বিন্দু বিন্দু গরলামৃতের মন্থনকলস

 


আমাদের প্রতিদিনের জীবনে যে-প্রযুক্তিকে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করি আমরা, অথচ আলাদা করে মনেও রাখি না, সেটি ওই আয়তক্ষেত্রটি। মানবভাবনা আর তথ্যের সেই আধার, যা অধিকাংশ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের চেয়েও গভীরভাবে মানবসভ্যতাকে বদলে দিয়েছে। আমাদের ধী-অস্তিত্বের প্রথমতম ঋণ তো বইয়ের কাছেই।

‘ঘুমের দরজা ঠেলে’ থেকে শুরু করা যাত্রাপথের যত প্রান্তসীমায় এসে পৌছচ্ছি, দেখতে পাচ্ছি, চিন্ময় গুহের লেখার প্যাটার্নের শক্তিশালীতা। ‘বিন্দু থেকে বিন্দুতে’ নামক বইটিতে তার লেখনভঙ্গী যেন পূর্বাপর আর অপরাপর সমস্ত লেখনশৈলীকে ছাপিয়ে এক আধুনিক রূপ নিয়েছে অনেক বেশি সহজতার মধ্যে দিয়ে পাঠকের মনের ভাষার সাথে ওতপ্রোত হয়ে জড়িয়ে থাকার ইঙ্গিত দিয়েছে। শুধু তাই নয়, এই পর্যায়ে যে আটটি পর্বে ভাগ করে বইটির পূর্ণাঙ্গ রূপদান তিনি করেছেন, তা অনেকটাই সার্থক। এমনকি, কৃষ্ণেন্দু চাকী-কৃত বইয়ের প্রচ্ছদের গভীরতা আমাকে বিস্মিত করেছে।

চিন্ময় গুহের ভাষা-ব্যবহার নিয়ে দু-একটা কথা বলার আছে। তার ভাষার আঙ্গিক যেন সুররিয়েলিজ্‌মের মধ্যে দিয়ে গেছে। এটা ‘ঘুমের দরজা ঠেলে’ থেকেই স্পষ্ট। সুররিয়েলিজমের যে মূর্চ্ছনা জীবনানন্দ সহ যে কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক বাঙলায় রূপদান করতে চেয়েছিলেন, চিন্ময় গুহ কি তারই উত্তরসূরি? এই রূপ শুধু মুগ্ধই করে না, সাহিত্যের ভাষার আঙ্গিকের যে দ্যোতনায় বিশেষত ফরাসী সংস্কৃতিকে ধরা সম্ভব, তাদের বোধের উচ্চতায় উঠে গিয়ে, তাকে সার্থক করে। আর সেই সাথে তিনি সাধারণ পাঠকমন্ডলীর কাছেও পৌছতে পারলেন। সাহিত্য অকাদেমী পুরস্কার তার মুকুটের এক রঙীন পালক। তিনি অদ্ভুতভাবে শব্দের ব্যবহার করতে শুরু করলেন এবং বাক্যবন্ধে নিয়ে এলেন এক অদ্ভুত দ্যোতনা --- “স্নায়ুর খোড়লে জমে আছে স্মৃতি-বিস্মৃতির নিস্তব্ধতা” (আয়নার সামনে, এখন) কিম্বা “বোদল্যেরের কাব্যগ্রন্থের পৃষ্ঠাগুলি এক অনন্ত বালুকাবেলায় মৃত্যু-গৃধিনীর চোখের মতো জ্বলছে।” (হে অনন্ত ছায়ানারী) এমনকি, শব্দের সাথে শব্দ জুড়ে দিয়ে শুরু করলেন অন্যরকম শব্দাক্ষরের নবনির্মাণ --- ‘ফসফরাস-সাদা’ কিম্বা ‘নীল দাঁত’ (অনন্তের সঙ্গে একা)।

আটটি পর্বে ভাগ করা এই পর্যায়ের সবচেয়ে মর্মস্পর্শী লেখাগুলো রয়েছে দ্বিতীয় পর্যায়ে। এই পর্যায়ের সমস্ত লেখাই (প্রায়) করোনার আবহে। “সাদা ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে পৃথিবী। নগ্ন অন্তর্দগ্ধ এক স্তব্ধতা, ঘড়ির শব্দ ছাড়া কিছু নেই, যেন সময়কে কুরে খাচ্ছে অনন্ত ইঁদুর। আমরা অকস্মাৎ ভয়ের কাছে সমর্পিত, যাকে ঘিরে চার দেওয়ালের মধ্যে আমাদের শম্বুক-শঙ্কিত হাঁটাচলা। সব ভুলে হঠাৎ আমরা, উদ্ধত সবজান্তা আমরা, আমাদের প্রকরণ-সুচতুর কুশলতা সত্ত্বেও, ভঙ্গুর, রিক্ত পাত্র যেন। হঠাৎ আমরা আবিস্কার করেছি, আমাদের কাছে পারাণির কড়ি নেই।” (আয়নার নির্জনে)

এই পর্যায়ের চিন্ময় গুহ সাদা পাতার ওপর পেন্সিলে আঁকা ছবির খসড়া। কারণ, এই পর্যায়ে নিজের অন্তর্গহনের চিন্তা ও বোধের সাথে মুখোমুখি হওয়া ছাড়া আর কিছুই নেই। কোন সাহিত্য নেই, কোন সিনেমা নেই, কোন জটিল দর্শনের ব্যাখ্যান নেই। আছেন শুধু তার সাথে তিনি নিজে। “মৃত্যু আসছে আমার ভাঙা ঘরে। নড়ছে তার ক্লান্ত হাড়, ধমনী, শিরা-উপশিরা।” (এই অন্ধকার স্বচ্ছতা)

কত কত দিন এই ঘুর্ণতাণ্ডবী পৃথিবীতে আমি একা, শুধু একা থাকতে চেয়েছি নুড়িপাথরের মতো একা, নিঃশব্দ, আমার গোপন কষ্ট আর লজ্জাকে নিয়ে? সূর্যহীন শূন্য এক কোণে, বন্ধুহীন, সংলাপশূন্য, কোন এক ভাঙা আয়নার অন্ধকার গোপন গর্ভে, একা এই মারণ-ভাইরাসের ভয়াল রাক্ষসমুখ কি জীবনের শাঁসকে নতুন করে উন্মোচিত করল আমাদের সামনে? মনে করিয়ে দিল কোনো অভঙ্গুর চিরকালীন সত্যকে? যখন সব অনুরণন ক্ষীণ হয়ে আসবে, সমুদ্রের মতো লবণাক্ত নৈঃশব্দ্য কি শিল্পীকে শেখাবে নির্মাণ, নিয়ে যাবে নতুন নির্মাণের কাছে?” (নিঃসঙ্গতার নির্মাণ)

কি অদ্ভুত! এই নিঃসঙ্গতায় তাকে একমাত্র যিনি সঙ্গ দিয়েছেন, তিনি রবীন্দ্রনাথ তার লেখায় এসেছেন পাস্কাল, এসেছেন তারকভস্কি, এসেছে নীৎসে-সহ আরও কত কেউ। কিন্তু আশ্রয়? “…জীবনানন্দের অশান্ত শান্ত হিমঘরেও খানিকক্ষণ পর অস্থির হয়েছি আরও নীল আকাশের জন্য দস্তয়েভস্কি পড়ে অসুস্থ লেগেছে, মনে হয়েছে মনোবৈকল্যের গুরু তিনি, প্রতিভাবান, কিন্তু সেই সহজতা নেই, সেই অতল জীবনস্রোত নেই যা একমাত্র একজনের আছে এই মৃত্যুঘোর রাত্রিতে তাঁকে নতুন করে পেয়েছি রবীন্দ্রনাথ ছাড়া কেউ শান্তি দেয়নি, কেউ না আমি বালিকাঁকড়ার মতো খুঁজছি যা নিখাদ, যা চিরসত্য

এই পর্বের প্রতিটা প্রবন্ধ চিন্ময় গুহের নিজস্ব, একান্ত, একাঙ্গীভুত বেদনামন্থিত অমৃতবোধ যা এতগুলো লেখা পেরিয়ে এসে আমাকে মুগ্ধ করল অন্যদিকে ষষ্ঠ পর্বটি তার ভালবাসার অভিপ্রকাশ রম্যাঁ রলাঁকে নিয়ে এর আগেও বিচ্ছিন্নভাবে বেশ কয়েকটি লেখা লিখেছেন, কিন্তু, আমার কাছে, রবীন্দ্রনাথ এবং রম্যাঁ রলাঁর সাহিত্য আলোচনা থেকে সরে এসে গান্ধী, রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ, দিলীপকুমার রায় ইত্যাদি অন্যান্য জীবন পর্যায়কে চিরচেনা আঙ্গিকের সাথে পরিবেশন মনে দাগ কেটে যায়।

অন্যান্য পর্বগুলিও ঠাস বুনোটের, যা তার বিভিন্ন বিষয়ে বিদগ্ধতার প্রমাণ। তা সে ফাদার দ্যতিয়েন হোক, কিম্বা শঙ্খ ঘোষ; বিদ্যাসাগর হোক, কিম্বা মল্লিকা সেনগুপ্ত; মিলান কুন্দেরা হোক নবারুণ ভট্টাচার্য। সব মিলিয়ে এমন এক পরিণত বইয়ের মুখোমুখি হওয়াটা পাঠিকা হিসাবে নিজেকে সৌভাগ্যবতীই মনে হয়।

“এই গ্রন্থে আমি সাহিত্যের নানারকমের আবিস্কারকে অনুধাবন করতে চেয়েছি। এইসব অক্ষরমালার অন্বেষণ নানা রঙে, নানা সুরে ও ছন্দে রচিত, যা পাঠকেরা সূচিপত্রের বিভাজন থেকে বুঝতে পারবেন। করোনা-কালে রচিত অনুরণনগুলির দার্শনিক অভিজ্ঞান পাঠককে স্পর্শ করবে আশা করি। এছাড়া অজস্র বিচিত্র বিষয়ে প্রবন্ধগুলি আমার ভালবাসার চিহ্ন বহন করে। বৈচিত্র্যই তো আত্মজিজ্ঞাসার প্রাণ।”

=======================

বিন্দু থেকে বিন্দুতে

চিন্ময় গুহ

পরম্পরা

মুদ্রিত মূল্যঃ ৫৫০ টাকা

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ ইন্টারনেট

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে