়তাবোধ আমাকে দুটো বইয়ের দিকে টেনে নিয়ে গেল, যার একটা নিয়ে আজ আলোচনা করব।

“যথাসাধ্য নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে আমি ফরাসি সংকলনটির মূলানুগ ভাষান্তরের চেষ্টা করেছি, সর্বতভাবে সেটি সার্থক হয়েছে বলে দাবি করার ধৃষ্টতা নেই আমার” লিখছেন শিবানী সিংহ, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রমাঁ রল্যাঁ চিঠিপত্র অন্যান্য রচনা’, নামক বইটিতে। এখন প্রশ্ন হল, মূল বইটি কোনটা? সেটারই কি ইংরাজী অনুবাদ চিন্ময় গুহ কৃত ‘Bridging East and West’? সেটা বোঝার কোন উপায় না থাকলেও, যদি এই বইটারই মূল ফরাসী অনুবাদ হয়ে থাকে, আমাদের কাছে সুখের বিষয়, বইটির বাংলা অনুবাদ হয়েছে এবং সরাসরি অনুবাদ হয়েছে, এবং তা লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গিয়ে Out Of Print হয়ে যাওয়ার আগেই, রবীন্দ্র গবেষক ও কালেক্টরদের বইটি সংগ্রহ করে নেওয়া উচিৎ। এবং ভবিষ্যতে অনুবাদিকা যদি এর পরবর্তী সংস্করণ প্রকাশ করতে অপারগ হন, তাহলে, জনস্বার্থে এর ডিজিটালাইজেশান করা উচিৎ।

এই বইটার অধিকাংশ জুড়ে রয়েছে চিঠিপত্র, তার সাথে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে রমাঁ রল্যাঁ-র প্রতি রবীন্দ্রনাথ কিম্বা রবীন্দ্রনাথের প্রতি রমাঁ রল্যাঁ-র বক্তব্য। এর সাথে তাদের কথোপকথন। এই বইয়ের মূল বিষয় নিয়ে কথা বলতে বসলে রাত কাবার হয়ে যাবে। কিন্তু একটা কথাই এখানে বলা যেতে পারে যে, চিঠিপত্র পড়তে পড়তে আমার মনে হচ্ছিল, রমাঁ রল্যাঁ-র যে বুদ্ধিদীপ্ততার ‘ইমেজ’ আমরা চিন্ময় গুহের প্রবন্ধগুলি থেকে পাই তা যেন খানিকটা ভাববিলাসের আড়ালে চলে গেছে। চিঠিপত্রের মধ্যে রমাঁ রল্যাঁ-র ভুল বোঝবার আভাস আছে, পরক্ষণেই সেখান থেকে বেরিয়ে এসে আবার গদোগদো কথালাপ আছে, এবং আবার সেখান থেকে বিশ্বসাহিত্যের আঙ্গিকে তাদের চিন্তাধারার কোথাও মিলে যাওয়ার পূর্বাভাস, কোথাও বা দ্বিমত পোষণের যে বাস্তবতা টের পাওয়া যায়, তা আর যাই হোক, একজন বিশ্বসাহিত্যিক হয়ে ওঠার পথে এক আবেগময় পরিসমাপ্তি ছাড়া আর কিছুই না। এবং একটু ভাল করে খেয়াল করলে দেখা যাবে, রমাঁ রল্যাঁ অহিংসবাদ (টলস্টয়) ও সমাজবাদের (জাঁ জোরেস) মধ্যে দোলাচালে চলতে চলতেই জীবন কাবার করেছেন, শুধু তাই নয়, একটা সময় এই দুই মতবাদের মাঝামাঝি একটা সার্থক সমন্বয় করার ব্যর্থ কল্পনাও করেছিলেন মহাত্মা গান্ধীর মধ্যে দিয়ে

চিন্ময় গুহ রমাঁ রল্যাঁ-কে একপ্রকার ‘ভারতবন্ধু’ বলে কল্পনা করেছেন। সম্প্রতি রমাঁ রল্যাঁ-র ‘ভারতবর্ষ’ নামক জার্নালটি আমার হাতে এসেছে। আমি পড়িনি। কিন্তু এই জার্নাল সম্পর্কে সৌরীন্দ্র মিত্র-র মতামতটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি লিখছেন, “নাম ‘ভারতবর্ষ’ হলেও এটির মধ্যে ভারতবর্ষ সম্বন্ধে কোনও গভীর চিন্তা বা অন্তর্দৃষ্টির লেশমাত্র নেই, আছে শুধু ভারতবর্ষ থেকে অথবা ভারতবর্ষের নাম করে যে কেউ যখনই তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন তাদের কথাবার্তা, খবরাখবর গল্পগুজব ইত্যাদি। ... এই জার্নালটি আসলে একটি ফাইল বা dossier এবং তার অর্ধেকই জঞ্জাল।”

অর্থাৎ, আমরা যদি একটু সাবধানতা অবলম্বন না করি, তাহলে, হয়তো, রমাঁ রল্যাঁ সম্পর্কে একটা ভাষা ভাষা রোম্যান্টিক ধারণা সম্পর্কেই অবহিত থাকব, যা রমাঁ রল্যাঁ-র একটি দৃষ্টিকোণ মাত্র। তা সম্পূর্ণ নয়। ‘ভারতবর্ষ’ নামক জার্নালটির বাংলা অনুবাদ পাওয়া যায়, যা সম্প্রতি আমার হাতে এসেছে। ছয় শতাধিক পৃষ্ঠা সম্বলিত এই বই পাঠ করলে পরিস্কার হওয়ার যায়গা থাকবে অনেকটাই। কিন্তু তার আগে, এই চিঠিপত্র একটা প্রাথমিক সোপান হিসাবে এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ এবং এই ধাপে দুজনের প্রতি দুজনের এবং সেই সাথে বিশ্বজগতের প্রতি দুজনের মনোবৃত্তিটাকে খানিকটা শ্রদ্ধাবনত লেখনীর মধ্যে দিয়ে জানা সম্ভব। এইখানেই এই বইটির সার্থকতা।

এখন দেখা দরকার, অনুবাদ হিসাবে বইটি কতটা সার্থক, যা নির্ণয় করার যোগ্যতা আমার নেই। কিন্তু পড়তে গিয়ে আমার কোথাও কোন সমস্যা হল না। বিশেষজ্ঞের দৃষ্টিতে বলছি না, পাঠকের দৃষ্টিতে বলছি। এর একটা বড়ো প্রমাণ কালিদাস নাগকে লেখা রমাঁ রল্যাঁ-র একটি চিঠি। উক্ত চিঠিটি ‘চিলেকোঠার উন্মাদিনী’তে চিন্ময় গুহ প্রকাশ করেছেন (পৃষ্ঠা 197)একই চিঠি পাওয়া যাচ্ছে এই বইটিতেও (পৃষ্ঠা 141)চিঠিদুটির অনুবাদ তুলনা করলে দেখা যায় বিষয়বস্তু মোটামুটিভাবে এক, যদিও, তারিখটির বিস্ময়করভাবে একটু পরিবর্তন ঘটেছে। চিন্ময় গুহের অনুবাদে চিঠির তারিখ ৫-৭ জুলাই, সেখানে শিবানী সিংহের অনুবাদে তারিখ ৬-৭ জুলাই, ১৯২৬! এছাড়া চিঠির মূলভাব এক, কেবল সাহিত্যিক পরিভাষার মধ্যে পার্থক্য লক্ষ করা যায়।

এ থেকে, পাঠিকা হিসাবে, আমি ধরে নিচ্ছি, বাকি লেখাগুলোর মূল অবিকৃতই আছে। সেই দিক থেকে বইটিকে বিশ্বস্ত বললে ভুল বলা হবে না। এখন কেবল একজন ফরাসিবিদের শীলমোহর পড়লে আমরা নিশ্চিন্ত হই। কিন্তু এ ব্যাতিরেকে, বইটির মূল্য ‘অমূল্য’র সমান। এ বই গবেষণা এবং কৌতুহলী পাঠকের জন্যে এক মূল্যবান দলিল হয়ে রইল, যা, দুর্ভাগ্য, এখনও লোকচক্ষুর অন্তরালেই রয়ে গেছে।

=========================

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রমাঁ রল্যাঁ চিঠিপত্র ও অন্যান্য রচনা

ভাষান্তর ও সম্পাদনাঃ শিবানী সিংহ

জে এন চক্রবর্তী অ্যান্ড কোং

মুদ্রিত মূল্যঃ ২৫০ টাকা

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা

 

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে