দ্য সাবজেক্ট

 




প্রতিবারের মতো এবারেও পুজো-প্রস্তুতি নিয়েছি বেশ কয়েকদিন ধরে। বাড়ি থেকে অনেক দূরে একটা নতুন বিউটি পার্লার খুলেছে, নামকরা। সক্কাল সক্কাল ভরপেট আলুভাতে খেয়ে দুই বন্ধুনী সহযোগে সেখানে গিয়ে ধরনা দিয়েছি, এবং সব কমপ্লিট করে সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরে মায়ের বকুনি খেয়েছি।

      ষষ্ঠীর দিন সন্ধ্যেবেলা যখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যখন প্রাণপনে শাড়ীর কুঁচি সামলাচ্ছি, ভাই একবার উঁকি দিয়ে বেরিয়ে গেল, তার গলার আওয়াজ কানে এসে ধাক্কা মারল, পুরো চল্লিশ মিনিট হয়ে গেছে রে... আর কতক্ষণ? ভাই আমাকে প্যান্ডেলে ছেড়ে দিয়ে ফটোগ্রাফি করতে যাবে মণ্ডপে মন্ডপে। আমি ‘আর একটু’ বলে নিজেকে ঘুরিয়ে বাঁকিয়ে দেখে নিলাম মনবসমান আয়নাতে। এবং তখনই মাথায় একটাই প্রশ্ন ধাক্কা মারল।

কেন?

এত সাজ কিসের কারণে? আমাকে যাতে খুব সুন্দরী দেখায় সেই কারনেই তো! কিন্তু কেন? তার জন্য এতদিনের প্রস্তুতির কারন কি?

উত্তর একটাই। আমি ‘সাবজেক্ট’ হতে চাইছি। আমার আগের জেনারেশান মানুষের চোখে সাবজেক্ট হতে চেয়েছিল। আমি ক্যামেরার লেন্সের চোখে সাবজেক্ট হতে চাইছি।

ক্যামেরার সর্বগ্রাসী ক্ষুধার সামনে আমরা সবাই সাবজেক্ট। এমনকি ফটোগ্রাফার নিজেও। তারা সাবজেক্ট খোঁজে। তারা অবজেক্ট খোঁজে না। তাদের ক্যামেরার লেন্স নিজের অন্তরের দৃষ্টিকে খোঁজে না। তারা কেবল সাবজেক্টগামী। অবজারভার অবজার্ভ করতে চায় না। অবজারভার নিজেই এখন সাবজেক্ট। আর সেই অবজার্ভড সাবজেক্টের মধ্যে ব্যাক্তিগত দুনিয়াও এসে ঢুকে পড়েছে, মনুষ্যত্ববোধ এসে ঢুকে পড়েছে, জীবন আটকে গেছে।

ক্যামেরার লেন্সের বুভুক্ষার কাছে গণেশজননী দুর্গা আর ইজরায়েল কিম্বা প্যালেস্তাইনবাসী মৃতপুত্র কোলে দুর্গার কোন পার্থক্য নেই; লেন্সের কাছে রেড লাইট এরিয়ার একাকী বেশ্যা আর কয়েকশো বছরের পুরোনো বনেদী ঘরের ভাঙাচোরা নিঃসঙ্গ কেদারার পার্থক্য নেই; তার কাছে মিনি স্কার্ট পরা টিন এজ কন্যা আর একবেলা খেতে না পাওয়া অর্ধনগ্ন ভিখারিনীর কোন পার্থক্য নেই; পার্থক্য কেবল আলো-ছায়ার ম্যাজিকে। পার্থক্য এডিটিং-এর মায়ামত্ততায়। কে কোন সাবজেক্টকে কতোটা এই মায়া-ম্যাজিকের মধ্যে ফেলতে পারছে এ যেন সেই কুশলতার তীব্র হিন্দোলিত প্রতিযোগীতা। সেই ম্যাজিক-রিয়েলিজম দর্শকের মনের মধ্যে বিস্ময় সৃষ্টি করে। সেই ছবি আমাদেরকে সাবজেক্ট করে ফেলছে। সেই ছবির কাছে যেন অগ্নিপরীক্ষা, সে আমাদের চোখকে কতটা টানতে পারল। কতক্ষণ টানতে পারল। এর মধ্যে মমত্ববোধ নেই, সৌন্দর্যবোধ নেই, আত্মিক টান নেই, বোধের পারে যাওয়ার বাঞ্ছা নেই, আছে কেবল সংখ্যাতত্ত্বের দুরন্ত সর্বগ্রাসী লোভ।

সিনেমা হলে সিনেমা আমাদের সাবজেক্ট নয়, আমরা সিনেমা দেখতে গিয়েছি --- এটা সাবজেক্ট; যে পাঞ্জাবীতে আমার হতভাগাকে অপরূপ লাগছে তাকে মুগ্ধ হয়ে দেখতে চাওয়াটা সাবজেক্ট নয়, তাকে নিজের স্মার্টফোনের চৌকো 9:16 অনুপাতের ডিজিটাল আউটপুটে নিয়ে আসার রমণীয় প্রচেষ্টা আমার সাবজেক্ট; আমার ভাই দেবী দুর্গাকে পেছনে রেখে আমার মায়ের সিঁদুরখেলার ছবি তুলবে না, সে প্রাণপণ চেষ্টা করবে, পিছনের দুর্গার চোখের মণি যেন আমার মায়ের দিকে ফেরে, আর আমার মায়ের চোখের ভাষা দেবীদুর্গার চোখের ভাষার সাথে মিলেমিশে যায়। তখনই ক্যামেরার ক্ষিধে মিটবে। সাবজেক্ট তৈরী হবে।

সারা দুনিয়াই কি সাবজেক্টের পেছনে দৌড়চ্ছে? যে ফোটোগ্রাফার অসামান্য দক্ষতায় কোমর জলে নেমে তর্পণের ছবি তুলে আমাদের সামনে আনছে, তার উদ্দেশ্য কি? সাবজেক্টের অমোঘ আকর্ষণ কি তার ছবির মধ্যে তর্পণের সনাতন রীতিকে দেখাতে চাইছে, না কি তর্পণকারির নিঃসঙ্গ বেদনার কথা জানাতে চাইছে, না কি এই জানাতে চাওয়াটাও সাবজেক্ট? সে আসলেই কিছু চাইছে না। না নিজে কিছু জানতে চাইছে, না কাউকে জানাতে চাইছে। তর্পণকারির বেদনাবোধের জন্য তার কোন দায় নেই, তর্পনকারীর ‘বেদনা’ নামক এক আবেগকে সাবজেক্ট করার লোভ থেকে সরে আসার পথ সে খুঁজতে চাইছে না।

সাবজেক্ট, সাবজেক্ট, সাবজেক্ট। যেদিকেই তাকাই আমি এখন সাবজেক্ট দেখতে পাই। পাঁচ হাজার টাকার ফোন থেকে শুরু করে ষাট হাজার টাকার ফোনের উদ্দেশ্য একটাই --- সাবজেক্ট। ছবি আজ আর কথা বলছে না। আমাদের আবেগকে, বিস্ময়কে, বোধকে কথা বলাতে চাইছে, যা কি না হৃদয়ে হৃদয়ে স্পর্শ করে। যে কারণে মানুষ মানুষের হাত ধরে, আজ সেই কারণকে সরিয়ে দিয়ে মানুষ আর মানুষের মাঝখানে লেন্স এসে পড়েছে।

দুর্গাপুজো শেষ হবে দুদিন বাদে। দুর্গার রমণীয় মুর্তি থেকে মাকালীর নগ্ন আবক্ষ মুর্তির মাঝে মাত্র কুড়ি দিন পড়ে থাকবে। লেন্সকে নতুন করে প্রস্তুত হতে হবে। নগ্নতাও সাবজেক্ট। অর্ধনগ্নতাও সাবজেক্ট। পুর্ন নগ্নতাও সাবজেক্ট। আর এই সাবজেক্টের মধ্যে সমগ্র পৃথিবী ঢুকে রয়েছে, ঘুমিয়ে পড়ছে। এমনকি আমিও...

আমিও সাবজেক্ট খুঁজি। পরবর্তী কলাম লেখার...

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে