শারদীয়া কৃত্তিবাস পত্রিকা ২০২৩

১ 



প্রথমেই বলে নিই, আমি আজ পর্যন্ত রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোন উপন্যাস পড়ি নি। কেবলমাত্র কিছু প্রবন্ধ, মূলত বইয়ের ওপর, পড়েছি। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত লেখাগুলোর কথা বললেই, যেভাবে আমার অজ্ঞাত ফেসবুক বন্ধুরাও যেচে এসে মানা করে যেতেন, বুঝতে পারি, তার লেখনশৈলী কোন পর্যায়ে পৌছলে এতবড় দায়িত্ব এই বন্ধুরা আমার ওপর দেখাতে পারেন।

তো, এই প্রথম রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোন উপন্যাস পড়লাম।

এককথায় মুগ্ধ হলাম।

এমন রগরগে সাহিত্যসৃষ্টি আর চটি গল্পের মধ্যে ঠিক পার্থক্যটা কোথায় বুঝতে পারলাম না। তিনি কি বাংলার লরেন্স হতে চান? মনে হয় না তা তিনি হতে পারবেন, কারণ, লরেন্সেরও একটা শালীনতাবোধ ছিল।

আমার আশঙ্কা, এই উপন্যাস খুব তাড়াতাড়িই বই হয়ে বেরোবে। অথচ, প্রজাপতি কিম্বা বিবর-এর মতো নিষিদ্ধ ঘোষণা হবে না। যদিও, সমরেশ বসুও ওনার কাছে সদ্যোজাত শিশুমাত্র। কারণ, সাহিত্য আর মনস্তাত্বিক যৌনতা যদি হাত ধরাধরি করা হাটে তাহলে সমরেশ বসু হয়। আর যদি হাত ছাড়াছাড়ি করে হাটে, তাহলে রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় হয়।

আর্টিস্ট শোভন ভৌমিক বোধহয় তার জীবনের সেরা ছবিগুলো এঁকেছেন। শুধুমাত্র প্রচ্ছদের ছবি ছাড়া আর কোন ছবি সোশাল মিডিয়ায় দেওয়ার যোগ্য নয়। দিলে, আমি নিশ্চিত, মার্ক জুকারবার্গ, নিজে হাতে আমার প্রোফাইল সাসপেন্ড করার বাটনটা প্রেস করবেন। তবে এই সুযোগে, আর্টিস্ট ন্যুড স্টাডি করার যে চান্স পেয়েছেন, তা সুদে-আসলে উসুল করে নিয়েছেন।

উপন্যাসের বিষয় মার্লে ওবেরনের (যৌন) জীবন। যার জন্ম বম্বেতে। বেড়ে ওঠা কলকাতায়। ক্যাবারে ডান্সার ছিলেন। সেখান থেকে প্যারিস। তারপর ব্রিটেন। হলিউড। অনেক সিনেমা করেছেন। গাড়ি দুর্ঘটনার ফলে ছবি থেকে সরে আসেন কিছুদিন। পঁয়ষট্টি বছর বয়সে মৃত্যু। এর মাঝে চারটে বিয়ে করেছেন। অনেক সম্পর্ক। বিখ্যাত সিনেমাটোগ্রাফার লুসিয়েন বালার্ডের ‘ওবি লাইট’ কনসেপ্ট তার নামেই উৎসর্গীকৃত।

এই মার্লে ওবেরন রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখনীতে কিরকম রূপ পেলেন? “সত্যিই আমি বিকল্পবিহীন বেশ্যা। ব্লো-জব-এ তুলনাহীন। আমার বয়েষ ষাট। এখনও পুরুষ দমছুট আমার বিছানায়।” তার উপন্যাস শুরু হচ্ছে খানিকটা এইরকমভাবে। আর জন্মের কাহিনী? “আমার মায়ের বাপ এবং আমার বাপ একই ব্যক্তি।” রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে তথ্য বেশি ছিল বলে মনে হয় না। ফলে একই কথা বারংবার রিপিট করেছেন। এত বেশিবার এই জন্মের ইনসেস্টাস ঘটনা কিম্বা তার কলকাত্তাইয়া মানসিকতা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে, রসিয়ে রসিয়ে লিখেছেন বা তার দৈহিক ক্ষমতার এতবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিবরণ দিয়েছেন যে, একসময় স্পষ্টই বোঝা যায় যে, তার উপন্যাস লেখার উদ্দেশ্য কি ছিল!

এর মাঝে একখন্ড সেকেন্ড পারসন ন্যারেটিভে লেখা একটি চিঠি। চিঠিতে আবারও অভিনেত্রীর জীবনের উদগ্রতার মাদকতা নিয়ে লাইনের পর লাইন। বাৎসায়ন আর তন্ত্র কিভাবে তাকে মোহময় লীলাময়ী করেছে তার বর্ণনা। তন্ত্রে মান-সন্মান আর কিছুই রইল না। এমনিতেই তন্ত্রের সাথে কামার্ত হাতছানি দিয়ে লেখার পর লেখা হয়েই চলেছিল, তার উপর রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় রঙের আরেক পোঁচ মারলেন। তন্ত্রের আসল উদ্দেশ্য মোহিনী শক্তির আবিলতায় ডুবে গিয়ে সাহিত্য হয়ে এখন বাঙালি হৃদয়ে নাচানাচি করছে। যাই হোক, ফিরে আসি আবার, চিঠিটি মূলত মার্লের জীবনের কলকাতা অংশ। এমন চিঠি লিখবেই বা কেন তার প্রেমিক বোঝা গেল না যদিও, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্দেশ্য আবার বোঝা গেল।

তারপর দুই পাতা জুড়ে এক রাতের কাহিনী। মনে রাখতে হবে, প্রত্যেক পাতায় তিনটে কলাম আছে। তারপর আবার... আবার... আবার... অন্য কেউ, অন্য কারো সাথে... মনে ভাবি, একজন অস্কার নমিনেশান পাওয়া অভিনেত্রীর কি আর কোন ক্ষমতা ছিল না!

মার্লে ওবেরনের সিনেমা কি কেউ দেখেছেন? একসময়কার জনপ্রিয় এই হলিউড অভিনেত্রী অস্কার নমিনেশানে ছিলেন প্রথম এশীয় হিসাবে। Wuthering Heights কিম্বা The Dark Angel তার উল্লেখযোগ্য সিনেমার মধ্যে পড়ে।

উপন্যাসটা কি পাঠযোগ্য? পড়তে গেলে একটা কথাই মাথায় রাখতে হবে, মার্লে ওবেরনের কাজ, অভিনয় বা জীবনালেখ্য কিন্তু লেখকের বিষয়বস্তু নয়; তিনি কার কার বিছানা গরম করেছেন, সেটাও তার বিষয়বস্তু নয়; তিনি কিভাবে বিছানা গরম করেছেন, সেটাই হল উপন্যাসের বিষয়বস্তু।

কৃত্তিবাস এমন একটা উপন্যাস দিয়ে শারদীয়া পূজাবার্ষিকী শুরু করেছে। দুর্ভাগ্য তাদের, না আমাদের এটা সাহিত্য নিয়ে যারা PhD করছেন তাদের গবেষণার বিষয়বস্তু হতেই পারে


লেখিকা রাজশ্রী, আমরা এখানে...

============================

রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস পড়ার পরে, আমরা কোথায়, মানে বঙ্গীয় পাঠক হিসাবে আমাদের ঠিক কী অবস্থানে দেখা হচ্ছে লেখক এবং প্রকাশকদের চোখে, সেটা নিয়েই ধন্দে পড়ে গিয়েছিলাম। আমার কোথাও যেন মনে হচ্ছিল, কৃত্তিবাস কর্তৃপক্ষ এবং লেখক (এমনকি অলংকারিক-ও) আমাদেরকে যৌনচিন্তাসর্বস্ব মননের পাঠক পেয়েছেন, না হলে এমন উপন্যাস ছাপানোর প্রশ্নই ছিল না। এখন পাঠক কেমন, সেটা পাঠকই জবাব দিক, আমি আমার জবাব দিয়ে দিয়েছি। যদিও, মজার ব্যাপার, কিছু কিছু বিদগ্ধ পাঠক আমাকে কৃত্তিবাসের নেগেটিভ পেইড রিভিউকার ভেবে নিজেদের বিজ্ঞতা জাহির করেছেন। আমি তাদের কিছু বলি নি। যারা অতিরিক্ত ইনফরমেশান মাথায় গুঁজে ‘এসব আমার অনেক জানা আছে’ গোত্রের কথা বলে তাদের আমার কিছু বলার নেই। এতএব, আমি পরের উপন্যাসে আসি --- অদিতি, আমি এখানে। লেখিকা – রাজশ্রী বসু অধিকারী।

বেশ কয়েক বছর ধরেই আমার বাংলা উপন্যাস খুব জোলো লাগে। আর এখন তো সুবোধ সরকার পর্যন্ত বলে দিয়েছেন, “সর্বভারতীয় স্তরে বলার মতো কোন লেখক নেই আজ। আগামী ত্রিশ বছরেও দেখা যাবে কি না সন্দেহ।” আমি সম্পূর্ণ সহমত তার সাথে। প্রতি বছর পূজাবার্ষিকী পড়লে হাড়ে হাড়ে টের পাই, Quantity বাড়ছে, Quality কমছে।

ত্রিকোণ প্রেম। শুরু কলেজ লাইফ থেকে। উজ্জ্বল-অদিতি-উপল। উপলের সাথে বিয়ে হয় অদিতির। ডিভোর্স হওয়ার পর অদিতি উপলের ভাবে বিভোর হয়ে যায়। উপল বিয়ে করে শেলীকে। উজ্জ্বল এই সময়ে অদিতিকে তার বাড়িতে নিয়ে আসে। এবং পাঁচ বছর ধরে রেখে দেয়। সবাই জানে, তারা লিভ টুগেদার করছে। কিন্তু উজ্জ্বল অদিতিকে স্পর্শও করে নি। আহা! অদিতি কখনও উজ্জ্বলকে উপল ভাবে, কখনও উপলের জন্য ভাবে বিভোর হয়ে সব কিছু ভুলে যায়। উপল উপল আর উপল। রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব মা-কালীর ভাবে বিভোর ছিলেন, অদিতি উপলের ভাবে। অথচ অদিতিকে ওষুধ খেয়ে খেয়ে বন্দিনী থাকতে হয়। আর রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব হয়ে যান ‘অবতার বরিষ্ঠায়’। উজ্জ্বল এখানে অদিতির ‘মথুর’ হয়েছেন। তো যাই হোক, এইভাবে চলতে থাকে, চলতে চলতে... চলতে চলতে... এবং চলতে চলতে... অদিতির হুঁশ ফিরে আসে একসময়। সুস্থ হয়ে যায়। অতঃপর সবকিছু দেখে শুনে সে উজ্জ্বলকে বিয়ে করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। এরই মধ্যে আবার উপল অদিতির কাছে ফিরে আসতে মরিয়া হয়ে ওঠে।

এর বেশি কিছু নেই। যেমন আবেগপ্রবণ গল্প গত কয়েক বছর ধরে শারদীয়াতে পড়ে আসছি, এ তেমনই ফর্মুলায় বানানো। কিন্তু তবুও... রাজশ্রী বসু অধিকারীর উপন্যাস পড়তে ভালো লাগে। কারণ রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। অমন এক ভয়ঙ্কর উপন্যাসের পর বাংলা সিরিয়ালকেও যদি উপন্যাসরূপে পড়তাম, ভালো লাগত। কালমেঘের পাতা চিবিয়ে খাওয়ার পর পচা পুকুরের জলও সরবতের মতো মিস্টি লাগে। এ উপন্যাস সেইরকমই ভালো।

কৃত্তিবাসের সম্পাদক কি পাঠক মনস্তত্ত্ব গুলে খেয়েছেন? ওনারা কি জেনে গেছেন কোন উপন্যাসকে কিভাবে প্লেসিং করতে হবে? পরের উপন্যাস পড়লে বোঝা যাবে।

একটাই ব্যাপার এই উপন্যাস সম্পর্কে বলার আছে, তা হল, একদম শেষে গিয়ে একটা পাঞ্চ আছে। এমন অদ্ভুতভাবে শেষ হয়েছে, যা আমি ঠিক এক্সপেক্ট করি নি। যেমনটা হয় সাধারণত, তার থেকে ব্যাপারটা একদম অন্যরকম এন্ডিং হয়েছে। তুরুপের ওই একটাই তাস, রঙের তাস, স্পেডের টেক্কা। টেক্কাটি খেলে দিয়ে গেম ক্লোস করে অদিতির উপন্যাস শেষ করেছেন, আর এখানেই, একটা হাততালি লেখিকার প্রাপ্য।

অনুপ রায়ের অলংকরণ অতি জঘন্য। ‘ইচ্ছে ছিল না, জোর করে...’ টাইপের ছবিগুলো সব আঁকা। আমি পেইন্টিং বুঝি না, কিন্তু এতদিন ধরে ইলাস্ট্রেশান দেখতে দেখতে একটু হলেও আমি বুঝি এই বিশ্বাস আমার আছে। সেই অভিজ্ঞতা নিয়েই বলছি, এত অদ্ভুতুড়ে অলংকরণ আমি আগে দেখি নি। তার একটা উদাহরণ প্রচ্ছদটা দিয়েই রাখলাম।


Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে