শ্রীসাঁই মহারাজের অন্যধারার অখ্যান
ভূমিকাঃ সবাইকে বিজয়া দশমীর অনেক
অনেক শুভেচ্ছা। গুরুজনদের প্রণাম। বিজয়া দশমীতে শিরিডি-র শ্রীসাঁই মন্দিরে, ‘দসেরা’
উৎসবে বর্তমানে সাঁই মন্দির সারারাত সাঁইপ্রেমীদের জন্য খোলা থাকে। গতকালও তাই
ছিল। শ্রীসাঁই-এর মহাসমাধি হয়েছিল এই দিনটিতেই। বর্তমানে তার জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে
বাড়ছে সমগ্র ভারত-সাধারণদের মধ্যে। আমার মনে হল, তার একটা বই নিয়ে আলোচনা করলে
কেমন হয়? আমার পাড়ার একজন সাঁইপ্রেমী আমাকে এনে দিয়েছিলেন দুটি বই। একটি
সাঁইভক্তপ্রিয় ‘শ্রীশ্রীসাঁসৎচরিত্র’ (বাংলা এবং হিন্দী) এবং অপরটি শ্রীসাই
জ্ঞানেশ্বরী। প্রথমটা নিয়ে আলোচনা করার কোন মানে হয় না, বরং, দ্বিতীয়টাতে দেখা
যাক, সে বই কতটা ‘মোহমুদগর’, আর কতটাই বা ভক্তিবিলোল কবিকল্পনা।
কিছুদিন আগে ইসরোর একদল বিজ্ঞানী
চন্দ্রযান ৩ –এর সাফল্য কামনা করে তিরুপতি মন্দিরে পূজো দিয়েছিলেন। অন্য অঞ্চলের
কথা জানি না, কিন্তু পশ্চিম বাংলায় অনেক ধিক্কার কিম্বা মিম আমার চোখে পড়েছিল। বিজ্ঞানী
হয়ে এমন কুসংষ্কারাগ্রস্থ! ধর্মের ওপর এমন দুর্বলতা! অর্থাৎ, এই বঙ্গপুঙ্গবেরা মনে
করছেন, বিজ্ঞানী হলে তার ঈশ্বরপ্রীতি থাকাটা বালখিল্যতা। মজার কথা, বর্তমানের
বৈজ্ঞানিক টেকনোলজিকে অবলম্বন করে ‘ঐশ্বরিক’ ব্যবসা যেখানে রমরমিয়ে চলছে,
বঙ্গপুঙ্গবেরা সেখানে পুরোহিতকৃত আনুষ্ঠানিক বিয়েতে কিম্বা পুজো-প্যান্ডেলে
বিরিয়ানি / ফ্রাইড রাইস আর পাঠার ঝোল / আলু কষা সাঁটিয়ে বিজ্ঞানীদের ধিক্কার জানিয়ে
সুখে নিদ্রা দিচ্ছেন!
কেন? আপাতভাবে মনে করা হয়, ধর্মের
সাথে বিজ্ঞানের বিবাদ আছে, কিন্তু মূল লক্ষ্য, আমার মনে হয়, দুজনেরই, সমাজ কল্যাণ।
নীতিভ্রষ্ট বিজ্ঞানী কিম্বা লোভী ধর্মপ্রচারক --- দুজনকেই যদি বাদ দেওয়া যায়,
তাহলে এই দুই ক্ষেত্রের লক্ষ্যের মধ্যে কোন পার্থক্য আছে কি?
“বিজ্ঞান — কিনা বিশেষরূপে জানা। কেউ দুধ শুনেছে, কেউ দুধ
দেখেছে, কেউ দুধ খেয়েছে। যে কেবল শুনেছে, সে অজ্ঞান। যে দেখেছে সে জ্ঞানী; যে খেয়েছে তারই
বিজ্ঞান অর্থাৎ বিশেষরূপে জানা হয়েছে। ঈশ্বরদর্শন করে তাঁর সহিত আলাপ, যেন তিনি পরমাত্মীয়; এরই নাম বিজ্ঞান।" বলছেন
রামকৃষ্ণদেব। তার চোখে, ধর্ম আর বিজ্ঞান --- দুটো অবস্থামাত্র। একজন অন্তরের দিক
থেকে এগোচ্ছেন, আরেকজন বাইরে গতিপ্রকৃতিকে নিখুঁতভাবে অধ্যয়ন করে ‘পরম’-এর সংজ্ঞার
সিদ্ধান্তে আসতে চাইছেন।
ফলে, ভালো করে দেখলে প্রকৃত
ধর্মীয় গুরুরা কিন্তু যে কথা বলেন, সেগুলোকে খুব একটা ফেলে দেওয়ার মতো না। এই
শিরডির সাঁইবাবার কথাই যদি ধরা যায়, তাহলে আমরা দেখব, ভক্তদের প্রতি তার
কল্যাণকামনায় যে কথাগুলো বলা, তা মনস্তাত্বিক দিক থেকে বাস্তবোচিত।
কে এই সাঁইবাবা? তার নিজের কথায়,
“আমার কোন ভিটে-মাটি নেই। আমি মূলত নির্গুণ – আমহী মুলীচ নির্গুণ - কর্মবন্ধনের
কারণে আমি স্থূল পিণ্ড পেয়েছি অর্থাৎ শরীর ধারণ করেছি। এই দেহের ভিতরে এক নৌকা
(আত্মা) রয়েছে। সম্পূর্ণ বিশ্বই আমার গ্রাম – বিশ্ব হেচি গাব নিগুতী – আমার জন্য
এখানকার সমস্ত মানুষজন আমার নিজের। এটা জেনো, আমি সকলের মধ্যে আছি – আমুচে জানা
সর্বথা।”
প্রসঙ্গত, সাঁইবাবাকে আমিও পছন্দ
করতাম না। মিরাক্ল ব্যাপারটার মধ্যেই একটা চালাকির গন্ধ থাকে। কিন্তু, আমার মনে হয়,
মিরাক্লকে সরিয়ে নিলে কারও চরিত্রে যদি মিরাক্লই পড়ে থাকে, তাহলে সেই চরিত্রে
অবশ্যই চালাকি আছে। কিন্তু মিরাক্ল সরিয়ে যদি ভক্তসন্নিধানের কথাপ্রসঙ্গ পড়া যায়,
তখন সেই মানুষটির প্রকৃত উদ্দেশ্য বোধগম্য হয়।
“মোহকে দূর করার জ্ঞান হৃদয়ঙ্গম করো – হে ভলতেচ
বেড্ষা মোহক জ্ঞান।” সাঁই বলছেন নানাসাহেব চান্দোরকরকে, তার এক প্রিয় জ্ঞানী
ভক্তকে। বুদ্ধ বলেছিলেন, “দুঃখ আছে।” সাইঁ বললেন, “সংসারে দুঃখের ভিত অনেক গভীরে
রয়েছে। এর থেকে কারোর নিস্তার নেই – য়াবদ্দেহ তাবত খরা – তাহলে তোমারই বা
পরিত্রাণ কোথায়?” উপায়? গীতা বলছেন, “সুখ দুঃখে সমে কৃত্বা লাভালাভৌ জয়াজয়ৌ।” সাই বললেন, “য়া
সুখদুঃখাচে তরঙ্গ উঠতী। যে যে কাহী আপুল্যা চিত্তী। --- এই সুখ-দুঃখ তরঙ্গায়িত হয়ে
যে কোন মানুষের চিত্তকে আন্দোলিত করে দেয়। এটাই ভ্রান্ত করে। এতএব তার মোহে পড়ো
না।”
বলছেন শিরডীর সাঁইবাবা, শুনছেন
নানাসাহেব চাঁন্দোরকর, আর কাব্যাকারে লিখছেন দাসগণু মহারাজ। শিরডীর বাইরে
সাঁইবাবার সার্থক প্রচার ও প্রসার করেছেন যে মানুষটি, সেই দাসগণু মহারাজের জীবনটি
বড়োই চমকপ্রদ। তৎকালীন ইংরাজীর চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা জানা এহেন মানুষটি
২৩ বছর বয়সে গৃহ থেকে বিতাড়িত হন। হলেন হাবিলদার। নানাসাহেব চাঁন্দোরকর ছিলেন তার
ডেপুটি এবং সাঁইবাবার ভক্ত। অতঃপর সাইবাবার দর্শন মেলে। মুখে মুখে গান বাঁধতে
পারতেন। ফলে পরবর্তীকালে পুলিশের চাকরী ত্যাগ ও কেবলমাত্র সাঁইভজন করেই
স্ত্রীসমভিব্যহারে অবশিষ্ট জীবন কাটে। পাশাপাশি রচনা করেন ঈশোপনিষদের মারাঠী টীকা,
শ্রীসন্তকথামৃত, শ্রীভক্তিলীলামৃত, শ্রীভক্তিসারামৃত, শ্রীসাইনাথস্তবমঞ্জরী
ইত্যাদি বই। শেষ চারটে বইয়েরই আংশিক সংকলন এই ‘শ্রীসাই জ্ঞানেশ্বরী’। সংকলক রাকেশ জুনেজা।
বাংলা ভাবানুবাদ করেছেন নারায়ণ রাও। বানানের বিস্তর ভুল বাদ দিলে, মারাঠী হরফে
লেখা কাব্য ও তার বাংলা অনুবাদ সাইবাবার সার্থক চরিত্রায়ণ বললে ভুল বলা হবে না।
এখানে মূলত সাঁই-ভক্ত কথোপকথন
আছে। আছে মোট নটি অধ্যায়। প্রথম তিনটি অধ্যায় পড়লে মনে হয় যেন, গীতা পড়ছি।
নানাসাহেবের সাথে সাঁইবাবার এই পর্ব প্রশ্নোত্তর পর্ব। জীবনের জটিল এবং গহীনের
আলেখ্য।
“ত্রৈসে প্রত্যকানে বাগাবে –
প্রত্যেক ব্যক্তিরই ভাল ব্যবহার করা উচিৎ। নিজের কর্তব্যের ভালভাবে পালন করতে হবে।
... মন্দ লোকেদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলো। ... যো বরী জিবাচে অস্তিত্ব। তো বরী ত্যা
জপনে সত্য। - মানুষের এই জীবন থাকা পর্যন্ত দেহের ভালোভাবে যত্ন নাও। মৃত্যু
অবধারিত ... এর জন্য শোকার্থ হওয়া বৃথা। ...।”
সাংঘাতিক বাস্তবের কথা বলছেন
তিনি, “প্রতিটা কাজের জন্য ধন এক জরুরী মাধ্যম, কিন্তু কেবল তাতেই মনকে লিপ্ত রাখা
ঠিক নয়। ... প্রয়োজনের অতিরিক্ত উদার হওয়া কোন কাজের নয়। ... একবার যদি তোমার
টাকা-কড়ি হাত থেকে বেরিয়ে যায় – কোনী ন বিচারী মাগুনী – তাহলে কেউ তোমাকে তোয়াক্কা
করবে না। হাত পাতলে কেউ কানাকড়িও দেবে না। উদারতার সঙ্গে বাড়াবাড়ি হলেও বিপদ – একে
ঠিকাণী ঘাতলয়া পূর্ণ – দুটো একসঙ্গে হওয়াতে অনর্থও ঘটতে পারে – হোঈল বাপা অনর্থ।”
দান করবে, কিন্তু ধার করে কখনই নয়। যেমন সামর্থ্য তেমনই।
সাঁই কখনও বাড়াবাড়ি পছন্দ করতেন
না। বলতেন ঈশ্বর সত্য, জগৎ মিথ্যা-মায়া। সাবধান হতে বলতেন কিন্তু সবকিছু ত্যাগ করে
ফকির হয়ে যেতে বলতেন না। বরং মোহ ত্যাগ করতে বলতেন। “মহনুন ত্যা ধরমশালেচা – এই
সংসার একটি ধর্মশালা। এতএব তুমি নিজের পারিবারিক কর্তব্যের পালন করো, আর এর
কৃতিত্ব ঈশ্বরকে দাও – করত্তিত্ব ঈশ্বরা ধ্যাচে – নিজের জ্ঞান কাজে লাগাও।
ভালো-মন্দ লোকেদের ভাল করে বাজিয়ে দেখো। মুক্ত থাকো। মুক্ত থাকাই মোক্ষের সাধন, হে
চান্দোরকর – মুক্ত স্থিতি চাঁন্দোরকরা।”
সংসার করবে কেমন করে? “রমাবে
স্বস্ত্রীশী সর্বথা – স্ত্রী ভিন্ন অপরাপর রূপবতীকে দেখে মনে বিকৃতি বা কামেচ্ছার
উদ্রেক হতে দিও না । কামকে বশে রাখ। কামের গোলাম হয়ে যেও না।” কিভাবে? “বিবেকাচে
লোঢ়নে জান – কামের গলায় বিবেকের কণ্ঠি পরিয়ে দাও। যতটা প্রয়োজন, ততটাই প্রশ্রয়
দাও।”
আমার মনে হয়, ভারতীয়
দৃষ্টিভঙ্গীতে নারী চিরকালই সেবার প্রয়োজনে ব্যবহৃত। মনুসংহিতার এই অমোঘ নিদানের
কোন সন্তই বিরোধিতা করেননি। সাঁইবাবার কাছেই নারী তাই সেবার উদ্দেশ্যেই পরিবারে
নিয়োজিত থাকবেন এবং নম্র থাকবেন – নিজ পতীচি করনে সেবা। হা স্ত্রিয়াঞ্চা ধর্ম বরবা
– স্ত্রীর জন্য পতিই দেবতা। পতি কুপিত হলেও যে স্ত্রী নম্র থাকে, পতির দৈনিক কাজে
সহযোগীতা করে, এমন স্ত্রী ধন্য – পতী কোপী নম্রতা ধরী। প্রপঞ্চাত সাহ্য করি। তীচ
হোয় ধন্য নারী। মানছি, ভারত পুরুষতান্ত্রিক। কিন্ত তা বলে যে স্বামী অন্যায় আচরণ
করে, মর্যাদা উল্লঙ্ঘণ করে, তার সামনেও নম্রতা দেখানোর এই সনাতন নীচতার শেষ কবে
হবে? পতী সকাম পাহুনী। তৎপর রাহাবে স্ত্রিয়াঁনী – পতির সকাম ইচ্ছে (দৈহিক বা
সাংসারিক) পূর্ণ করার জন্য স্ত্রীকে সর্বদা তৎপর হওয়া চাই। এমন স্ত্রী-ই নাকি
গৃহলক্ষ্মী – গৃহলক্ষ্মী জানাবী। সত্য সেলুকাস... ইত্যাদি ইত্যাদি।
সাঁইবাবা জীবনকে দেখতে চেয়েছেন
মধ্যমপন্থায়। বলতে চেয়েছেন, সব কর্তব্য করবে, কিন্ত মন রাখবে ঈশ্বরে। কে এই ঈশ্বর?
“যিনি জগতের আধার, যিনি চর-অচর সবেতে ব্যাপ্ত আছেন, যিনি নিখিল ব্রহ্মাণ্ডকে ঢেকে
রেখেছেন এবং শেষ পর্যন্ত এই জগত যার মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। তিনি যে সম্পূর্ণ
সৃষ্টির আদি-মূল, তিনি পরম উজ্জ্বল, বিশুদ্ধ চৈতন্য (ঈশ্বর), তিনিই সত্য।” তাকে
প্রাপ্তির সাধনপথ কি? এক, বিবেক; দুই, বৈরাগ্য; তিন, শমদমাদি ছয় বৈশিষ্ট্য – শম,
দম, তিতিক্ষা, উপরতি, শ্রদ্ধা এবং সমাধান।
বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে
বহুদূর। আমি কি সাঁইবাবাকে বিশ্বাস করি? জানি না। তার সব কথা মানতে পারি না।
কিন্তু মহারাষ্ট্রে এক গণ্ডগ্রামের এক গণ্ডসময়ে একদম সরল সহজ মানুষদেরকে জীবনধারার
যে সরল পথ তিনি দেখিয়েছিলেন, হিন্দু-মুসলমান এক করার প্রচেষ্টা করেছিলেন, ধর্মের
নামে মোহ জাগাতে দেন নি, তার কাছে এসে প্রণত হতেই হয়। আজও শিরডীতে সাইঁদর্শনের যে
লাইন, সেখানে একজন হিন্দু সদ্যদম্পতির সামনে সদ্যোজাত মুসলমান মাতাকে দাঁড়িয়ে
থাকতে দেখা যায়, শুনেছি। মুসলিমের হাতের গোলাপ আর হিন্দুর হাতের গাঁদার মালা ---
দুটোই সাইবাবার পায়ে স্থান পায়। কোন অসূয়া নেই, কোন দ্বন্দ্ব নেই। সাঁইবাবা
দুজনেরই - হিন্দু আনি য়বন। হে শাব্দিক ভেদ অসতী জান। / য়াচে মহত্ব মহন্ধন।
সাধকানেঁ মানু নয়ে। - হিন্দ ও মুসলমান, দুই জাতির লোকেদের সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর তো
একই। হিন্দু ও মুসলমান তো কেবল শব্দগত বিভেদ। ঈশ্বরে আস্থাবান ভদ্রলোকেরা ও সাধক
এমন তুচ্ছ ভেদাভেদকে আমল দেন না।
আজ, এই পরম সময়ে, এই হিন্দু-মুসলমান
দ্বন্দ্ব, খেলার মাঠে হোক, কিম্বা ধর্মের রণাঙ্গনে, সমাপ্ত হওয়া বড়োই প্রয়োজন।
=========================
শ্রীসাই জ্ঞানেশ্বরী
দাসগণু মহারাজ, রাকেশ জুনেজা, নারায়ণ রাও
শ্রীসাই সুমিরণ ট্রাস্ট
মুদ্রিত মূল্যঃ ২৫০/-
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা
Comments
Post a Comment