ছবি নিয়ে একটি আবেদন



‘দেশ’ পত্রিকা বের হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই জনাকয়েক উৎসাহী পাঠক-পাঠিকা যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব মূল পত্রিকার ছবিসমেত সূচীপত্র দিয়ে অনেক লাইক/কমেন্টস্‌ পেয়ে যখন আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তখন কিন্তু আমি একটু টাস্‌কি খেয়ে গিয়েছিলাম প্রচ্ছদ দেখেমনে হয়েছিল, এবারের ঝড়টি আসছে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস দিয়ে নয়, যা প্রত্যাশিত ছিল, এবার ঝড় আসবে প্রচ্ছদ নিয়ে, যা পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত।

হলও তাই।

শ্রদ্ধেয় রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চারকোলের টানে মাত্র কয়েকটি রেখার নির্মাণের মাধুর্যে ‘দেশ’ নামটিও পারলে যেন নিজেকে বিলুপ্ত করে দেয়। সম্পাদক মহাশয় ছবির পেছনে, এক কোনায়, শিবের জটাজালে থাকা চাঁদের মতো ‘দেশ’ নামটিকে স্থান দিয়েছেন যেন কৃতজ্ঞচিত্তে বর্ষীয়ান শিল্পী তার তীব্র রেখাটানের লেখচিত্রে দেবীর আলোকচ্ছটার রঙীন রূপ সম্পূর্ণ বিবর্জিত করে সাদাতে-কালোতে এক ছিমছাম সরল প্রচ্ছদ সৃষ্টি করেছেন। এবং সমগ্র পাতাজুড়ে আর কোনরকম কোন প্রতীকেরও স্থানমাত্র দেন নি। ‘দেশ’ তা স্বাগত জানিয়েছে।

সশ্রদ্ধ সাহস বটে!

এখন, এই ছবিটিকে নিয়ে মোটামুটি তিনটি ভাগে ভাগ হয়ে গেছেন তামাম ‘দেশ’ দর্শককূল। একদল বলছেন, অসামান্য কাজ; আরেকদল বলছেন, ভালো লাগেনি এবারের প্রচ্ছদ। প্রথম দল দ্বিতীয় দলকে ব্যঙ্গ করছেন, Uncultured, গণ্ডমূর্খ, নির্বোধ বলে; দ্বিতীয়জন জবাব দিচ্ছেন, এ থেকেই প্রমাণ হচ্ছে, প্রথমোক্ত দল কতটা Uncultured, কারণ, তারা বিরোধিতা কিম্বা সত্যকথা বরদাস্ত করতে পারছেন না, কিম্বা ভালো না লাগাটাকে সুষ্পষ্ট স্বরে বললে সহ্য করতে পারছেন না, তারা ব্যক্তিস্বাধীনতার বিরোধী মাঝখান থেকে অনেক পোস্টের কমেন্টস্‌ অ্যাডমিনেরা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন। আর তৃতীয় দল সেই পোস্টে ইঁট পেতে বসে নীরবে রগড় দেখছেন।

এখন প্রশ্ন হল দুটি – যদি জানা যেত ছবিটা ‘হুলো মিত্তির’ কিম্বা ‘পেঁচি চাটুজ্যে’ নামক অজ্ঞাত কোন আর্টিস্টের, যিনি, এই প্রথম আত্মপ্রকাশ করছেন এই ছবি দিয়ে, তাহলেও কি এই প্রথমোক্ত দল এমনই সাধুবাদ জানাতেন এই কাজটিকে, যাদের মধ্যে প্রখ্যাত এবং বিখ্যাত শিল্পীদেরও দেখতে পাচ্ছি? আমরা জানি, চিরকালই কালোত্তীর্ণ শিল্প বর্জিত হয়েছে তৎকালীন সমালোচক কিম্বা দর্শকের এমনকি শিল্পরসিকদের কাছেও। পরে দলে ভক্তের আগমন ঘটেছে, বুঝে কিম্বা না বুঝে তারা দল ভারী করে অন্ধ কিম্বা দৃষ্টিপ্রদীপযুক্ত ভক্তরূপে দল সমৃদ্ধ করেছেন।

আর দ্বিতীয় প্রশ্ন, যারা বলছেন ভালো লাগেনি, তাদের ক্ষেত্রে দেখছি একমাত্র প্রামান্য নিজের ভাললাগা; কিন্তু ভালো লাগে নি কেন, তার কোনরকম কোন সদুত্তর নেইএখন পাল্টা প্রশ্ন, ভালো লাগার কোন যুক্তি আছে কি? হ্যাঁ আছে। কার কোন জিনিসটা ভাল লাগবে, আর কোন জিনিসটা ভালো লাগবে না, সেটা বর্তমানের নিউরোসায়েন্স বা মনস্তত্ত্ব অনায়াসে নির্ণয় করতে সক্ষম। সায়েন্সের আন্ডারে যা, তা যুক্তিনির্ভর, এবং চাইলে আমরা সেই প্রথাগত যুক্তির মধ্যে দিয়েই নতুন করে ভালো লাগাটা চিনতে শিখি, বুঝতে পারি। আমাদের শিক্ষকেরা, কিম্বা আমাদের আদর্শেরা কিন্তু সেই কাজটাই করে চলেছেন আজও। ছোটবেলায় যে বিষয় আমার একদমই ভাল লাগত না, দেখা গেল, পরবর্তীকালে কোন ভালো শিক্ষকের মায়াময় শিক্ষাদানে সেই বিষয়কেই জীবনের ধ্রুবতারা বানিয়ে ফেললাম। সুতরাং ভালো-মন্দের পিছনে যুক্তি আছে, আর আছে বলেই যে সার্থক শিল্প প্রথম দর্শনেই ভালো লাগে না, বারংবার তার চর্চায় তার রূপ চোখে ধরা দিতে থাকেরবীন্দ্রনাথ আক্ষেপ করেছিলেন, বাঙালীরা দেখতে শেখেনি। তারা ছবি দেখতে জানে না। তাদের সে চোখ নেই। আজ, রামানন্দ বন্দ্যোপাধায়ের ছবিটার পরিপ্রেক্ষিতে পোস্ট এবং কমেন্টস্‌ তারই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, রবীন্দ্রনাথের সেই আক্ষেপ আজকের দিনেও কতটা মর্মান্তিক সত্য।

      তো, আমার মনে হয়, শিল্পের (পড়ুনঃ ছবিটির) ভালো-মন্দ যারা লিখছেন, সেইসব self-taught বিজ্ঞজনেরা দয়া করে যদি কারণসহ আলোচনা করেন, তাহলে কটূক্তি করে কিম্বা কটূক্তি শুনে নিজেদেরকে এবং প্রতিপক্ষকে uncultured প্রমাণ করার কোন প্রয়োজন হবে না। সুস্থ আলোচনার মধ্যে দিয়েই ছবির যথাযথ মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে, কিম্বা বর্জিত হবে ||

===========================
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ ইন্টারনেট


Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে