ইমেজ ভার্সেস সিগনেচার

 


দশই সেপ্টেম্বর, দিবা দ্বিপ্রহরে, আমাদের অভিভাবকেরা, যখন দিবানিদ্রায় আত্মমগ্ন, তখন, আমরা কয়েকজন বন্ধু ও তাদের বয়ফ্রেন্ডরা শীততাপ নিয়ন্ত্রিত সিনেমা হলে, পপকর্ণ সহযোগে, শাহরুখ খানের জন্য গলা ফাটাতে ব্যস্ত। সারা হল যেন হিপনোটিজ্‌মে আক্রান্ত, মাস্‌ হিপনোটিজ্‌ম, যার থেকে বেরোনোর কোন সম্ভবনা নেই। তীব্র সিটির আওয়াজ আর চীৎকার শুনে কানে তালা লেগে যাওয়ার যোগাড়। গানের সাথে সাথে পর্দার সামনেই, জলসা বসে যাচ্ছে। কোমর কে বা কারা দোলাচ্ছে, জানি না, কিন্তু, আমরাও সমান তালে হাততালি দিয়ে তাদেরও উৎসাহ দিতে ব্যস্ত। এক চোখ সিনেমায়, আরেক চোখ তাদের দিকে। প্রসঙ্গত বলি, ফিরে এসে, আবিস্কার করেছি, আমার গলা বসে গেছে, আওয়াজ যা বেরোচ্ছে, তাতে নিজের কথা নিজেই শুনতে পারছি না, চেয়ারে চড়ে সিটি মারতে গিয়ে কোমরে সটকা খেয়ে সেঁক দিচ্ছি, এবং, অবধারিতভাবে, নেচেকুঁদে হঠাৎ ঘাম ঝরানোর কারনে, ঠান্ডা-গরমে আবার জ্বর চলে এসেছে। জ্বরের হাল্কা ঘোরেও আমি যেন শুনতে পাচ্ছি, সেই মারাত্মক ভয়েস, সে ফিসফিসিয়ে আমার কানে ঠোঁট রেখে সে বলছে, রেডি...???

হ্যাঁ, আমি রেডি, লেখাটা লেখার জন্য।

আসলে সিনেমাটায় শাহরুখ এবং শাহরুখ ছাড়া আর কিছু নেই। থাকার কথাও নয়, থাকতে পারে না, এটলি রাখেন নি।

আমি সিনেমাটা দেখতে দেখতে, সত্যি সত্যিই, একটা কথা ভাবছিলাম, সত্যিই এটা কি একটা অসাধারণ সিনেমা? অসাধারণ কামব্যাক সন্দেহ নেই। কোন হিরো একই সিজনে দুইবার হাজার কোটি টাকার সীমা ছাড়ানোর ক্ষমতা রাখতে পারে? আমি যখন এই লেখাটা লিখছি, রেড চিলি-র ফেসবুক পোস্টে দেখাচ্ছে, পাঁচশো কুড়ি কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে, কিন্তু আমাকে, তখন এবং এখনও ‘ইমেজ’ এবং ‘সিগনেচার’ এই দুটো শব্দ তাড়া করে বেড়াচ্ছেএই দুটোর মায়াজালে শাহরুখ নিজেই এমনভাবে বন্দী হয়ে গেছেন, যে, আজও তা থেকে বেরোতে পারছেন না, শুধু তাই নয়, যদি এবার বেরিয়ে না আসতে পারেন, তাহলে, অদূর ভবিষ্যতে তিনি আবার মুখ থুবড়ে পড়বেন, তখন উঠে আসাটা আরও কঠিন হবে।

শাহরুখের ক্যারিশমা, ম্যানারিজম্‌ আর স্টাইল --- সব মিলিয়ে নব্বইয়ের দশকে যে সিগনেচার তৈরী হয়েছিল, তা পুনরাবৃত্তির দোষে দুষ্ট হতে হতে কখন যে বিরক্তিকর হয়ে দাঁড়াল, তা তিনি নিজে টের পেয়েও পেতে চাইছিলেন না, এতএব, ফ্লপের পর মহাফ্লপ। আমার মনে হয়, নিজেকে ভেঙে ফেলার যে প্রক্রিয়া, তা পরিচালকদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বন্ধ রেখেছিলেন, ফলে দর্শকের চাহিদার আপডেশানটাই ভুলে গেলেন। নব্বই ও তার পরবর্তী দশকের মাঝামাঝি অবধি মেলোড্রামা টাইপ রোমান্স যে এই দশকে, তার পঞ্চাশ বছর বয়সে এবং এই সময়ের নিরিখে অচল, তা ভুলে যেতে বসেছিলেন। এই সিনেমাতে, কিম্বা পাঠান-এও যে ভাঙতে পেরেছেন, তা কিন্তু নয়। নয়নতারার সাথে, দীপিকা-র সাথে যখন রোম্যান্টিক দৃশ্যতে অভিনয় করছেন, তখনই, বোঝা যাচ্ছে, তিনি কতটা ব্যাকডেটেড হয়ে গেছেন। ঠিক এইখানেই, তাকে ভাবতে হবে। তার চিররোম্যান্টিক মেলোড্রামা থেকে বেরিয়ে আসার আশু প্রয়োজন। এখন আর রোমান্স নয়। তার রোমান্টিক যুগ রাণী মুখার্জী কিম্বা প্রীতি জিন্টার সাথে সাথেই অস্তাচলে চলে গেছে। দীপিকা তার শেষ স্টেশান। এই স্টেশানে ট্রেন আর বেশি সময় দাঁড়াবে না।

সিরিয়াস অভিনয় তিনি কোনদিনই পারতেন না। চক দে ইন্ডিয়া, কিম্বা স্বদেশ, কিম্বা ডিয়ার জিন্দেগী --- সিনেমাগুলোর কথা মাথায় রেখেই বলছি। সিরিয়াস অভিনয় তার পক্ষে এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। যা অমিতাভ বচ্চন পেরেছেন, তা এখনও পর্যন্ত তার কাছে আশা করা দুরাশা। এই সিনেমাতেই ধরুন না কেন, কৃষক সমস্যা নিয়ে, কিম্বা ভোট নিয়ে যে দীর্ঘ বক্তৃতাগুলো তার রয়েছে, সেখানে অযথা মাথা কাঁপিয়ে, ভ্রু কাঁপিয়ে, চোখে জল এনে, কিম্বা গলা কাঁপানোর যে সিগনেচার তার একান্ত নিজস্ব তা দিয়ে যা অভিনয় করেছেন, সেখানে তার ‘চরিত্র’ ছাপিয়ে ‘ইমেজ’ এসে পড়েছে, এবং সেই ইমেজ যাত্রাপালার মতো লাগে। যে যাত্রাপালার নতুনত্ব নব্বইয়ের দশকে থাকতে পারে, কিন্তু রাজকুমার রাও কিম্বা নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকীর অভিনয় দেখলে বোঝা যায়, বর্তমানে সেই অতিনাটকীয় অভিনয় কতটা ব্যাকডেটেড

কিন্তু তবুও, ভক্তকূলের ভাল লাগে কেন? কেন মুগ্ধতার মায়াবাণী মানুষের মুখে মুখে? একটাই কারণ, অ্যাকশান তার অ্যাকশান দর্শকের অ্যাড্রিনালিন হরমোনকে এতটাই ক্ষরণ করায়, যে, সেই সময়ে, এই মেলোড্রামাও যেন ফিকে হয়ে যায়, মনে হয় ওটা চরিত্রেরই অংশ কিন্তু, আমি নিশ্চিত, একান্তে বসে যখন এই সিনেমা একটু মন দিয়ে দেখা যাবে, তখন, কিম্বা, যখন শুধুমাত্র এই অংশটুকু কেটে নিয়ে দেখা যাবে, কিম্বা বছর দশেক পরে আবার যখন সিনেমাটা দেখব, তখন, আমরা দেখব, DTPH, MNIK, DDLJ, KKHH কিম্বা JTHJ বা দেবদাস–এর সেই বিরক্তিকর মেলোড্রামার সাথে কোন পার্থক্যই নেই।

কিন্তু তবুও, ‘মেগাহিট’ শব্দটাও এই সিনেমার কাছে ফিকে হয়ে গেছে! তার ক্রেজ আকাশকে ছুঁয়ে আকাশপারের দিকে যাত্রা করেছে। সেই ক্রেজের দিকে একটু তাকানো যাক।

DDLJ–তে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সেখানে একটা ছোট্ট অ্যাকশান দৃশ্য আছে। সেটা নাকি শাহরুখের নিজস্ব উদ্ভাবন। এমনকি, ‘বাদশা’ কমেডি ফিল্ম হওয়া সত্ত্বেও, তার মধ্যে অ্যাকশানে তিনি এতটাই পারদর্শী যে, অ্যাকশান কমেডির মোড়কে এসে তা নতুন রূপ পায়। যে কারণে, ‘ডন’ সিরিজ, স্বতন্ত্র হয়ে গিয়েছিল অমিতাভ বচ্চনের কাল্ট সিনেমাটার পরেও। অর্থাৎ, অ্যাকশানে চিরকালই তাকে অন্যরকম লেগেছে। যে কারণে ‘শক্তি দ্য পাওয়ার’ বা ‘করণ অর্জুন’ বা ‘ম্যায় হুঁ না’–র অ্যাকশানে তাকে এত ভালো লাগে। পার্শ্বচরিত্র হওয়া সত্ত্বেও।

এই জায়গাতেই যখন আত্মপ্রকাশ করলেন, ‘পাঠান’ সিনেমাতে, আমার মনে হয়, সেখানে তার সিগনেচার তার ইমেজকে ছাপিয়ে চরিত্রে এসে ঢুকে গেল। আর যে মুহূর্তে এটা হল, সেই মুহূর্তেই আমরা বেবাক বনে গেলাম। এ শাহরুখ যেন আমার চিরপরিচিত হয়েও চির অচেনা। এমনকি, ‘জওয়ান’ সিনেমাতেও ছেলের চেয়ে অ্যাকশানে বাবা অনেক অনেক এগিয়ে রয়েছেন চরিত্রের দাবী মেনেই এগিয়ে রয়েছেন। এবং এই যে অ্যাকশানের সূক্ষ্মতা এবং চরিত্রের চাহিদা অনুসারে বদল, সেটাই তাকে এক অসাধারণ উচ্চতায় নিয়ে গেছে মনে করুন, গাড়ী চুরির সময় ওই বরো রাস্তাটায়, কিম্বা একেবারে শেষ দৃশ্যে বাবা-ছেলে যখন একসাথে অ্যাকশান করছে জেলের মধ্যে। দুই চরিত্রের প্রেজেন্টেশানে কত পার্থক্য! অথচ নয়নতারা এবং দীপিকা-র সাথে যখন রোমান্স করছেন তখন ততটাই একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছেন। ত্রিশ বছরের সময়ের ব্যবধানে যে চরিত্রের প্রেমের ব্যবহার বদলে যায়, তাকে প্রেজেন্ট করার কোন পথ তার জানা নেই। দুজনের সাথে দুটো করে গানের দৃশ্য দেখলেই বোঝা যায়।

শাহরুখের এই সিনেমা ভারতীয় কমার্শিয়াল সিনেমার জগতে যে লিগ্যাসী তৈরী করবে, তা শাহরুখ নিজেও আর ভাঙতে পারবেন কি? সন্দেহ আছে। কমার্শিয়াল সিনেমার এক মাইলস্টোন হয়ে থাকবে এই সিনেমা। এবং ‘ডঙ্কি’-ও, ধরে নেওয়া যেতে পারে, হিট হয়েই গেছে, যদিও, তার বিষয়বস্তু জানতে পারলে আরও স্পষ্ট করে বলা যেতে পারত।

শাহরুখের মধ্যে এমন একটা ব্যক্তিত্ব আছে যে, সেই ব্যক্তিত্বের মধ্যে এই সিনেমাতে, অন্তত, সবাই ডুবে গেছে। যে বিজয় সেতুপতিকে আমরা ‘ভিক্রম’-এ দেখেছিলাম, তার ২৫ শতাংশও এখানে পেলাম না। মুগ্ধতার মধ্যেই তার অভিনয় শুরু, ডবল মুগ্ধতার মধ্যে তার শেষ। আমি দেখতে দেখতে অবাক হয়ে ভাবছিলাম, এ কাকে দেখছি! ভিলেন যদি শান্ত শীতল রোমহর্ষক মৃত্যু-অনুভূতি না দিতে পারে, তাহলে সে সার্থক খলনায়ক হল কি করে? ম্যাড়ামেড়ে লাগল তার অভিনয়। যদিও দ্বিতীয়ার্ধে অনেকটা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন। দীপিকার কিছু করার ছিল না। ছিল না বাকি ছয় মহিলারও --- প্রিয়ামানি কিম্বা সানিয়া --- সবাই মুগ্ধতা নিয়েই অভিনয় করে গেলেন সারাটা সিনেমা জুড়ে।

একমাত্র নয়নতারা ছাড়া। গোটা সিনেমাতে এই একজন চরিত্রই শাহরুখের চোখে চোখ রেখে অভিনয় করে গেছেণ। এ যেন, তুই শাহরুখ হলে আমিও নয়নতারা – টাইপের। একমাত্র এই একজনই যেভাবে টেক্কা দিয়ে গেছেন, তা স্যালুট করার মতো। ওই শীতল চোখ, রিজার্ভ অভিনয়, অথচ মুখে আনন্দ-বেদনার কাব্য সময়ে সময়ে ঝলমল করেছে। যদিও তার চরিত্রটাকে আরোও বর্ণময় করা যেতে পারত। বাবা শাহরুখের শেডে বিজয় সেতুপতি এবং ছেলে শাহরুখের শেডে নয়নতারা। ঠিকঠাক অভিনয় এবং ঠিকঠাক ব্যবহার করা গেলে সিনেমা আরও জমে যেত।

এখন এরকমভাবেই যদি, শাহরুখ খান, সাউথের মশালা একশান মুভি করতে পারেন, তাহলে তাকে কিন্তু ধরা মুশকিল। অ্যাকশানে তাকে সাউথই ঠিকঠাক ব্যবহার করতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস, ‘পাঠান’ সিনেমাটার কথা মাথায় রেখেই বলছি। আর সেই সাথে তিনি যদি KKR থেকে ভেঙ্কি মাইসোরকে সরিয়ে একজন ভালো ম্যানেজার আনতে পারেন, তাহলে তার IPL ব্যবসাও হয়তো, লাভের পাশাপাশি, KKR ভক্তকূলেরও মন জয় করে নিতে পারে।

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে