এ কোন রবীন্দ্রনাথ?
এক-একটা সময়
আমার মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ আস্তে আস্তে কেমন করে যেন, আমার জীবনে, এক অন্তহীন পথ
হয়ে যাচ্ছেন। আর সেই পথের ধারে ধারে কতই না পসরা! কি চাই, আছে তাই।
গুরুগম্ভীর রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শপিং মল থেকে শুরু করে তার মুখে চুনকালি দেওয়ার
উদগ্র আগ্রহে পথের ধারে প্লাস্টিক পেতে বসে যাওয়া ফুটপাথের বেসাতি - আমি দেখি। তা
বলে সেখান থেকে টুকরো টুকরো রবীন্দ্রনাথকে আমার জীবনে জুড়ি না। আমার রবীন্দ্রনাথকে
নির্মাণ করি তার রচনাবলী থেকে, তার পত্রাবলী থেকে; কণিকা-সুচিত্রা-সুবিনয়-দেবব্রত কিম্বা
বন্যা-অদিতি-বিক্রম-লিজা-র গায়কী থেকে। এদের হৃদয়ের রবীন্দ্রনাথকে আমি দেখি,
বিস্মিত হই। যে নির্জন এককের পথিক রবীন্দ্রনাথ নিজে হতে চেয়েছিলেন, আমি
সেই নির্জন এককের রবীন্দ্রনাথকে বারংবার ফিরে পেতে চাই।
তবে এই বই
নিয়ে কথা বলা কেন? পসরার দু-একটা জিনিস কিনে ঘর সাজানোর ব্যাপার আর কি।
রবীন্দ্রনাথ দিয়ে দিব্যি ঘর সাজানোও যে যায়! কেন সাজাবো না তাকে? অবশ্যই সাজাবো।
কিন্তু সেটা যে সাজ, সেটা আমার সজ্জা নয়, মনে রাখব। তেমনই পসরার এক টুকরো, যা আমার
হাতে এসে উঠেছে, চিন্ময় গুহের রবীন্দ্রনাথ। সুরের বাঁধনে : রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে।
এই বইয়ের
বিষয়বস্তু পড়লে হঠাৎ করে মনে হতেই পারে, রবীন্দ্রসঙ্গীতেরই বুঝি বা প্রাধান্য।
কিন্তু, “আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ সুরের বাঁধনে”–র অর্থ চিন্ময় গুহের
কাছে “রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমার কয়েকটি ব্যক্তিগত ভাবনা, কয়েকটি নিভৃত তুলিটান এখানে
অঞ্জলীতে ধরা রইল।” এই তুলিটানে কি উঠে এসেছে অন্য এক রবীন্দ্রনাথ? যে
রবীন্দ্রনাথকে আমরা পেয়েছি ‘বিন্দু থেকে বিন্দুতে’-র দ্বিতীয় পর্বে? কিম্বা
অন্যান্য রচনার কোনায় কোনায় আমরা চিন্ময় গুহের যে রবীন্দ্রনাথের কথন পেয়েছি তারই
আভাস রয়েছে কি এখানে?
বস্তুত একদম
পকেট বইয়ের আদলে বানানো এই বইটিতে যে ‘সাতরঙা ময়ূরপঙ্খী’রূপী রবীন্দ্রনাথের কথা
বলা হচ্ছে, রাণু কিম্বা রম্যাঁ রল্যাঁ-র সেই রবীন্দ্রনাথই এসেছে, রূপে রূপান্তরে। এছাড়াও
এখানে পাচ্ছি রবীন্দ্রনাথে মুগ্ধ কিছু দেশী এবং বিদেশি মানুষ। চিন্ময় গুহ রামধনু
বুনেছেন তাদেরই মনের রঙীন বিস্ময়ের আলোকচ্ছটার অভ্যন্তরীণ পূর্ণ প্রতিফলনে
বিচ্ছুরিত সাতরঙ্গা রামধনুরূপ রূপচ্ছটায়।
‘আকাশপ্রদীপ’
শীর্ষক প্রথম প্রবন্ধটিই বস্তুত চিন্ময় গুহের রূপবান রবীন্দ্রনাথ। “আজ ভোরে তাঁর
মুখ একেবারে রামকিঙ্করের ভাস্কর্য। না কি জেকব এপ্স্টাইনের ব্রোঞ্জ প্রতিমূর্তি?
এমনও হয়? মানব-মৃত্তিকা দিয়ে তৈরি এমন আশ্চর্য রূপ কেউ দ্যাখেনি কোনও দিন, লিখেছেন
স্যাঁ-জন পের্স। মনে রাখার মতো কথা।” চিন্ময় গুহের এই রবীন্দ্রনাথ উড়াল দিয়ে যখন
শেষ পর্যায়ে আসে, তখন হয়ে ওঠেন তার রবীন্দ্রনাথ। ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক
কথোপকথনে তিনি বলেন, “আমি ইংরেজি পড়াতে গিয়ে যে রবীন্দ্রনাথকে দেখেছি, আবার অন্য
ভাষাভাষী বন্ধুরাও আছেন, স্প্যানিশ ভাষাভাষী বন্ধুরা যেভাবে রবীন্দ্রনাথকে
দেখেছেন, বা চিনা বন্ধুরা যেভাবে রবীন্দ্রনাথকে দেখেছেন, ফরাসি বিশ্ব যেভাবে
রবীন্দ্রনাথকে দেখেছে, আমি তার মধ্যে একটা অন্তর্নিহিত সাযুজ্য খোঁজার চেষ্টা করে
যাচ্ছি। এবং এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই এঁদের প্রত্যেকের দেখার ধরনটা আলাদা।” যদিও
এখনও পর্যন্ত ওনার প্রায় কোন রবীন্দ্র-লেখাতেই স্প্যানিশ কিম্বা চীনা বন্ধুদের
উল্লেখ পাই না।
শেষ
পর্যায়ের কথোপকথনটা ইম্পর্টান্ট, আরেকটা কারণে। এখানে অজান্তেই চিন্ময় গুহ,
ব্যক্তিগত চিন্ময় গুহ ধরা দিয়েছেন। মানে যেভাবে তার কর্মক্ষেত্রে রবীন্দ্র
পরিবেশের মধ্যে দিয়ে এক রূপ নিয়েছে রবীন্দ্রখোঁজ এবং সেখান থেকে রবীন্দ্রবীক্ষণে
তার লেখন, আমি তার কথা বলছি। রবীন্দ্রনাথ কখন যেন তার কাছে দায়বদ্ধতা হয়ে
দাঁড়িয়েছে। এবং সেই দায়বদ্ধতার মাঝে অক্লান্ত কিছু কাজ যেন তার জীবনাঞ্জলী। সেই
জীবনাঞ্জলীর মধ্যে দিয়ে জীবন দেবতা যখন রবীন্দ্ররূপে আত্মস্থ হয়, তখন রঞ্জন
বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত বলে ওঠেন, “এইটাই বোধহয় চিন্ময়ের রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে শেষ
কথা : anchor. রবীন্দ্রনাথ যেমন আমাদের anchor,
আমাদের আশ্রয়। তাই তো!”
এবার একটু
অপ্রিয় প্রসঙ্গে আসা যাক। মাত্র ১০৪ পৃষ্ঠার বই। আটটি প্রবন্ধ। একটি কথোপকথন। মোট
৯৩ পৃষ্ঠা। এই বইটিতে ‘কেয়াফুলের কেশর’ নামক প্রবন্ধটি ‘গাঢ় শঙ্খের খোঁজে’ বইয়ের
‘মালতী-লতার আকাশ’ প্রবন্ধেরই একটু অন্যতর মার্জিত রূপ। অন্যদিকে ‘যেথায় রাত্রির
অবসান’ নামক প্রবন্ধটি ‘চিলেকোঠার উন্মাদিনী’ গ্রন্থের ‘সুরের বাঁধনে : রবীন্দ্রনাথ ও স্যাঁ-জন পের্স’ নামক প্রবন্ধটির অপরিবর্তিত রূপ।
‘পূর্বভাষ’–এ এই দুটির কথাই তিনি বলেছেন কি? যদি এই দুটিই হয়, তাহলে, মোটামুটিভাবে
বলা যায় প্রায় কুড়ি পৃষ্ঠার দুটি প্রবন্ধ আমার আগেই পড়া হয়ে গেছে। আমি অনায়াসেই
বলতে পারি, এই কটা পৃষ্ঠা আমার কাছে অপ্রয়োজনীয়। অন্যদিকে, আমার নিজের মতে, একটু
ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, ‘চিলেকোঠার উন্মাদিনী’ নামক বইয়ের রম্যাঁ
রলাঁ-কে নিয়ে লেখা প্রবন্ধদুটো এবং পরিশিষ্টের একটি চিঠির অধিকাংশ মূলভাবগুলিকে
সংঘবদ্ধভাবে সাজিয়ে একটু নব আঙ্গিকে ‘মুছে যাওয়া সংলাপঃ রবীন্দ্রনাথ ও রম্যাঁ
রলাঁ’ প্রবন্ধটি পুণর্নির্মিত বললে অত্যুক্তি হবে না। পাঠকমাত্রেই যদি একটু চোখ
বুলিয়ে নেন তাহলে মনে হবে না, নতুন কিছু পড়ছি, মনে হবে, একই কথা একটু অন্যরকমভাবে
পড়ছি। সেক্ষেত্রে কিন্তু, প্রায় তিরিশ পৃষ্ঠা আমার কাছে বর্জিত। তাহলে? আসলেই
মাত্র ৪৩ পৃষ্ঠা আমার কাছে নতুনভাবে ধরা দিয়েছে। যদিও আদ্রেঁ জিদের প্রবন্ধটির
কিছু কিছু ঘটনাও অপরিচিত নয়, চিন্ময় গুহের বিভিন্ন লেখায় তা উঠে এসেছে আগেও।
এই প্রসঙ্গ
আনার কারণ কি? ‘ঘুমের দরজা ঠেলে’, ‘হে অনন্ত নক্ষত্রবীথি’, ‘চিলেকোঠায় উন্মাদিনী’
কিম্বা ‘গাঢ় শঙ্খের খোঁজে’ নামক চারটি প্রবন্ধগুচ্ছে রবীন্দ্রনাথ অনেকবার এসেছেন।
সেগুলোও যদি এখানে সংকলিত হত, তাহলে অনায়াসে বলা যেতে পারত রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এক
সম্পূর্ণ সংকলন হয়েছে। তার সাথে নতুন চারটি প্রবন্ধ যুক্ত হয়ে একটি সম্পূর্ণ
রবীন্দ্রবোধ হিসাবে বইটি প্রকাশ পেলে একটা কোথাও সামগ্রিক অর্থ দাঁড়াত। কিন্ত ওই
চারটি প্রবন্ধের মধ্যে একমাত্র রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’
শীর্ষক কথোপকথন ছাড়া আর কিছু এই বই থেকে সত্যিই পাওয়ার নেই। মানে, যারা ওই চারটি
বই কিনেছেন, পড়েছেন, সমৃদ্ধ হয়েছেন, তাদের কাছে এই বইয়ের প্রবন্ধগুলির মূল্য
অনেকটাই কমে গেছে, এবং এতে হতাশাই গাঢ় হবে। এমনকি তার একান্ত রবীন্দ্রনাথ, যা
‘বিন্দু থেকে বিন্দুতে’ শীর্ষক বইটিতে প্রবন্ধ-গুচ্ছাকারে পাওয়া গেছে, সেরকমও যদি
কিছু লেখা থাকত, যা তার একান্ত অনুভূতি (প্রসঙ্গত, এই বইয়ের প্রথম লেখাটা সেদিকেই
এগোচ্ছিল, কিন্তু...), তাহলেও তা একাডেমিক না হয়ে অনেকটা তার মৌলিক অনুভূতির এক সমৃদ্ধতর
নির্মাণ হতে পারত।
অথবা, যদি
তার এযাবৎ সমস্ত রবীন্দ্র-প্রবন্ধগুলো থাকত, তাহলেও, তার রবীন্দ্র চিন্তনের
সম্পূর্ণ একটা রূপরেখা আমাদের কাছে চিত্রিত হলেও হতে পারত, যা সে অর্থে মূল্যবান
হয়ে উঠতে পারত। কিন্তু এইভাবে ‘না ঘর কা, না ঘাট কা’ টাইপের বইটির নির্মাণের
আসলেই যে ঠিক প্রয়োজন ছিল কি না, তা নিয়ে বিতর্ক থেকেই যায়।
====================
সুরের
বাঁধনে : রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে
চিন্ময় গুহ
পরম্পরা
প্রকাশন
মুদ্রিত
মূল্যঃ ১৫০ টাকা
ছবি
কৃতজ্ঞতাঃ ইন্টারনেট ও সমর্পিতা
Comments
Post a Comment