তবে আজ কীসের উৎসব?

 



মোটামুটিভাবে আমাদের এদিকেও দুর্গাপুজা শুরু হয়ে গেল। চিরাচরিত রীতি হিসাবে বলা যায়, ঢাকে কাঠি পড়ে গেল। যদিও, ঢাকী মন্ডপে এখনও এসে পৌছোয় নি। আমাদের এখান থেকে অনেকটা দূরে কল্যাণী। শুনেছি, ওখানকার এক মণ্ডপে ঠাকুর দেখতে এত ভীড় হচ্ছে যে, ট্রেনে ভিড়ের চাপে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করা মানুষদের নাভিশ্বাস উঠছে। সম্ভবত একটি বাচ্চা ট্রেন থেকে পড়ে মারাও গেছে।

সেখানেই যখন এই অবস্থা, কলকাতায় তখন কি? টিভিতে চোখ পড়লেই হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি। রাস্তা বন্ধ। ট্রাফিক জ্যাম, তাতে এম্বুলেন্স আটকে রোগীর নাভিশ্বাস। মাইকের দাপটে কানে কানে কথা বলাটাও চ্যালেঞ্জ। স্কুল-কলেজে পড়া ছাত্র ছাত্রীদের অনেকেই এই ভীড়ের মধ্যে স্কুলে যাওয়াটা নিরাপদ মনে করছে না। আর ডেলি প্যাসেঞ্জারদের অনেকেই, মোটামুটিভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে যে, তারা ওয়ার্ক ফ্রম হোম করবে, আমার হতভাগা তাদের মধ্যে একজন।

আমাদের আশেপাশের বেশিরভাগ প্যান্ডেলে এখনও দুর্গা আসেননি, অথচ লাইটিং নিখুঁতভাবে সাজিয়ে ফেলা হয়েছে। অনেক রাত্রে যে রাস্তা দিয়ে, অন্তত আমরা মেয়েরা, একা কিম্বা দু-তিনজন মিলেও যেতে ভয় পেতাম, আলো ঝলমলে সেই রাস্তাই এখন চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। প্যান্ডেল সম্পূর্ণ। মুর্তি নেই। ঝাড় লন্ঠন আছে। যজ্ঞবেদী তৈরী হয় নি। শূন্য চেয়ার সারিবদ্ধভাবে সাজানো আছে। লোকজন আসছে-যাচ্ছে-সেলফি তুলছে। মন্ডপে প্রান প্রতিষ্ঠা হচ্ছে না। কয়েকটা জায়গায় মাইক তারস্বরে বাজতে শুরু করে দিয়েছে। এলাকার মানুষজন বিরক্ত হচ্ছে। কিন্তু প্রতিবাদ মতো দুঃসাহস দেখাতে পারছেন না।

অথচ আজ তৃতীয়া!

      হঠাৎ করেই ষষ্ঠী থেকে শুরু হওয়া উৎসব মহালয়াতে শিফ্‌ট করে গেছে। বেশিরভাগ বাঙালীই তাতে ঝাপিয়ে পড়েছে। অর্থাৎ, এই এগিয়ে আসা উৎসবে যে পরিমাণ উৎসাহের সাথে যোগদান করে তারা ভীড় বাড়াচ্ছে, এবং জঞ্জাট বাড়াচ্ছে, এবং ধর্মীয় সংস্কৃতির উদারতাকে রিল ও সেলফি/গ্রুপফি সহযোগে সোশাল নেটওয়ার্কে ফাটিয়ে পরিবেশন করছে, তাতে করে মনে হচ্ছে না যে, ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়।

আমরা অনেকেই জানি না, Global Hunger Index Rank-এ ভারত 111 নম্বরে, 125টি দেশের মধ্যে! অনেকেই জানি না, পাকিস্থানের মানুষ আমাদের থেকে কম ক্ষুধার্ত। অথবা আমরা জানতে চাইছি না। আগ্রহী নই।

আমি পড়ুয়া মেয়েমানুষ। বইয়ের গ্রুপে পূজাবার্ষিকী আর হেমেন্দ্রকুমার নিয়ে খুব চাপান উতোর হচ্ছে, কিন্তু, ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন কনফ্লিক্টের ওপর কোন বই নিয়ে আলোচনা হচ্ছে না। শিলাজিতের একটি গান ফাটিয়ে বাজছে, “সুকনা পেটে মাল পড়লে মিনুও মন্দাকিনি”, কিন্তু আমরা মনে রাখতে চাইছি না, মণিপুরে, নিদেনপক্ষে আমাদের ঘরের আশেপাশেই অনেক মিনুর ধর্ষিত লাশ পাটক্ষেতে কিম্বা ছয় ফুট মাটির নীচে চাপা পড়ে আছে, এই মুহূর্তে অনেক লাশের ওপর মদ্যপ হাতের কয়েকটি কোদাল ঝুরঝুর করে মাটি ফেলছে।

সমস্ত সমাজটা কি ডিপ্রেশনে চলে যাছে? গভীর গম্ভীর এক একাকীত্ব, যার থেকে বেঁচে থাকার পথ হয়ে উঠছে উৎসব?

      আমরা আস্তে আস্তে ফসিলস হওয়ার পথে চলেছি, আমাদের ভাষাটার মতো। চাকুরিজীবি চাকর বাঙালি কি এতটাই ফ্রাস্ট্রেশানে চলে গেছে যে, পাঁচদিনের পূজো এখন মদ-মাংস-মেয়েছেলে সহযোগে পনেরোদিনে এসে ঠেকাতে চাইছে? নিজেরাই নিজেদেরকে কতটা অন্ধকারে নিয়ে এসে ফেললে পরে একটা বারোয়ারি পুজোকে চোখ ধাঁধাঁনো ডিস্কো থেকের মতো করে ফেলতে চাওয়া যায়, যেখানে মানুষ গেলে একটা মত্ততা নিয়ে বাড়ী ফেরে, আর ভুলে যায়, তার অনেক কিছু করার ছিল, সমাজের জন্য অন্যরকম কিছু ভাবনার প্রয়োজন ছিল, যে ভাবনাটা একসময় ভেবেছিলেন মহাশ্বেতা দেবী কিম্বা ঋত্বিক ঘটক!

      আজ তবে কীসের উৎসব? নিজেকে ভোলার, না কি নিজেকে আরও অন্ধকারে নিয়ে যাওয়ার? প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে মুর্তি দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু কোথাও দুর্গা দেখতে পাচ্ছি না।

কেন?

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে